কলকাতা বইমেলায় রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে কিছুক্ষণ
৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৫পাবলিশার্স অ্যান্ড বুকসেলার্স গিল্ডের অফিসের সামনে দাঁড়িয়ে ছিলেন তিনি। হাত দুটে পিছনে রাখা। সাদা পয়জামা, পাঞ্জাবির উপর কালো জোব্বা। সেই গভীর দৃষ্টি দিয়ে চারপাশে দেখছিলেন।
হঠাৎ করে দেখলে মনে হবে, স্বয়ং রবীন্দ্রনাথই বুঝি এসে দাঁড়িয়েছেন টাইম মেশিনে সওয়ার হয়ে। তবে বইমেলার রবীন্দ্রনাথ অত লম্বা নন, অত গৌরবর্ণও নন। কিন্তু তাতে কী এসে যায়। দেখতে একরকম। ফলে বিভ্রম হওয়াটা স্বাভাবিক।
বাইমেলার রবীন্দ্রনাথের কাছে এগিয়ে যাই। জানতে চাই, রোজ আসছেন? একটু হাসেন। তারপর বলেন, রোজ আসি। একটা নাগাদ বইমেলায় ঢুকে পড়ি। আটটা পর্যন্ত থাকি। এতক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতে অসুবিধা হয় না? জবাব এলো, হয় তো। পা টনটন করে। কিন্তু একটা আনন্দও আছে। এই যে সবাই, দেখছে, কথা বলছে, ছবি তুলছে, তাতে সব কষ্ট ভুলে যাই।
ঠিকই। কবিও তো সারা জীবনে কম কষ্ট পাননি। কিন্তু সেই কষ্ট অতিক্রম করতে পেরেছিলেন তিনি। প্রচণ্ড গরম, শারীরিক অসুবিধা, নানান যন্ত্রণা অতিক্রম করে লিখে যেতে পারতেন।
বইমেলার রবীন্দ্রনাথের আসল নাম সোমনাথ ভদ্র। থাকেন উত্তর কলকাতায়। চাকরি করতেন কলকাতা টেলিফোনে। স্ত্রী, মেয়ে নিয়ে সংসার। রামকৃষ্ণ মিশনের এক সন্ন্যাসী তাকে প্রথম বলেন, তিনি রবীন্দ্রনাথের মতো দেখতে। তারপর দাড়ি, চুল বাড়ানো। গত ১২ বছর ধরে এরকম চুল-দাড়ি রাখছেন বইমেলার রবীন্দ্রনাথ।
বইমেলা যখন থাকে না, তখন তিনি চলে যান রবীন্দ্রসদন, একাডেমি চত্বরে। আর পঁচিশে বৈশাখ এলে শুরু হয় তাকে নিয়ে টানাটানি। সোমনাথ বলছিলেন, তখন অনেকগুলি চ্যানেলে, সিরিয়ালে যেতে হয়। আমাকে নিয়ে রীতিমতো টানাটানি শুরু হয়ে যায়। অনেক মেলার উদ্যোক্তারা আমায় নিয়ে যান।
আর বইমেলাতেও প্রচুর মানুষ আসেন। কথা বলেন, ছবি তোলেন, মুগ্ধ দৃষ্টিতে দেখেন। সোমনাথ বললেন, ''ছবি তুললে গেলে আমিও দক্ষিণা চাই। যে যা দেয়, তাই নিয়ে নিই। তাতে রোজগার খারাপ হয় না। তবে তার থেকেও বড় কথা, এমন অভিজ্ঞতা হয় যে ভালার নয়। একটা বাচ্চা মেয়ে তো আমাকে তাদের বাড়িতে নিয়ে যাবেই। সে কী কান্নাকাটি। অনেক বুঝিয়ে নিরস্ত করতে হয় তাকে।''
বাঙালির ভিতরে এভাবেই তো ঢুকে আছেন রবীন্দ্রনাথ। তার বই বিক্রি করে প্রকাশকরা বাঁচছেন, তার গান অনেকদিন ধরে বাঁচিয়ে রেখেছে পশ্চিমবঙ্গের গানশিল্পকে, তার শান্তিনিকেতন, শ্রীনিকেতন হাজারো মানুষের রুটিরুজি যোগাচ্ছে। রবীন্দ্রনাথ তাই শুধু পশ্চিমবাঙ্গের সাহিত্য, সঙ্গীত জগতের ধ্রুবতারাই নন, তিনি নিরন্তর মানুষের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করছেন এখনো।
রবীন্দ্রনাথ পড়েছেন? একটু হেসে সোমনাথের জবাব, ''সব কী আর পড়তে পারি। কিছু কিছু পড়েছি। তবে প্রচুর গান শুনেছি এবং শুনি। প্রিয় গান হলো আগুনের পরশমণি।'' আর প্রিয় গল্প, উপন্যাস? সোমনাথের স্বীকারোক্তি, ''অতটা তো পড়তে পারিনি।''
বইমেলার রবীন্দ্রনাথ গিল্ডের অফিসের সামনে দাঁড়িয়ে থাকেন, মানুষ ছবি তুলতে থাকে। তাকে দেখতে থাকে। চারপাশে বইয়ের দোকানের দিকে চোখ রাখি। দেখতে পাই প্রায় প্রতিটি স্টলেই হয় রবীন্দ্রনাথের লেখা বই অথবা তাকে নিয়ে লেখা বই রাখা হয়েছে। এতদিন পরেও তাকে ছাড়া পশ্চিমবঙ্গের বইয়ের জগত চলে না। চলতে পারে না।
কেমন বিক্রি হয় রবীন্দ্রনাথের বই। দেবাশিস নন্দী মূলত ইংরেজি বই রাখেন। সেখানেও অবধারিতভাবে আছেন রবীন্দ্রনাথ। দেবাশিস জানালেন, ''গীতাঞ্জলি তো একশ কপি বিক্রি হয়ই। রবীন্দ্রনাথের ছোটগল্পের বই অন্তত গোটা ২৫-৩০ বিক্রি হয় বইমেলায়।''
এ তো গেলো একটি স্টলের কথা। এমনই রাশি রাশি স্টল আছে। অন্যদের পাশাপাশি তারাও বিক্রি করছেন রবীন্দ্রনাথের বই বা তার উপর লেখা বই। ফলে তার উপস্থিতি বইমেলার সর্বত্র। সোমনাথ থেকে শুরু করে অনেককেই তিনি বেঁচে থাকার রশদ দিয়ে যাচ্ছেন। এখনো।