কলকাতায় এখনো জনপ্রিয় শতবর্ষ পার হওয়া জৌলুসহীন পাইস হোটেলগুলি
কলকাতার ফুড হেরিটেজের অঙ্গ হলো শহরের পাইস হোটেলগুলি, যেখানে এখনো সস্তায় পেট ভরা খাবার খাওয়া যায়।
কলকাতার পাইস হোটেল
কলকাতার ভোজবিলাসে পাইস হোটেলের উদ্ভব হয় মোটামুটি আঠেরো শতকের মাঝামাঝি। চাকরির খোঁজে গ্রাম বাংলা থেকে মহানগরের পথে পা বাড়ানো বাঙালির পেটে সস্তায় খাবারের জোগান দিতে গজিয়ে উঠেছিল এই সব ‘ইটিং হাউস’। মাত্র দু-চার পাই খরচ করলেই সেই সময়ে সেখানে পাওয়া যেত পেটচুক্তি খাবার। যতক্ষণ না উদরপূর্তি হচ্ছে ততক্ষণ খাবারের ঢালাও ব্যবস্থা। শহুরে সেই সব ভাতের হোটেল তাই চলতি জবানে পরিচিতি পেল পাইস হোটেল নামে।
পাইস হোটেল এখন
কলকাতার অলিতে গলিতে রমরম করে চলে আসছে প্রাচীন পাইস হোটেলগুলি। তবে তা চরিত্র বদল করেছে। অধিকাংশ পাইস হোটেলে এখন আর পেটচুক্তিতে যত খুশি খাও-এর ব্যবস্থা নেই। বসে খাওয়ার ব্তযবস্বেথাও সাধারণ। তা এখনো অন্য রোস্তোরাঁর তুলনায় অনেক সস্তা এবং টাটকা ঘরোয়া খাবার পরিবেশন করে। সেজন্য এখন আবার নতুন করে পাইস হোটেলের জনপ্রিয়তা বেড়েছে। তবে তার পিছনে ফুড ভ্লগারদের অবদান যথেষ্ট।
শহুরে সুবিধের বিপরীত প্রান্তে দাঁড়িয়েও
মেট্রো, মাল্টিপ্লেক্স, অ্যাপক্যাব, অনলাইন ফুড ডেলিভারি— এতসব আধুনিক শহুরে সুবিধের এক্কেবারে বিপরীত প্রান্তে দাঁড়িয়েও মাথা তুলে টিকে রয়েছে কলকাতার অলিগলির আটপৌরে পাইস হোটেলগুলো। কোনোটা ১০০ ছুঁতে চলেছে, আবার কোনোটা ১০০ বছর পার করেছে অনেকদিন আগেই।
দ্রুত জনপ্রিয়তা পেলো
তখন প্রচুর মানুষ একটা ঘর বা ছোট বাড়ি ভাড়া করে থাকতেন। সেখানে খাওয়ার ব্যবস্থা ছিল না। কলকাতার বাইরে থেকে প্রচুর মানুষ চাকরির জন্য আসতেন। তাছাড়া শহরের গরিব মানুষরা তো আছেনই। তাদের কাছে দ্রুত জনপ্রিয় হয়ে ওঠে পাইস হোটেল। মানুষকে ঘরের রান্নার স্বাদ পৌঁছে দেওয়া ছিল এই হোটেলগুলোর লক্ষ্য। আজও এখানে খুব বেশি মশলা ব্যবহার করা হয় না। ওড়িশা থেকে আসা রাঁধুনিরা এই হোটেলগুলোয় রান্না করেন।
অবলুপ্তি ও পুনরুজ্জীবন
গত শতকের শেষ দিক থেকেই পাইস হোটেলের অবলুপ্তির কাহিনি শুরু হয়ে যায়। নবসাজে সজ্জিত শহুরে রেস্তোঁরার সঙ্গে পাল্লা দিতে না পারা পাইস হোটেলগুলো ধুঁকতে শুরু করে। যুগের নিয়মে পাইস হোটেল সংস্কৃতির অবসান হবে এমনটাই ভাবা হচ্ছিল, কিন্তু ইন্টারনেট প্রযুক্তি যেন জিয়নকাঠির ছোঁয়ার মতো কাজ করলো। সমাজমাধ্যমের রমরমা আর ফুড ভ্লগারেরা কলকাতার বাঙালিকে চেনাতে শুরু করলো একশ বছর বা তারও বেশি পুরনো এই হোটেলগুলিকে।
মাছের নানান পদ
দেখতে গেলে পাইস হোটেলগুলোর সরল পুঁজি হলো, টাটকা খাবার। এক্কেবারে বাড়ির রান্নার মতো। মরশুমি আনাজ, টাটকা মাছ-মাংস, শিলে বা হামানদিস্তায় বাটা মশলা— সঙ্গে দক্ষ পাচকের হাতের ছোঁয়া। কৈলাশ বোস স্ট্রিটের জগন্মাতা ভোজনালয়ের কর্ণধারের সঙ্গে কথা বলে জানা গেলো, প্রথম থেকেই তারা এই সকল বিষয়ে যত্ন নেন। তবে এখন আর পেটচুক্তিতে খাবারের ব্যবস্থা নেই।
জগন্মাতা ভোজনালয়
উত্তর কলকাতার এই জগন্মাতা ভোজনালয়ের বয়স অনেককাল আগেই ১০০ ছাড়িয়েছে। সাইনবোর্ডের ওড়িয়া লেখা দেখে বুঝতে অসুবিধে হয় না যে এই হোটেলের খাবারে ওড়িয়া রান্নার পরম্পরা খুঁজে পাওয়া যাবে। মুসুর ডাল, ঝিরঝিরে আলুভাজা, মৌরলা মাছের চচ্চড়ি, ছোটো ভেটকির সর্ষেবাটা ঝাল, আরো পাওয়া যায় গুরজাওলি, ট্যাংরা, কই, তেলাপিয়া, পমফ্রেট, চিতল। এই দুর্মূল্যের বাজারেও এখানে পাঁচ টাকায় ভাত পাওয়া যায়।
অতিথির আতিথেয়তা
সুকিয়া স্ট্রিটের মোড় থেকে ডান হাত ধরে উত্তর দিকে একটু এগোলেই চোখে পড়বে অতিথি হোটেলের সাইনবোর্ড। কলকাতার খুঁতখুঁতে খাদ্যপ্রেমীদের অনেকের মতেই, পোস্তবাটা দেওয়া রুইয়ের ঝোল একাধিক পাইস হোটেলে পাওয়া গেলেও, এদেরটা অন্যদের থেকে অনেক এগিয়ে। এদের খাদ্যতালিকায় মাছের ছড়াছড়ি। রুই সর্ষে, দই পোনা বা রুই মাছের কালিয়া, ট্যাংরা, পার্শে, পাবদা আর মৌরলার ঝাল।
মধ্য কলকাতার সিদ্ধেশ্বরী আশ্রম
সিদ্ধেশ্বরী আশ্রম। নয় দশকেরও বেশি সময় ধরে ধারাবাহিকভাবে কলকাত্তাইয়া ভেতো বাঙালির তারিফ কুড়িয়ে চলেছে মধ্য কলকাতার এই পাইস হোটেলটি। সাবেকি রান্নার স্বাদ এরা ধরে রেখেছে আজও। স্বাস্থ্যসচেতন ভোজন রসিকদের জন্য কাঁচকলা-পটল-আলু দেওয়া রুইয়ের কবিরাজি ঝোলও এখানে পাওয়া যায়। দেখতে রোগীর পথ্যের মতো হলেও স্বাদে তা অসাধারণ।
শতবর্ষের তরুণ নিকেতন
পাইস হোটেলের আধিক্য কলকাতার উত্তর ভাগেই। দক্ষিণে খানিক কমই। তবে দক্ষিণ কলকাতার রাসবিহারী অ্যাভিনিউয়ের তরুণ নিকেতন, পাইস হোটেল ছায়াপথের এক অন্যতম নক্ষত্র। শতবর্ষ পার করা এই হোটেলে এককালে মাটিতে বসিয়ে খাওয়ানোর রেওয়াজ ছিল। তবে এখনো এখানে কলাপাতায় খাবার পরিবেশন করা হয়। এদের চিংড়িমাছের মালাইকারি বিখ্যাত হলেও, কচু চিংড়ি ও কচুপাতা চিংড়ি এখানে আসা ভোজনরসিকদের বেশি পছন্দের।
পেঁয়াজ-রসুন ছাড়াই
তরুণ নিকেতনের একটি অনন্য বৈশিষ্ট রয়েছে। মাছ-মাংস ছাড়া কোনও পদেই পেঁয়াজ-রসুন ব্যবহার করা হয় না এখানে। হোটেলের মালিক জানালেন তাদের পাচকদের হাতের জাদুতে পেঁয়াজ-রসুন ছাড়া পদও সুস্বাদু লাগে।
কলকাতা জুড়ে আরো
কলেজ স্ট্রিট অঞ্চলে স্বাধীন ভারত হিন্দু হোটেল ও মহল। বহুদিন ধরেই কলেজপাড়ার পড়ুয়া থেকে শুরু করে এখানকার বইব্যবসায়ী— সকলের মুখেই স্বল্পমূল্যে সুস্বাদু খাবার তুলে দিচ্ছেন এরা। স্বাধীন ভারত হিন্দু হোটেলের মুড়ো দিয়ে মুগের ডাল আর মুইঠ্যা সবচেয়ে জনপ্রিয়।
পারবে কি টিকে থাকতে?
ইন্টারনেট ঘেঁটে এক্সপেরিমেন্টাল রান্না করতে শিখেছে পশ্চিমবঙ্গের বাঙালি। ঘরে ঘরে এয়ারকন্ডিশনারের যুগে গরমে গলদঘর্ম হয়ে পাখার তলায় খেতে বসার অভ্যেসও বদলে ফেলেছে মানুষ। তাদের আকর্ষণ করছে থিম রেস্তোরাঁ এবং ফিউশন খাবার। এত সব রংচঙে সুযোগ সুবিধের মাঝেও আটপৌড়ে চেহারায় দাঁড়িয়ে থাকা পাইস হোটেলগুলো নিজেদের সে’ভাবে আপডেট করেনি এখনো। তাই প্রশ্ন ওঠে, এই হোটেলগুলো কি শেষপর্যন্ত টিকে থাকতে পারবে?