এক হাতে নতুন জীবনের কাহিনি লিখছেন রেণু খাতুন
৯ জুন ২০২২শিউরে ওঠার মতো ঘটনা পূর্ব বর্ধমানের কেতুগ্রাম। নার্সিংয়ের সরকারি চাকরি পেয়েছিলেন রেণু খাতুন। তিনি যাতে চাকরিতে যোগ দিতে না পারেন, সেই উদ্দেশ্যে স্ত্রীর হাত কেটে ফেলার পরিকল্পনা করে শের মহম্মদ ওরফে সরিফুল। ঘুমন্ত অবস্থায় বড় ধারালো কাঁচি দিয়ে কেটে ফেলে রেণুর হাত। দুই বন্ধুকে এই কাজে সঙ্গে নিয়েছিল সে। কব্জির উপর থেকে রেণুর হাত শরীর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। এই ঘটনায় প্রথমে রেণুর শ্বশুর ও শাশুড়িকে গ্রেফতার করে পুলিশ। পলাতক স্বামী শের মহম্মদকে পরে পাকড়াও করা হয়।
ঠিক কীভাবে এই ঘটনা ঘটিয়েছিল সরিফুল, তার ভয়াবহ বর্ণনা দিয়েছেন রেণু। তিনি বলেছেন, ‘ঘুমের মধ্যেই মনে হল দম বন্ধ হয়ে আসছে আমার। চোখ খুলে দেখি, মুখে বালিশ চাপা। আর একজন পা ধরে আছে। আমার স্বামী টিন কাটার বড় কাঁচি দিয়ে আমার কব্জির জায়গাটা কাটছিল। হাত খসে পড়ার পরও স্বামী মুখে বালিশ চাপা দিয়ে রেখেছিল।'
রেণু আট মাস আগেই চাকরিতে যোগ দেন। একটি বেসরকারি হাসপাতালে নার্স হিসেবে কাজ করছিলেন। ফলে বাড়ির বাইরে থাকতে হতো তাকে। মাসে একবার শ্বশুরবাড়ি আসতেন। সেই সময় থেকেই স্বামীর সঙ্গে রেণুর গন্ডগোলের সূত্রপাত বলে পরিবার সূত্রে খবর। শের মহম্মদ স্ত্রীকে সন্দেহ করতে শুরু করে। তার অন্য কোনও পুরুষের সঙ্গে সম্পর্ক আছে বলে ধারণা ছিল স্বামীর। দিন দশেক আগে রেণু সরকারি প্রতিষ্ঠানে নার্সের চাকরির নিয়োগপত্র পান। এর পরই স্ত্রীকে রোখার পরিকল্পনা করে স্বামী। দুই সঙ্গীকে নিয়ে ঘুমন্ত স্ত্রীর উপর হামলা চালায়।
এই ধরনের ঘটনার ক্ষেত্রে কাটা হাত জোড়া লাগানো যায় যদি ছিন্ন দেহাংশ ঠিকভাবে সংরক্ষণ করে হাসপাতালে আনা যায়। কাটার ঘণ্টা ছয়েকের মধ্যে
অংশটি দেহের সঙ্গে জুড়ে দিতে পারেন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক, সার্জনরা। অনেক ক্ষেত্রে আরো বেশি সময় পার হয়ে গেলেও জুড়ে দেওয়া সম্ভব। শনিবার রাতের ঘটনার পর দু'টি হাসপাতাল ঘুরে অনেক সময় নষ্ট হয়ে যায় বলে রেণুর হাত জোড়া দেওয়া যায়নি।
ঘটনার বীভৎসতায় সকলে স্তম্ভিত। এ কী ধরনের মানসিক বিকার! মনোরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. কামাল হোসেন বলেন, ‘মানসিকভাবে কেউ অসুস্থ না হলে এ ধরনের ঘটনা ঘটায় না। স্ত্রীকে নিজের আয়ত্তে রাখার আকাঙ্খা স্বাভাবিক মানসিকতার পরিচয় নয়। দিনের পর দিন স্ত্রীকে হারানোর ভীতি থেকে এই সমস্যা তৈরি হয়েছে।' বুধবার আদালতে হাজিরার সময় সেরাফুল দাবি করেছে, সে স্ত্রীকে খুবই ভালবাসে। রাগের বশে এই কাজ করেছে। এতে তাদের দু'জনের জীবন শেষ হয়ে গিয়েছে বলে আক্ষেপ করেছে অভিযুক্ত।
প্রশ্ন উঠছে, নিছক হত্যা নয়, হাত কেটে ফেলার পিছনে কি পুরুষতন্ত্রের দখলদারি বজায় রাখার মানসিকতা নেই? সেই দৃষ্টিকোণ থেকে একে মনোবিকার বলতে রাজি নন অধ্যাপক, সমাজকর্মী শাশ্বতী ঘোষ। তাঁর মতে, ‘মনোবিকার বললে অপরাধকে লঘু করে দেখানো হবে। অভিযুক্ত যথেষ্ট ধূর্ত বলে কাটা হাত ইচ্ছা করে সরিয়ে রেখেছিল। রেণুর সার্টিফিকেটও লুকিয়ে রেখেছিল। মুখে বালিশ চাপা দিয়ে খুনের চেষ্টা করেছিল। হাত কাটার ফলে রক্তক্ষরণে মৃত্যুও হতে পারতো। এটা পরিকল্পনামাফিক ঘটনা, ক্ষণিকের ঝোঁকে হয়ে যাওয়া ঘটনা নয়।'
এ সবই এখন অতীত। ইতিমধ্যে ঘুরে দাঁড়ানোর লড়াই শুরু করেছেন রেণু। নার্সিংহোমে বসে বা হাতে লেখার অভ্যাস করছেন তিনি। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় লড়াকু তরুণীর পাশে দাঁড়ানোর আশ্বাস দিয়েছেন। সরকারি চাকরির নার্সিং প্যানেলে ২২ নম্বরে নাম ছিল রেণুর। তাকে সরকারি চাকরি দেওয়ার ঘোষণা করেছেন মুখ্যমন্ত্রী। নার্সিংয়ের কাজ যদি এক হাতে রেণু করতে না পারেন, তা হলে অন্য কাজ তাকে দিয়ে করানো হবে। তার জন্য কৃত্রিম হাতের ব্যবস্থা করা হবে বলে জানিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী। নার্সেস ইউনিটি-র সম্পাদক ভাস্বতী মুখোপাধ্যায় জানিয়েছেন, তাদের সংগঠন তরুণীর পাশে থাকবে। নিজের একটি হাত হারিয়ে নতুন লড়াইয়ে নামা রেণু খাতুন এখন বাংলার সেরা আইকন।