কলকাতার বইপাড়া
প্রতি শীতে কলকাতায় বসে আন্তর্জাতিক বইমেলা৷ তবে বছরভর বইপত্রের বিকিকিনি চলে বইপাড়ায়৷ ২০০৭ সালে টাইম ম্যাগাজিনের বিচারে ভারতের উল্লেখযোগ্য গন্তব্যের তকমা পেয়েছে এই বইপাড়া৷
বইয়ের দুনিয়ায়
মধ্য কলকাতার এই রাস্তাকে কেন্দ্র করে বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ বইয়ের বাজার৷ কলেজ স্ট্রিট, মহাত্মা গান্ধী রোড, বঙ্কিম চ্যাটার্জি স্ট্রিট, কলেজ রো, বেনিয়াটোলা লেন, শ্যামাচরণ দে স্ট্রিট, নবীন কুণ্ডু লেন, কলেজ স্কোয়ার-সহ বিভিন্ন রাস্তায় ছড়িয়ে রয়েছে বই ও সেই সংক্রান্ত ব্যবসা৷
মেলা বইয়ের মেলা
শিয়ালদা ও হাওড়ার সংযোগকারী মহাত্মা গান্ধী রোড ধরে চলতে থাকলে আপনি মেলায় ঢুকে পড়বেন৷ ফুটপাতে দুপুরের আগেই বইয়ের পসরা সাজিয়ে বসেন বিক্রেতারা৷ গোড়ার দিকে এভাবেই বিক্রিবাট্টার রেওয়াজ ছিল বইপাড়ায়৷
ইতিহাস
কমবেশি দেড়শো বছরের ইতিহাস বাঙালির গর্বের বইপাড়ার৷ উনিশ শতকের প্রথম ভাগে প্রতিষ্ঠিত সংস্কৃত কলেজ, হিন্দু কলেজ (আজকের প্রেসিডেন্সি)-এর সৌজন্যে কলেজ স্ট্রিটের নামকরণ৷ বইপাড়ার আদি যুগের সাক্ষী দাশগুপ্ত এন্ড কোম্পানি৷ ১৮৮৬ সালে প্রতিষ্ঠিত এই দোকান দেশের হেরিটেজ বুকশপ৷
বইয়ের শো-রুম
হাজার দেড়েক স্টল রয়েছে এই চত্বরে৷ এছাড়া বড়-ছোট অসংখ্য প্রকাশকের নিজস্ব বিপণিও রয়েছে৷ বেনিয়াটোলা লেনের এই বিপণি আনন্দ পাবলিশার্স-এর৷ দে’জ পাবলিশিং-এর কর্তা শুভঙ্কর দে বলেন, ‘‘বিপুল অঙ্কের ব্যবসা হয় প্রতি বছর৷ সাহিত্য ছাড়াও টেক্সট বই রয়েছে৷ তাই সঠিক পরিসংখ্যান দেয়া সম্ভব নয়৷’’
বিদ্যাসাগরের হাত ধরে
আধুনিক বাংলা ভাষার জনক ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর বই ব্যবসার অন্যতম আদিপুরুষ৷ কলেজপাড়ায় ছিল তার ‘সংস্কৃত প্রেস ডিপোজিটরি’৷ সেই পরম্পরা বয়ে নিয়ে চলেছে সারি দেয়া এসব স্টল৷ প্রতি দু-তিন পা এগোলেই প্রশ্নের মুখে পড়বেন, ‘‘দাদা কী বই লাগবে?’’
পড়াশোনার বই
হিন্দু কলেজের পাশে গড়ে উঠেছিল স্কুল বুক সোসাইটি৷ সেই উনিশ শতকে৷ আজো স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক থেকে পড়ুয়া ও গবেষকরা বইপাড়ায় আসেন নানা বইয়ের খোঁজে৷ সংস্কৃত কলেজের প্রবেশপথের দুপাশে পাঠ্যের নোটস কিংবা আইন বা ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের বই, কী নেই!
হবু ডাক্তারদের জন্য
বইপাড়ার প্রথম যুগের দোকান বেঙ্গল মেডিক্যাল লাইব্রেরি৷ এর প্রতিষ্ঠাতা গুরুদাস চট্টোপাধ্যায় হিন্দু হোস্টেলের সিঁড়ির কোণে ‘মেটেরিয়া মেডিকা’ বিক্রি করতেন৷ বঙ্কিম চ্যাটার্জি স্ট্রিটের এমন স্টলে চিকিৎসাশাস্ত্রের বইয়ের জন্য হবু চিকিৎসকদের আসতেই হয়৷
বাংলাদেশি লেখকদের বই
হাঁটতে হাঁটতে চোখে পড়বে ওপার বাংলার সাহিত্যিকদের বই৷ শ্যামাচরণ দে স্ট্রিটে শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের পাশেই হিমু বা মিসির আলির কাহিনি৷ বাংলাদেশের বইয়ের ভারতীয় পরিবেশক নয়া উদ্যোগ ছাড়াও কথাপ্রকাশ, পাঠক সমাবেশের কাউন্টার রয়েছে বইপাড়ায়৷
সোভিয়েতের অবশেষ
বিদেশি বইয়ের বিপুল সম্ভার রয়েছে কলকাতার বইপাড়ায়৷ সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের ছাপা অনেক বই এখনো পাওয়া যায় কলেজ স্কোয়ারের কাছে মার্কসীয় পত্রিকার বিপণিতে৷ বিদেশের দুষ্প্রাপ্য বইয়ের খোঁজও মেলে কোথাও কোথাও৷
মেলার বারোমাস্যা
কলকাতা আন্তর্জাতিক পুস্তকমেলা বসে দিন দশেকের জন্য৷ সেখানে ঘোষিত ছাড় মোট দামের ১০ শতাংশ৷ পাঠকদের একাংশ মেলায় বই যাচাই করেন, কিন্তু কেনেন বইপাড়া থেকে৷ বারোমাসের এই মেলায় দ্বিগুণ ছাড় নিশ্চিত৷
একটি বই ১০০
এশিয়ার বৃহত্তম ও বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম পুরনো বইয়ের বাজার এই মহল্লা৷ হেয়ার স্কুলের প্রাচীর লাগোয়া স্টলে সেকেন্ড হ্যান্ড বই পাবেন অফারে৷ প্রায় ৫০টি এমন দোকানে রাশি রাশি বই৷ অধিকাংশ ইংরেজি৷ যেটিই পছন্দ হোক, দাম একই৷ ১০০ টাকা৷
খাতা-পেনের বাজার
শুধু কি বই, পড়াশোনার হরেক সামগ্রী সস্তায় মেলে এই পাড়ায়৷ পেন-পেন্সিল, ফাইল-কভার, রং-তুলি, কেজি দরের খাতা৷ ইউনিভার্সিটি ইনস্টিটিউট হলের বিপরীত ফুটপাতে দিনভর চলে হাঁকডাক৷ করোনা পর্বে লকডাউনের ধাক্কা সামলে ছন্দ ফিরে পেয়েছে এই বাজার৷
নব ‘বর্ণপরিচয়’
সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বেড়েছে প্রকাশকের সংখ্যা, কিন্তু প্রাচীন শহর আড়ে-বহরে বাড়েনি৷ নতুন যুগের বিশাল ‘বর্ণপরিচয়’ ভবন অনেক প্রকাশনা সংস্থার আশ্রয় হয়ে উঠেছে৷ যদিও ঠনঠনিয়াগামী রাস্তার মুখে পাঁচতলা এই ভবন এখনো পরিকল্পনা অনুযায়ী পুরোপুরি সেজে ওঠেনি৷
কফি হাউসের আড্ডা
তর্কপ্রিয় বাঙালির ভাবনার বাতায়ন কফি হাউস৷ পরাধীন ভারতে ব্রাহ্ম আন্দোলনের নেতা কেশবচন্দ্র সেনের পূর্বপুরুষ তৈরি করেন অ্যালবার্ট হল৷ সেখানেই আজকের কফি হাউস৷ সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের মতো কত না সাহিত্যিকের স্মৃতিতে ধন্য এই ভবন আজো বইপাড়ায় আড্ডার প্রধান ঠিকানা৷
আড্ডার সঙ্গে বই
উত্তর কলকাতার বটতলা এককালে ছিল শহরের বই প্রকাশের কেন্দ্র৷ সেই শহরের নয়া ফ্যাশন বুক ক্যাফে৷ চা-কফি-পানীয়ের সঙ্গে বই পড়ার সুযোগ৷ কলেজ স্কোয়ারের লাগোয়া এই ক্যাফেতে পাঠক খোঁজেন অবকাশ৷ প্রিয় মানুষ ও বইয়ের সঙ্গে৷