উন্নত দেশগুলো ক্ষতিপূরণের অর্থ দেয়ার ক্ষেত্রে নানা রকম শর্ত দিয়ে কালক্ষেপণ করছে৷
যে অর্থটুকু দিতে প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে, সেই অর্থ কীভাবে বাংলাদেশের মতো ক্ষতিগ্রস্ত দেশ পাবে? কবে পাবে?
জলবায়ু পরিবর্তনের মাত্রা ক্রমাগত বৃদ্ধি পাচ্ছে৷ যার প্রভাব বাংলাদেশের মতো নিম্ন মাত্রায় কার্বন নির্গমনকারী দেশ ভোগ করছে৷ বাংলাদেশের জলবায়ু প্রভাবজনিত এলাকা গুলোর মধ্যে অন্যতম উপকূলীয় এলাকা৷ সাতক্ষীরা বাংলাদেশের দক্ষিণ পশ্চিমের শেষ জেলা৷ সুন্দরবন আর বঙ্গোপসাগরের তীরে হওয়ায় জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়৷
প্রতিবছর প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসে লণ্ডভণ্ড হয়ে যায় আমাদের এলাকা৷ তবে আগের থেকে বর্তমানে দুর্যোগের মাত্রা বৃদ্ধি পেয়েছে আনুপাতিক হারে অনেক বেশি৷ ২০০৭ সালে প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড় সিডর আঘাত হানে তারপর ২০০৯ সালে ঘূর্ণিঝড় আইলা৷ দুই তিন বছরের একটি বিরতি থাকলেও এখন প্রতি বছর দুই থেকে তিনটি প্রকৃতির দুর্যোগ আঘাত হানছে৷ এসব দুর্যোগের ক্ষয়-ক্ষতির সচক্ষে ভালোরকম অবলোকন করা যায়৷ ক্ষয়-ক্ষতি জান ও মালের অনেক বেশি হয়৷ তবে এসবের থেকেও যে সমস্যাটা বেশি আমাদের হুমকির দিকে ঠেলে দিচ্ছে প্রতিনিয়ত তা হলো লবণাক্ততা৷
আমাদের এলাকার মানুষ সুপেয় পানির সংকটের জন্য আগে থেকে বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ করে খেলেও অনিয়ন্ত্রিত বর্ষার কারণে সেই আশাও অনেকটা আশাহত হচ্ছে৷ যার ফলে উপকূল জুড়ে সবসময় বিশুদ্ধ খাবার পানির সংকট তীব্র৷
নীরব ঘাতকের মতো এই সমস্যা সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ছে, জীবন জীবিকাকে প্রভাবিত করছে৷ লবণাক্ততার কারণে বিশেষ করে স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে আমাদের উপকূলের নারী ও শিশুরা৷ চাষাবাদের জন্য প্রতিকূল পরিবেশ হওয়ায় কৃষি পেশা ছেড়ে বিকল্প কর্মসংস্থানের জন্য স্থানান্তরিত হচ্ছে ক্রমাগত৷ কাজের জন্য বছরের বড় একটি সময় আমার এলাকা ছেড়ে দেশের অন্য কোনো শহরে কিংবা পাশ্ববর্তী দেশে গিয়ে শ্রমিক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করছে৷
অর্থনৈতিক সংকট মোকাবিলা করতে হলে দরকার বিকল্প কর্মসংস্থান দীর্ঘ মেয়াদি পরিকল্পনা ব্যতীত সমস্যা সমাধান সম্ভব না৷
ঘূর্ণিঝড়ের অভিজ্ঞতা
আমার ২৪ বছরের জীবনে ১১ টি ঘূর্ণিঝড়ের বাস্তব অভিজ্ঞতা হয়েছে৷ আট বছর বয়সে ২০০৯ সালের ২৫ মে ঘূর্ণিঝড় আইলা, ২০১৩ সালের ১৬ মে মহাসেন, ২০১৫ সালের ৩০ জুলাই কোমেন, ২০১৬ সালের ২১ মে রোয়ানু, ২০১৭ সালের ২৯ মে মোরা, ২০১৯ সালের ১০ মে ফণী, ২০২০ সালের ২০ নভেম্বর বুলবুল, ২০২১ সালের ২৬ মে ইয়াস, ২০২২ সালের ১২ মে অশনী এবং ২০২৩ সালের ১৪ মে ‘মোখা' আঘাত হানে৷ সর্বশেষ ঘূর্ণিঝড় রিমাল ২০২৪ সালের ২৬ মে মাসে৷ এসব দুর্যোগে একের পর মানুষ নিঃস্ব হয়েছেন৷ অভিযোজনের সক্ষমতাও ক্রমান্বয়ে কমতে শুরু করেছে৷
যাদের ক্ষতিপূরণ দেয়ার কথা তাদের ভূমিকা কী?
জলবায়ু পরিবর্তনের পিছনে যেসকল উন্নতদেশ বা দূষণকারী দেশের অবদান তারা ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর ক্ষতিপূরণ দেয়ার কথা থাকলেও টালবাহানা করে তারা দায় এড়িয়ে যাচ্ছে৷ উন্নত দেশগুলো ২০০৯ সালের কোপেনহেগেন জলবায়ু সম্মেলনে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল যে, তারা ২০২০ সালের মধ্যে উন্নয়নশীল দেশগুলোকে প্রতি বছর ১০০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার জলবায়ু অর্থায়ন হিসেবে দেবে৷ কিন্তু এই প্রতিশ্রুতিটি পরবর্তীতে ২০২১ সালে স্কটল্যান্ডে জলবায়ু সম্মেলন ( কপ-২৬) এ বাস্তবায়ন হয়৷
যে পরিমাণ ক্ষয়-ক্ষতি প্রতিবছর হচ্ছে সেই অনুযায়ী, ক্ষতিপূরণের আশ্বাসও পাওয়া যাচ্ছে না৷ বাদই দিলাম সেই অর্থের বাস্তবায়ন৷ সর্বশেষ জলবায়ু সম্মেলন (কপ-২৯) আজারবাইজানের রাজধানী বাকুতে অনুষ্ঠিত হলো৷ সেখানে ১.৩ ট্রিলিয়ন ডলারের দাবি জানায় আমাদের মতো ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলো৷ কিন্তু নর্দিষ্ট সময়ে ২০০ বিলিয়ন ডলার দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে দায় এড়িয়ে যায় উন্নত দেশগুলো৷ কিন্তু ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর চাপের মুখে সেখানে অতিরিক্ত তেত্রিশ ঘণ্টা সময় ক্ষেপণ করে ক্ষতিগ্রস্ত দেশের চাপে ৩০০ মিলিয়ন ডলার দেওয়ার প্রতিশ্রুতিতে দরকষাকষি শেষ হয়৷
উন্নত দেশগুলো ক্ষতিপূরণের অর্থ দেয়ার ক্ষেত্রে নানারকম শর্ত দিয়ে কালক্ষেপণ করছে৷ অ্যাডাপটেশন ফান্ডে অর্থ না দিয়ে তারা সবসময় মিটিগেশনে অর্থ দিতে আগ্রহী৷ কারণ, সেখানে উন্নত দেশগুলোর স্বার্থ রয়েছে৷ তাদের থেকে প্রযুক্তি সহায়তাসহ নানা সহায়তায় নিতে হবে৷ দিন শেষে দেখা যায় উন্নত দেশ তাদের স্বার্থের বাইরে খুব কমই চিন্তা করে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর অর্থ দেওয়ার ক্ষেত্রে৷
তবে প্রশ্ন থেকে যায়, যে অর্থটুকু দিতে প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে সেই অর্থ কীভাবে বাংলাদেশের মতো ক্ষতিগ্রস্ত দেশ পাবে? কবে পাবে? সেই অর্থ দিয়ে আমাদের জীবন জীবিকার মানের কোনো পরিবর্তন আদৌ হবে কিনা৷
বর্তমানে উন্নতদেশগুলো আমাদের মতো ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোকে ন্যায্য হিস্য না দিয়ে আমাদেরকে ঋণের বোঝা চাপিয়ে দিচ্ছে, যা তারা সুদে-আসলে পরবর্তীতে নিয়ে যাবে৷ এটা সত্যিই আমাদের জন্য মরার উপর খাঁড়ার ঘা৷
প্রতিবছর জলবায়ু সম্মেলনে আশা নিয়ে বাংলাদেশ হাজির হলেও হতাশা নিয়ে ফিরতে হয়৷ জলবায়ু সম্মেলনে কী হচ্ছে এটা নিয়ে উপকূলের মানুষ খুব বেশি চিন্তিত না থাকলেও তারা অপেক্ষায় থাকে দূষণকারী দেশের দান খয়রাত না, ক্ষতিপূরণের অর্থ দিয়ে নিজেরা কিভাবে ঘুরে দাঁড়াবে৷