এক 'আনন্দহীন' শিক্ষক দিবস পশ্চিমবঙ্গে
৫ সেপ্টেম্বর ২০২৫২০১৬ সালের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার পরে চাকরি পেয়েছিলেন শিক্ষকরা। তার নয় বছর বাদে ফের পরীক্ষায় বসতে হচ্ছে তাদের। নবম–দশম ও একাদশ–দ্বাদশে শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষা সাত ও ১৪ সেপ্টেম্বর। ঠিক তার আগেই, শুক্রবার শিক্ষক দিবস উদযাপন। ভারতের সাবেক রাষ্ট্রপতি সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণনের স্মরণে এই দিনটি পালন করা হয় দেশজুড়ে। প্রতি বছর শিক্ষক দিবস পালিত হয় হইহই করে, এবার যেন সেই আবেগে ভাটা পড়েছে।
চাকরি বাতিলের পরে
২০১৬ সালের এসএসসির নিয়োগ প্যানেল নিয়ে দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছিল। সেই মামলা হাইকোর্ট থেকে পৌঁছে যায় সুপ্রিম কোর্টে। চলতি বছরের তিন এপ্রিল শীর্ষ আদালতের রায় বাতিল হয়ে যায় ২৬ হাজার শিক্ষক ও অশিক্ষক কর্মীদের চাকরি। যোগ্য শিক্ষকরা ডিসেম্বর অবধি পড়ানোর সুযোগ পাবেন। জানুয়ারিতে তাদের স্কুলে ফিরতে হলে আর একবার পরীক্ষায় পাশ করতে হবে।
ইতিমধ্যেই সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে দাগি শিক্ষকদের নামের তালিকা কমিশন প্রকাশ করেছে। সেই তালিকায় যারা নেই, তাদেরও বসতে হবে পরীক্ষায়। যদি এই পরীক্ষায় সফলভাবে পাশ করতে না পারেন, তাহলে শিক্ষকতার চাকরি খোয়াতে হবে। শিক্ষকদের কাছে এবারের পাঁচ সেপ্টেম্বর একেবারেই নিরানন্দের।
শিক্ষক দিবসে তাই হতাশার কথা শোনালেন নদিয়ার রানাঘাটের হাজরাপুর হাইস্কুলের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের শিক্ষক দেবাশিস অধিকারী। তিনি ডিডাব্লিউকে বলেন, "প্রতি বছরের শিক্ষক দিবসের তুলনায় এবারের দিনটা আমাদের কাছে অন্ধকার। ডিসেম্বর অবধি আছি, তারপরে পরীক্ষায় পাশ করতে পারব কিনা জানি না। ১০ বছর পরে নতুন প্রজন্মের পরীক্ষার্থীদের সঙ্গে পরীক্ষায় বসাটাই তো অন্ধকারাচ্ছন্ন দিক আমাদের কাছে।"
প্রায় প্রত্যেক শিক্ষকের জীবন অভূতপূর্ব সংকটের সামনে। দেবাশিস বলেন, "চাকরি পাওয়ার পরে ঋণের মাধ্যমেই আমরা যা কিছু করেছি। আমার অনেক ঋণ মেটানো বাকি আছে। জানি না ব্যাংক আমার বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা নেবে। নাবালক ছেলে, বৃদ্ধ মা-বাবার ভবিষ্যৎ নিয়ে শঙ্কিত। এসএসসির চাকরি পরীক্ষা উচ্চবিত্ত বাড়ির ছেলেমেয়েরা সাধারণত দেয় না। আমাদের মত নিম্নবিত্ত, মধ্যবিত্তরাই দেয়। আমাদের দোষ ছিল যে, আমরা ফর্ম ফিলআপের ২৪০ টাকা দিয়ে পরীক্ষায় বসেছি, এর বেশি সরকারকে দিতে পারিনি। আমরা সিস্টেমের কাছে হেরে গেলাম।"
নিজেকে হতভাগা শিক্ষক বলে পরিচয় দিলেন মালদা জেলার সালাইডাঙ্গা হাইস্কুলের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের শিক্ষক পঙ্কজ রায়। তিনি ডিডাব্লিউকে বলেন, "অনশন করে, মিছিল করে সব আন্দোলনে অংশ নিয়েও ব্যর্থ হয়েছি। আমি তফসিলি সম্প্রদায়ের মানুষ। আমার বাবা গাড়িচালক। পরিবারের প্রথম প্রজন্ম হিসেবে আমি চাকরি পেয়েছিলাম। এখন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ না হলে পরিবার নিয়ে কোথায় দাঁড়াব জানি না। আগের কোনো পাঁচ সেপ্টেম্বর কল্পনা করিনি যে এমন একটা আশাহীন শিক্ষক দিবস দেখতে হতে পারে!"
আন্দোলনের দুই মুখ
বীরভূম নলহাটির মথুরা হাই স্কুলের বাংলার শিক্ষিকা সোমা দাস। ক্যান্সারের বিরুদ্ধে লড়াই করছেন তিনি। ২০১৬ সালে মেধা তালিকায় নাম থাকা সত্ত্বেও চাকরি হয়নি তার। আইনি লড়াইয়ের পরে আদালতের নির্দেশে সোমাকে নিয়োগ দিতে বাধ্য হয় স্কুল সার্ভিস কমিশন। এরই মধ্যে ২০১৯ সালে সোমার ক্যান্সার ধরা পড়ে। নলহাটির আশ্রমপাড়ার বাসিন্দা সোমা লড়াই থেকে পিছু হটেননি। সুপ্রিম কোর্ট ২০১৬ সালের প্যানেল বাতিল করে দিলেও একমাত্র সোমার চাকরি থেকে গিয়েছে মানবিক কারণে।
তাকে আর পরীক্ষায় বসতে হবে না। তার চাকরির মেয়াদ ডিসেম্বর পর্যন্ত নয়। তবু প্যানেলভুক্ত যোগ্য শিক্ষকদের জন্য সমব্যথী সোমা। পাঁচ সেপ্টেম্বর ছুটি বলে বৃহস্পতিবার তার স্কুলে শিক্ষক দিবস পালিত হয়েছে। তিনি বলেন, "কোনও রকমে স্কুলে দিনটি পালন করা হয়েছে। কারো মধ্যে কোনো উচ্ছ্বাস নেই। থাকার কথাও নয়। বিশেষ করে আমরা যে পরিস্থিতির মধ্যে রয়েছি। আমি চাইনি আমার চাকরি এইভাবে থেকে যাক। অনেক যোগ্য শিক্ষকের চাকরি চলে গিয়েছে।"
২০১৬ সালের প্যানেলে দাগি শিক্ষকরা অনেক যোগ্য চাকরিপ্রার্থীর ভবিষ্যৎ অন্ধকারে ঠেলে দিয়েছেন। মেধা তালিকায় থাকা প্রার্থীরা বাদ পড়ে গিয়েছেন। এই চাকরিপ্রার্থীদের আন্দোলন, অবস্থান চলছে দিনের পর দিন, মাসের পর মাস। তাদের অন্যতম মুখ হয়ে উঠেছেন রাসমণি পাত্র।
এক সন্তানের মা রাসমণি প্রতিবাদে নিজের চুল কেটে ফেলেছিলেন প্রকাশ্য রাজপথে। তার শিক্ষক হয়ে ওঠার স্বপ্ন এখন ঘোর অন্ধকারে ঢাকা। রাসমণি ডিডাব্লিউকে বলেন, "আমরা শিক্ষকদের দেখে অনুপ্রেরণা পেয়েছি। কিন্তু আমরা কাদের পথ দেখাব। পরীক্ষা দিয়ে মেধা তালিকায় জায়গা করে নেওয়ার পরেও আমরা সুবিচার পেলাম না। দুর্নীতি প্রমাণিত হল, কিন্তু তার জন্য আমাদের যে ক্ষতি হল, সেটার মূল্য কেউ দিল না। আমাদের বয়স বাড়ানো হল না, কোনো সুবিধাও দেওয়া হল না। বিচার ব্যবস্থার প্রতিও আস্থা হারিয়ে ফেলেছি। তবুও আশা ছাড়িনি। শিক্ষকতা হচ্ছে মানুষ তৈরির পেশা, সমাজ গড়ার পেশা। যারা শিক্ষক হতে পারেন, তারাই রাস্তায় নামতে বাধ্য হয়েছেন।"
প্রাথমিকের জন্য দুর্ভাবনা
মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক স্তরের মতো প্রাথমিকের শিক্ষক নিয়োগ নিয়েও মামলা চলছে। বছর দুয়েক আগে কলকাতা হাইকোর্টের সিঙ্গল বেঞ্চ বাতিল করে দেয় ২০১৬ সালের নিয়োগ প্রক্রিয়া। এর ফলে ৩২ হাজার শিক্ষকের নিয়োগে প্রশ্নচিহ্ন পড়ে গিয়েছে। এক্ষেত্রেও কি চাল ও কাঁকর আলাদা করা যাবে না, দুর্নীতির দায়ে যোগ্যদেরও চাকরি চলে যাবে? এ নিয়ে আশঙ্কায় রয়েছেন শিক্ষকরা।
কৌশিক সাঁতরা হাওড়ার বাগনান দক্ষিণ চক্রের রবিভাগ প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক। তিনি ডিডাব্লিউকে বলেন, "আমি যদি যোগ্য না হতাম তাহলে এতগুলো পরীক্ষায় পাশ করতাম কী করে? টেট তো একমাত্র পরীক্ষা নয়, এর আগে অনেক পরীক্ষা দিয়েছি। বেশ কিছুতে কোয়ালিফাই করেছি, কিন্তু অন্য কারণে চাকরি হয়নি। পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতি বলছে, বিচার যদি সত্যিকারের হত, তাহলে দোষীরা শাস্তি পেত!"
তার প্রশ্ন, "যাদের দাগি বলা হচ্ছে, তাদের ডেকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে না কেন? আমাদের ডাকা হয়নি কেন? আমি তো উত্তর দিতে পারতাম, আমার কাছে তথ্য মজুত রয়েছে। শিক্ষক দিবসে অন্তত এটুকু বুঝতে পারছি যে, পশ্চিমবঙ্গের পরবর্তী প্রজন্ম আর শিক্ষক হতে চাইবে না। যাদের আর্থিক অবস্থা ভাল, তারাই এই পেশায় আগামী দিনে আসবে। যোগ্যতার বিনিময়ে নয়, টাকা দিয়ে।"
এই পরিস্থিতি ব্যথিত, বিচলিত করছে শিক্ষাবিদ থেকে বিশিষ্টজনদের। রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য, শিক্ষাবিদ পবিত্র সরকার ডিডাব্লিউকে বলেন, "পশ্চিমবঙ্গে বিগত কয়েক বছর ধরেই শিক্ষক দিবস এরকম অন্ধকারে আচ্ছন্ন। প্রাইমারি, সেকেন্ডারি, কলেজ সব মিলিয়ে শিক্ষা ব্যবস্থাটা এমন বিপর্যস্ত যে শিক্ষক দিবস মানেই একটা অভিশপ্ত দিন।"
সাহিত্যিক স্বপ্নময় চক্রবর্তীর কাছে এবারের পাঁচ সেপ্টেম্বর কালা দিবস। তিনি ডিডাব্লিউকে বলেন, "বহু যুগ ধরে শিক্ষকদের পেশা ছিল সম্মানের। কিন্তু এখন জনমানসে সেই সম্মান ধুলোয় মিশে গিয়েছে। এর জন্য শিক্ষকরা দায়ী নন, দায়ী দুর্নীতি। আমার খুব খারাপ লাগছে। এই দিনটা কালা দিবস হয়ে থাকবে।"