কলকাতা মেট্রোতে আত্মহত্যা থামাতে কী ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে?
২০ মার্চ ২০২৫ভারতের ভূগর্ভস্থ রেল পরিষেবার ক্ষেত্রে পথ দেখিয়েছে কলকাতা। মেট্রো রেল এই শহরের 'লাইফ লাইন' হিসেবে পরিচিত হয়ে উঠেছে। লক্ষ লক্ষ মানুষ নিয়মিত এই পরিষেবা ব্যবহার করলেও অনেকের কাছে মেট্রো হয়ে উঠেছে 'ডেথ লাইন'।
রেলমন্ত্রীর বক্তব্য
বিভিন্ন সময় মেট্রোর চাকা থেমে যায় লাইনে ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যার ফলে। এই আত্মহত্যা ক্রমশই বেড়ে চলেছে। এ নিয়ে দক্ষিণ কলকাতা তৃণমূল সাংসদ মালা রায় লিখিত প্রশ্ন রাখেন লোকসভায়। এর জবাবে রেলমন্ত্রী অশ্বিনী বৈাষ্ণব তথ্য দিয়েছেন, ২০২০ সাল থেকে ধরলে এখনো পর্যন্ত কলকাতার ভূগর্ভস্থ রেলে মোট ১৯ জন আত্মহত্যা করেছেন।
প্রতি বছর মেট্রো স্টেশনে আত্মহত্যার সংখ্যা বাড়ছে। রেলমন্ত্রী জানিয়েছেন, বিগত পাঁচ বছরের মধ্যে সব থেকে বেশি মানুষ আত্মঘাতী হয়েছেন গত বছর। ২০২৪ সালে সাত জন আত্মহত্যা করেছেন। মন্ত্রী বলেন, ২০২০ সালে এক, ২০২২ সালে পাঁচ, ২০২৩-এ চার এবং চলতি বছরে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত কলকাতা মেট্রোতে দু'ই জন আত্মহত্যা করেছেন।
ক্রমশ বাড়তে থাকা আত্মহত্যা ঠেকাতে কী ব্যবস্থা নিচ্ছে কেন্দ্রীয় সরকার, রেল মন্ত্রকের কাছে এই প্রশ্ন রাখেন তৃণমূল সাংসদ। একই সঙ্গে জানতে চান, কলকাতা মেট্রোর সব স্টেশনে স্লাইডিং ডোর বসানোর পরিকল্পনা মন্ত্রকের আছে কি না।
রেল মন্ত্রী দাবি করেন, সল্টলেকের সেক্টর ৫ থেকে শিয়ালদহ পর্যন্ত বিস্তৃত রুটের ১২টি স্টেশনের সব ক'টিতেই বসানো হয়েছে স্লাইডিং ডোর। কিন্তু ব্লু লাইন, যেখানে আত্মহত্যার ঘটনা ঘটছে, সেই জায়গায় স্লাইডিং ডোর বসানোর ব্যাপারে আশ্বাস দিতে পারেননি মন্ত্রী।
রেলমন্ত্রী বলেন, "দক্ষিণেশ্বর থেকে কবি সুভাষ পর্যন্ত রুটে সব স্টেশনে স্লাইডিং ডোরের বিকল্প গার্ডরেল বসানোর জন্য শুরু করা হচ্ছে পাইলট প্রকল্প।" এই উদ্দেশ্যে কালীঘাট স্টেশনে পাইলট প্রকল্পের সূচনার কথাও বলেন তিনি।
এই বক্তব্য থেকে স্পষ্ট, ব্লু লাইনে আপাতত স্লাইডিং ডোর থাকছে না। এই বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে প্রশ্ন উঠেছে, আত্মহত্যা ঠেকানোর জন্য কার্যকরী স্লাইডিং দরজার বদলে গার্ডরেল বসানো হলে আত্মহত্যার প্রবণতাকে কী ভাবে আটকানো যাবে?
বিশেষজ্ঞদের বক্তব্য, ট্রেন স্টেশনে ঢোকা পর্যন্ত গার্ডরেল রাখতে হবে। ট্রেন প্ল্যাটফর্মে ঢোকার পরে গার্ডরেল খুলে যাবে, আবার বন্ধ হয়ে যাবে ট্রেন বেরিয়ে গেলে। কিন্তু এই ব্যবস্থা কার্যকরী করার ক্ষেত্রে কিছু সমস্যাও রয়েছে।
স্লাইডিং ডোর কবে?
আত্মহত্যা রোখার ক্ষেত্রে সবচেয়ে কার্যকারী হতে পারে স্লাইডিং ডোর। সেটি প্লাটফর্মের ধারে না বসা পর্যন্ত সচেতনতা মূলক প্রচারের উপর ভরসা করতে হচ্ছে মেট্রো কর্তৃপক্ষ। এ নিয়ে বিশেষ উদ্যোগ নিয়েছে কলকাতা মেট্রো।
ব্লু লাইনে উত্তরে দক্ষিণেশ্বর থেকে দক্ষিণে নিউ গড়িয়া পর্যন্ত লাইনের ধারে রঙিন ব্যানার লাগানো হয়েছে। এই ব্যানার প্ল্যাটফর্ম থেকে পরিষ্কার দেখা যায়। একইসঙ্গে ঘনঘন মেট্রো স্টেশনে ঘোষণা করা হচ্ছে, যাতে কেউ হলুদ রেখা পার করে না যান। প্ল্যাটফর্মের একেবারে কিনারা থেকে দুই ফুটের মতো দূরত্ব ছেড়ে লম্বালম্বি এই হলুদ রেখা টানা হয়েছে। ট্রেন প্ল্যাটফর্মে যখন থাকে না, সেই সময়ে এই রেখা অতিক্রম করা যায় না। এ জন্য প্ল্যাটফর্মের দুই প্রান্তে লাইনের ধার ঘেঁষে নিরাপত্তাকর্মীরা থাকেন।
মেট্রো কর্তৃপক্ষ জানিয়েছেন, সিসিটিভি ক্যামেরার মাধ্যমে বিভিন্ন স্টেশনের যাত্রীদের উপর নজরদারি চালানো হয়। কারো আচরণ সন্দেহজনক মনে হলে সংশ্লিষ্ট স্টেশনে খবর দেয়া হচ্ছে।
আত্মহত্যার সংখ্যা বৃদ্ধিতে অস্বাভাবিকত্ব কিছু দেখছেন না বিশেষজ্ঞরা। ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্ট বা চিকিৎসা মনোবিদ ডা. প্রশান্তকুমার রায় ডিডাব্লিউকে বলেন, "মেট্রো লাইনে ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যার প্রবণতা বেশি, তার কারণ এটা সহজলভ্য। এ ছাড়া জনসংখ্যা বেড়েছে। তাই আত্মহত্যার সংখ্যাও বেড়েছে। যারা তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্তে আত্মঘাতী হতে মেট্রো স্টেশনে আসছেন, তাদের ক্ষেত্রে সতর্কতামূলক প্রচার কাজে আসতে পারে। মেট্রো স্টেশনে পোস্টার দেখে অনেকে সিদ্ধান্ত বদলাতে পারেন। এই পোস্টারে মৃত্যুর কথা সাধারণত লেখা হয় না। তবে স্পষ্টভাবে আত্মহত্যার কথা লেখা হলে বুঝতে সুবিধা হয়।"
কিন্তু মূল যে রোগ, যে মনের অসুখের তাড়নায় মানুষ আত্মঘাতী হতে চাইছে, তার কী প্রতিকার। ডা. রায় বলেন, "মানুষের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা আলাদা আলাদা ধরনের হয়। কেউ অনেকদিন ধরে পরিকল্পনা করে আত্মঘাতী হন। অনেকে সিদ্ধান্ত নেন তাৎক্ষণিকভাবে। পরীক্ষায় খারাপ ফল, সম্পর্ক ভেঙে যাওয়ার কারণে হঠাৎ কেউ আত্মহত্যাপ্রবণ হয়ে ওঠেন। এই পরিস্থিতিতে তাদের সঙ্গে যদি পাঁচ-দশ মিনিট কথা বলা যায় তাহলে প্রাণ বাঁচানো সম্ভব।"