ওয়াকফ আন্দোলন ঘিরে মুর্শিদাবাদে সহিংসতা, মৃত্যু
১৩ এপ্রিল ২০২৫রাষ্ট্রপতি দ্রৌপদী মুর্মুর স্বাক্ষরের পর সংসদে পাশ হওয়া ওয়াকফ সংশোধনী বিল আইনে পরিণত হয়েছে৷ আইনটি বাতিলের দাবিতে বিভিন্ন রাজ্যে প্রতিবাদ চলছে৷ পথে নেমেছেন মুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষ৷ পশ্চিমবঙ্গে গত কয়েকদিন ধরে চলছে এই আন্দোলন৷ কোথাও কোথাও তা সহিংস আকার ধারণ করেছে৷
গত তিনদিন ধরে অশান্ত রয়েছে মুর্শিদাবাদের সামশেরগঞ্জ, সুতি, ধুলিয়ান-সহ বিভিন্ন এলাকা৷ সামশেরগঞ্জে বাবা-ছেলেকে পিটিয়ে, কুপিয়ে খুনের অভিযোগ উঠেছে৷ রানিপুরের জাফরাবাদে বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেওয়ার ঘটনা ঘটেছে৷
গুলিবিদ্ধ হয়ে এক কিশোরের মৃত্যু হয়েছে সুতিতে৷ সাজুর মোড়ে অবরোধ চলছিল৷ সেই সময়ে পুলিশের সঙ্গে জনতার সংঘর্ষ শুরু হয়৷ এই ঘটনার মধ্যে পড়ে গুলিবিদ্ধ হয় সপ্তম শ্রেণির ছাত্র ইজাজ আহমেদ৷ পরে হাসপাতালে তার মৃত্যু হয়৷ আরো একজন গুলিবিদ্ধ হয়েছেন৷ আহত সামশের নাদাব এখন হাসপাতালে ভর্তি৷
রাজ্য পুলিশের এডিজি (আইনশৃঙ্খলা) জাভেদ শামিম এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘‘সাজুর মোড়ে সংযত থেকে পুলিশ পদক্ষেপ করেছিল৷ কিন্তু উত্তেজিত জনতাকে নিয়ন্ত্রণে আনা যায়নি৷ প্রায় তিন ঘণ্টা পুলিশের উপরে হামলা চলে, দোকানপাট ভাঙচুর করা হয়৷ বাধ্য হয়ে পুলিশকে চার রাউন্ড গুলি চালাতে হয়৷'' জঙ্গিপুরের তৃণমূল সাংসদ খলিলুর রহমানকেও ছাড় দেয়নি জনতা৷ তিনিও বিক্ষোভস্থলে হেনস্থার মুখে পড়েন৷
মুর্শিদাবাদে কেন্দ্রীয় বাহিনী
পরিস্থিতি ক্রমশ উত্তপ্ত হয়ে ওঠায় কলকাতা হাইকোর্ট মুর্শিদাবাদে কেন্দ্রীয় বাহিনী মোতায়েনের নির্দেশ দেয় শনিবারই৷ এই আবেদন জানিয়ে আদালতের দ্বারস্থ হন বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী৷ তার আবেদনকে স্বীকৃতি দিয়ে বিচারপতি সৌমেনে সেন ও বিচারপতি রাজা বসু চৌধুরীর স্পেশাল বেঞ্চ শনিবার বলে, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষায় কেন্দ্রীয় বাহিনী ও স্থানীয় পুলিশ-প্রশাসন একজোট হয়ে কাজ করবে ৷
মুর্শিদাবাদে অশান্তি বাড়ার পরে পুলিশের তৎপরতাও বেড়েছে৷ রাজ্য পুলিশের ডিজি রাজীব কুমার শনিবার সন্ধেয় জেলায় পৌঁছান ৷ সেখানে তিনি বলেন, ‘‘মানুষের জীবন রক্ষা করা আমাদের দায়িত্ব৷ তাই যেখানে যতটুকু প্রয়োজন পুলিশ পদক্ষেপ করেছে৷ কিন্তু পুলিশের সংযমকে দুর্বলতা হিসাবে দেখবেন না৷ প্রয়োজনে কঠোরতম পদক্ষেপ করবে পুলিশ৷''
শনিবার রাত থেকে জেলার কিছু অংশে কেন্দ্রীয় বাহিনী মোতায়েন করা হয়েছে৷ রাতভর এই বাহিনী সুতি, সামশেরগঞ্জ থানা এলাকায় টহল দিয়েছে৷ পুলিশের সঙ্গে যৌথ দল গ্রামে গ্রামে গিয়েছে৷ তল্লাশি অভিযানে ব্যাপক ধরপাকড় চলছে৷ মোট গ্রেপ্তারের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১৩৮ জনে৷ নতুন করে অশান্তি এড়াতে রবিবার সকালে যৌথ রুটমার্চ করা হয়েছে ৷
বিএসএফ আগেই ময়দানে নেমেছে স্বতঃপ্রণোদিতভাবে৷ জেলাশাসক রাজর্ষি মিত্র বলেন, ‘‘বিএসএফকে ডাকা হয়নি৷ যেহেতু এই এলাকাটি ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তবর্তী, তাই বিএসএফ এই এলাকায় এসেছে৷''
রবিবারও বিভিন্ন এলাকা ছিল থমথমে৷ ১৭ কোম্পানি কেন্দ্রীয় বাহিনী মোতায়েন করা হয়েছে৷ তবু আতঙ্কে জেলার বাসিন্দাদের একাংশ ঘর ছাড়ছেন৷ মুর্শিদাবাদের গঙ্গার বিপরীত দিকে মালদার বৈষ্ণবনগর৷ সেখানে দলে দলে মানুষ চলে যাচ্ছেন নদী পেরিয়ে৷ কেউ কেউ চলে যাচ্ছেন পাশের রাজ্য ঝাড়খণ্ডে৷
সহিংসতায় ব্যক্তিগত ও সরকারি সম্পত্তির ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে৷ উত্তেজিত জনতা রেল স্টেশনেও ভাঙচুর চালিয়েছে ৷ আগুন লাগিয়ে দেওয়া হয় স্টেশন লাগোয়া রেলের অফিসে ৷ এই ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে রেলমন্ত্রী অশ্বিনী বৈষ্ণবকে চিঠি দিয়ে দিয়েছেন বিরোধী দলনেতা ৷ একের পর এক জায়গায় বোমাবাজি, অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটায় এনআইএ তদন্তের আর্জি জানিয়েছেন তিনি ৷ তৃণমূল নেতা কুণাল ঘোষের বক্তব্য, ‘‘এর পেছনে বিজেপির ষড়যন্ত্র আছে কি না, সেটা দেখতে হবে৷ অন্য রাজ্যের অশান্তির ছবি পশ্চিমবঙ্গের বলে পোস্ট করা হচ্ছে৷''
শান্তি বজায় রাখার আবেদন জানিয়ে বার্তা দিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়৷ তিনি এক্স পোস্টে লিখেছেন, ‘কিছু রাজনৈতিক দল ধর্মকে অপব্যবহার করে রাজনৈতিক সুবিধা নিতে চাইছে৷ তাদের প্ররোচনায় পা দেবেন না৷ আমি মনে করি, ধর্ম মানে মানবিকতা, সহৃদয়তা, সভ্যতা ও সম্প্রীতি৷ সকলে শান্তি ও সম্প্রীতি বজায় রাখুন— এই আমার আবেদন৷'
ভিডিও বার্তায় রাজ্যপাল সিভি আনন্দ বোস বলেছেন, ‘‘গণতন্ত্রে প্রতিবাদ করা যায়, কিন্তু বিশৃঙ্খলা কাম্য নয়৷ দুষ্কৃতীদের বিরুদ্ধে অত্যন্ত কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে৷’’
তৃণমূল-বিজেপির সংঘাত?
এদিকে পরিস্থিতি মোকাবিলায় পুলিশ-প্রশাসনের ব্যর্থতাকে দায়ী করছে বিরোধীরা৷ সাবেক পুলিশকর্তা নজরুল ইসলামের একই মত৷ ডিডাব্লিউকে বলেন, "পুলিশ শক্ত হাতে পরিস্থিতির মোকাবিলা করলে এই পরিস্থিতি হতো না৷ বিএসএফকে ডাকতে হতো না৷ চাকরি বাতিল নিয়ে যখন রাজ্যে উত্তাল, তখন সবার নজর ঘুরে গিয়েছে মুর্শিদাবাদের দিকে৷ এটা হিন্দু-মুসলমানের সমস্যা নয়৷ এটা তৃণমূল-বিজেপির সমস্যা৷ ধর্মের ভিত্তিতে ভোট ভাগ হলে ওদের সুবিধা৷ তাই এ ধরনের ঘটনা আয়ত্তে আনা যাচ্ছে না৷"
রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক রবীন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য বলেন, "বহু মানুষ ওয়াকফ আইনের বিরোধিতা করছে৷ কয়েকটি নির্দিষ্ট ক্ষেত্রে আমারও বিরোধিতা রয়েছে৷ বিরোধিতা থাকা মানে এই নয়, আইন নিজেদের হাতে তুলে নিতে হবে৷ চার দিন ধরে সহিংসতা চলছে আর সরকার সেটা দেখে যাচ্ছে, এটা চলতে পারে না৷ যেদিন ১০ হাজার মানুষ হাইওয়ে অবরোধ করল, সেদিন কঠোর হাতে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করা হলে, আজ এতটা সহিংসতা হতো না৷ এটা শুধু বিরোধীরা বলছে না, তৃণমূলের ভিতর থেকে একথা শোনা যাচ্ছে যে, পুলিশ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হয়েছে৷ গোড়াতেই বিষয়টা সামলে নিলে তিনটে প্রাণ চলে যেত না৷"
পশ্চিমবঙ্গে রাজনৈতিক সহিংসতা ঘটে থাকে অহরহ৷ ধর্মীয় কারণে ব্যাপক অশান্তি খুব একটা দেখা যায় না৷ রাজনৈতিক বিশ্লেষক মইদুল ইসলাম ডিডাব্লিউকে বলেন, "পশ্চিমবঙ্গে সংখ্যালঘুরা নিজে থেকে এমন সহিংসতা করছে, এই উদাহরণ স্বাধীনতা পরবর্তী কয়েক দশকে নেই৷ এটা একটা নতুন প্রবণতা৷ সাম্প্রতিক অতীতে অবশ্য দেগঙ্গা, মালদা, ধূলাগড় এলাকায় বিক্ষিপ্ত কিছু ঘটনা ঘটেছে৷ মুর্শিদাবাদে যেখানে গণ্ডগোল হচ্ছে, সেখানে কোনো শক্তিশালী মুসলিম নেতৃত্ব নেই যারা জনতাকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন৷ এতে সংখ্যাগুরুর ভোট সংহত হবে, যার ফলে সুবিধা হবে বিজেপির৷ সব সংখ্যালঘুর ভোট তৃণমূল পাবে না৷ বাম ও কংগ্রেস কিছু ভোট পাবে৷ উল্টোদিকে যদি ভোট সংহত হয়, তাহলে বিজেপি উপকৃত হবে৷ তবে নয়া আইন অনুযায়ী ওয়াকফ বোর্ড যেভাবে গঠিত হবে, সেক্ষেত্রে অমুসলিমদের গুরুত্ব বেড়ে যেতে পারে, যাদের ওয়াকফ সম্পত্তির সঙ্গে কোনো যোগ নেই৷ এটা সংখ্যালঘু মানুষকে বিচলিত করেছে৷"
সাংবাদিক শুভাশিস মৈত্র ডিডাব্লিউকে বলেন, "মুর্শিদাবাদে সিএএ বিরোধী আন্দোলনের সময় ট্রেনে আগুন ধরানো হয়েছিল৷ এই দায় মুসলিমদের ঘাড়ে চাপানোর কোনো মানে নেই৷ আমার ধারণা, এ কাজ পরিকল্পিতভাবে কোনো সংগঠন করছে৷ যেভাবে ঘটনা ঘটছে, তার কতটা সুপরিকল্পিত, আর কতটা প্রতিবাদ, সেটার তদন্ত হওয়া উচিত৷"
ওয়াকফ বোর্ডের আওতাধীন জমিতে মুসলিম সম্প্রদায়ের মসজিদ, মাদ্রাসা, কবরস্থান, এতিমখানা রয়েছে৷ কেন্দ্রীয় রিপোর্ট অনুযায়ী, ভারতে এমন সম্পত্তির সংখ্যা আট দশমিক সাত লক্ষ৷ উত্তরপ্রদেশ সুন্নি ও শিয়া ওয়াকফ বোর্ডের হাতে সম্পত্তির পরিমাণ সবচেয়ে বেশি৷ সংখ্যালঘু মন্ত্রকের গত মাসের হিসেব অনুযায়ী, দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে এ রাজ্য৷ পশ্চিমবঙ্গে মোট ৮০ হাজার ৪৮০টি ওয়াকফ সম্পত্তি রয়েছে৷ এই সম্পত্তি রয়েছে ৮২ হাজার একরের বেশি জমির উপরে৷ ওয়াকফ সম্পত্তি ‘জবরদখলের' অভিযোগ উঠেছে একাধিক তৃণমূল নেতার বিরুদ্ধে৷ যদিও তা অস্বীকার করেছেন তারা৷