বাসা থেকে তিনি বের হয়েছেন অফিসে যাওয়ার কথা বলে। অফিসে গেলেন নাকি গেলেন না, সেটা হয়তো অল্প সময় পরেই বের হয়ে যাবে। সবাই খোঁজ করবেন। এই খোঁজ করে যাতে দ্রুতই পেয়ে না যায়, সেজন্য মোবাইল ফোনটা পর্যন্ত বাসাতেই রেখে গেছেন। আজকাল মোবাইল ফোন রেখে কেউ ঘর থেকে বের হয় না, কিন্তু উনি হয়েছিলেন। এটা ভুলো মনের কারণে নয়, উনি আসলে সিদ্ধান্ত নিয়েই বের হয়েছিলেন! সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন—উনি আর ফিরবেন না। তাঁর এই চুড়ান্ত যাত্রায় কেউ যাতে বাধা না হতে পারে, তার সব ব্যবস্থা করেই বের হয়েছিলেন।
মুন্সিগঞ্জ যেতে যেতে, এই দুই তিন ঘণ্টায় কী চলছিল তার মনে? ওনার সবশেষ লেখা ‘খোলা চিঠি'টা পড়লে প্রাথমিকভাবে মনে হতে পারে—তিনি বুঝি অর্থকষ্টের কারণে মৃত্যুর পথ বেছে নিয়েছেন। আপাতদৃষ্টিতে এটা মনে হতেই পারে। তিনি বেতন পেতেন ৭৫ হাজার টাকা। চার জনের পরিবার। মেয়ে ডাক্তার, ছেলে ইঞ্জিনিয়ার। তারপরও চারজনের পরিবারের হিসাবে এই অর্থ হয়ত অপর্যাপ্ত। কিন্তু ঢাকা শহরের সকল সাংবাদিকের দিকে যদি তাকানো যায়, আপনি নিশ্চিত ভাবে জানবেন ৯০ শতাংশ সাংবাদিকের বেতন এর চেয়ে কম। আমি এমন অনেক সাংবাদিককে চিনি, যারা সংবাদ সংগ্রহের জন্য সারাদিন মাঠে-ঘাটে দৌড়াদৌড়ি করে, নিয়মিত সাপ্তাহিক ছুটিও পায় না, আর মাস শেষে তাদের বেতন দেওয়া হয় মাত্র ১৫ হাজার টাকা! এখানে একটু ভুল বললাম, আসলে দেওয়া হয় না, দেওয়ার কথা বলা হয়। দু-তিন মাস পর পর এক মাসের বেতন পান তারা। তাহলে তাদের সংসার চলে কীভাবে? সহজ উত্তর হচ্ছে—তারা অন্য ‘ধান্দা' করেন। করতে হয়। সাংবাদিক হিসাবে যে পরিচিতিটা অফিস তাকে দিয়েছে, সেটাকে ব্যবহার করে অন্য ‘ধান্দা' করেন। সেভাবে হয়ত দুএকজন বড় দাঁও মারতে পারেন, কিন্তু বেশির ভাগই মাসে ত্রিশ-চল্লিশের বেশি আয় করতে পারেন। সেটা দিয়েই চলে তাদের সংসার। সে হিসেবে বিভুরঞ্জন সরকারের সংসার চলতে পারার কথা ছিল। এ দিয়ে হয়ত অনেক সাচ্ছন্দ্য আসতো না, কিন্তু সংসার চলে যেতে পারতো। চলছিলও তো এত বছর।
আসলে আমার মনে হয়, বিভুদার সংকটটা ছিল অন্য জায়গায়। সংসারের গৃহকর্তা হিসাবে তার মনে যতটা অতৃপ্তি ছিল, তার চেয়ে অনেক বেশি ব্যর্থতা তিনি অনুভব করতেন সাংবাদিক হিসাবে। যা করতে চাইতেন, যা লিখতে চাইতেন—তা পারতেন না। আমার নিজের জীবনেও সেটা বারবার দেখেছি। দশটা লেখার প্রশংসা শুনে যতটা তৃপ্তি পেয়েছি, একটা লেখা প্রকাশ করতে না পারার বেদনা তার চেয়ে শতগুণ বেশি হয়ে হৃদয়ে বেজেছে। এই বেদনাটা আমাদের দেশের সাংবাদিকদের সিংহভাগের মধ্যেই আছে। এটাকে বুকে চেপে রেখেই অনেকে দিনের পর দিন কাজ করে যায়।
‘সাংবাদিকতার স্বাধীনতা' বলে একটা গালভরা কথা আছে। এটা আসলে কী, কোথায় দেখা যায়? আমি আমার জীবনে এই স্বাধীনতার যতটুকু উপভোগ করেছি, সেটা চাকরি থেকে অবসর নেওয়ার পর। ২০২২ সালের অক্টোবরে আমি কিছুটা ঘোষণা দিয়েই সাংবাদিকতার চাকরি থেকে অবসর নিয়েছি। বলেছি—সাংবাদিকতা করবো, কিন্তু সাংবাদিকতার চাকরি আর করবো না। সাংবাদিকতা আর সাংবাদিকতার চাকরি—এই দুইয়ের মধ্যে যে কী বিপুল দূরত্ব, সেটা আমাদের মিডিয়া জগতের মতো এত কঠিনভাবে হয়ত আর কোথাও দেখা যায় না। একজন সাংবাদিক তিনি যত মেধাবীই হোন না কেন, তিনি তার প্রতিষ্ঠানের চাহিদার বাইরে যেতে পারবেন না। লক্ষ্য করবেন, আমি কিন্তু ‘চাহিদা' বলেছি, ‘পলিসি' বলিনি। সারা দুনিয়াতেই মিডিয়াগুলোর একটা পলিসি থাকে। সিএনএন এবং ফক্স টিভির পলিসি এক নয়। আবার সেই পলিসি গোপন কিছুও নয়, পাঠক বা দর্শকরা পলিসির বিষয়টি জেনেই তাদের খবর পড়ে বা দেখে। কিন্তু আমাদের এখানে পলিসির বিষয়টা খুবই অদ্ভুত। এখানে পলিসিটা মালিকের চাহিদায় রূপান্তরিত হয়ে যায়।
মালিকের দশটা ব্যবসায় থাকে, প্রতিটি ব্যবসায়ের চাহিদা অনুযায়ী পত্রিকাটিকে চলতে হয়। বর্তমানে প্রপার্টি ডেভেলপারদের মিডিয়া অনেক বেশি। তাই তাদের মালিকানাধীন পত্রিকাগুলোতে প্লট বা ফ্ল্যাট ব্যবসায়ের দুর্নীতি নিয়ে তেমন নিউজ হয় না। কখনো কখনো প্রতিদ্বন্দ্বী কোনো ব্যবসায়ীর সঙ্গে বিরোধ তৈরি হলে, তখন কেবল টার্গেট করার ওই একটি প্রতিষ্ঠানের অনিয়ম বা প্রতারণা নিয়েই নিউজ হয়। আবার বিরোধ মিটে গেলে, আপোষ হলে, তখন নিউজ বন্ধ হয়ে যায়।
আমার চাকরিজীবনের শেষ দিকের একটা অভিজ্ঞতা বলি। একটা প্রতিষ্ঠানের উপরের দিকে একটা পদে যোগ দিয়েছি। একেবারে শুরুর দিকেই আমার হাতে একটা চিরকুট ধরিয়ে দেওয়া হলো। সেখানে পনের কুড়িটা প্রতিষ্ঠান ও বিষয়ের নাম লেখা। বলা হলো—এইসব প্রতিষ্ঠান সংশ্লিষ্ট কোনো নিউজ যেন প্রকাশিত না হয়! আমি বিস্মিত হলাম, বললাম—তাহলে আর থাকলো কী? আমাকে বলা হলো—এ তো গেল প্রাথমিক তালিকা। এটা ক্রমশ বড় হতে থাকবে। কিছুদিন পর একটা বিচিত্র অভিজ্ঞতা হলো। একটা বেশ বড় স্ক্যান্ডাল বা দুর্নীতির ঘটনা প্রকাশিত হলো। সব পত্রিকায় নিউজ হলো, আমাদেরও হলো। কিন্তু তারপরই পাল্টে গেল পরিস্থিতি। যে প্রতিষ্ঠানটি সেই দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত বলে সবগুলো মিডিয়া লিখেছিল, আমরাও লিখেছি, আদেশ হলো—এখন তার উল্টোটা লিখতে হবে। অর্থাৎ ওই প্রতিষ্ঠানের পক্ষে লিখতে হবে। কারণটা আরো বিচিত্র, ওই প্রতিষ্ঠানের মালিক নাকি আমাদের মিডিয়ার মালিকের স্ত্রীর বান্ধবী!
আসলে সাংবাদিকতার স্বাধীনতা বলে কিছু নেই এদেশে। এখানে আছে মালিকের স্বাধীনতা। মালিক যেভাবে চাইবে, সেভাবেই কাজ করতে হবে। অনেকটা দাসের মতো, লাঠিয়ালের মতো। জমিদার আমলের লাঠিয়ালরা কিন্তু অনেক বেশি কিছু বেতন পেতো না। কিন্তু তাদের হাতে যে লাঠিটা তুলে দেওয়া হতো, সেটার অপব্যবহার করে সে বেশ বিলাসী হালেই চলতে পারতো। বর্তমান সময়ে চরিত্রটা পাল্টায়নি, পরিবর্তন হয়েছে কেবল চেহারার। লাঠির বদলে তুলে দেওয়া হয়েছে কলম, বুম, ক্যামেরা কিংবা কম্পিউটারের কিবোর্ড। মালিকের প্রতিষ্ঠানকে নিরাপত্তা দেওয়ার জন্য, কিংবা প্রতিপক্ষের প্রতিষ্ঠানকে ঘায়েল করার জন্য এসব হাতিয়ার ব্যবহৃত হয়ে থাকে। যে যত কৌশলী ও কার্যকরভাবে একাজ করতে পারে, সে হয়ে ওঠে প্রতিষ্ঠানের জন্য তত বেশি গুরুত্বপূর্ণ। তার বেতন-ভাতা, সুযোগ-সুবিধা ততটাই বেশি হয়। বিভুরঞ্জন সরকার ঠিক ততটুকুই বেতন ভাতা পেতেন, যতটা তিনি মালিকের কাছে গুরুত্বপূর্ণ হতে পেরেছিলেন। আপনি কত বড় সাংবাদিক, নিউজটা কত ভালো বোঝেন, কত ভালোভাবে সেটাকে প্রকাশ করতে পারেন, কিংবা নিজে কত ভালো লিখতে পারেন— এসব গুরুত্বপূর্ণ নয় আপনার বেতন ভাতা নির্ধারণের ক্ষেত্রে। মালিক দেখবে—আপনি তার জন্য কতটা ব্যবহারযোগ্য। সে আপনাকে যত বেশি কার্যকরভাবে ব্যবহার করতে পারবে, তার কাছে তত বেশি গুরুত্ব আপনি পাবেন। ঠিক এ কারণেই আমাদের দেশের মিডিয়াগুলোতে দেখা যায় উপরের স্তরের সঙ্গে নিচের স্তরের সাংবাদিকদের বেতন-ভাতার আকাশ পাতাল পার্থক্য।
কেবল বিভুরঞ্জন সরকারই নয়, আরো একজন প্রথিতযশা সাংবাদিক- মিনার মাহমুদের নাম এখানে উল্লেখ করা যায়। এরশাদের সামরিক শাসনামলে বিচিন্তা নামে একটা সাপ্তাহিক ম্যাগাজিন প্রকাশ করে তিনি রীতিমতো আলোড়ন সৃষ্টি করেছিলেন। আপোষহীন সাংবাদিক হিসাবে তখন তার একটা পরিচিতি তৈরি হয়েছিল। এক সময় দেশ ছেড়ে যুক্তরাষ্ট্রে চলে যান। সেখানে বেশ কয়েক বছর থাকার পর আবার সাংবাদিকতা করতেই ফিরে আসেন দেশে। তবে যে প্রত্যাশা নিয়ে তিনি ফিরেছিলেন, তার কিছুই পূরণ হয়নি। এসে দেখেন অনেক কিছুই পাল্টে গেছে। মানুষের চক্ষুলজ্জা আরো অনেক কমে গেছে। দালালি আর মোসাহেবী আগে হতো কিছুটা রাখঢাক করে, এখন সেটা হচ্ছে প্রকাশ্যে, বুক ফুলিয়ে। দেশে এসে তিনি বিভিন্ন জায়গায় চাকরির চেষ্টা করলেন, রেখে যাওয়া সেই বিচিন্তা আবারও প্রকাশের চেষ্টাও করলেন। কোনোটাই ক্লিক করলো না, ব্যাটে-বলে হলো না। অনেকে যেন সেটাই চাচ্ছিলেন। চাচ্ছিলেন—মিনার মাহমুদ ব্যর্থ হোন। সাংবাদিক মিনার মাহমুদ সেই ব্যর্থতাকে নিতে পারেননি, আত্মহত্যার মাধ্যমে ব্যক্তি মিনার মাহমুদকেও পৃথিবী থেকে সরিয়ে নিয়েছেন।
লেখাটা শেষ করবো অতি সাম্প্রতিক একটা ঘটনার কথা বলে। গত বৃহস্পতিবার (২৮ আগস্ট) ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে একটা গোলটেবিল বৈঠক ছিল। মুক্তিযোদ্ধাদের সমন্বয়ে গঠিত ‘মঞ্চ ৭১' নামের একটা সংগঠনের ব্যানারে। আলোচনার বিষয় ছিল ‘আমাদের মহান স্বাধীনতা যুদ্ধ এবং বাংলাদেশের সংবিধান।' সেখানে খ্যাতিমান মুক্তিযোদ্ধা, আইনের শিক্ষক, সাংবাদিকসহ অনেকেই ছিলেন। ‘জুলাই যোদ্ধা' নাম নিয়ে কতিপয় ব্যক্তি বৈঠক চলাকালে সেখানে ঢুকে নানা রকম আক্রমণাত্মক ও অশ্লীল শ্লোগান দেয়। কয়েকজনকে তারা শারীরিকভাবে হেনস্তাও করে। ভণ্ডুল হয়ে যায় বৈঠক। এক পর্যায়ে পুলিশ আসে। তারা মব সৃষ্টিকারীদেরকে নয়, উল্টো মবে আক্রান্তদেরকে আটক করে নিয়ে যায়। শুরুতে বলা হয় তাদেরকে নিরাপত্তা দিতেই নাকি তারা এরকম করেছে। পরে দেখা গেল আটককৃতদের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসবিরোধী আইনে মামলা করা হয়েছে! পুলিশ কর্তৃক অভিযুক্তদের মধ্যে এই সময়ের আলোচিত সাংবাদিক মঞ্জুরুল আলম পান্নাও ছিলেন। পান্না কী অপরাধ করেছে? মুক্তিযোদ্ধাদের ডাকা অনুষ্ঠানে অতিথি হিসাবে যাওয়া কি অপরাধ? আসলে পান্নার অপরাধ হচ্ছে মুক্তযুদ্ধের পক্ষে কথা বলা, অন্যায়ের বিরুদ্ধে কথা বলা। কিন্তু আমার বক্তব্য অন্য জায়গায়। এই যে পান্নার বিরুদ্ধে সন্ত্রাসবিরোধী আপরাধের মামলা করা, দেশের সাংবাদিকরা কি এর প্রতিবাদ করবে? এখন পর্যন্ত তেমন কিছু দেখতে পাচ্ছি না। বলা হয়ে থাকে, বর্তমানে দেশের সাংবাদিকরা নাকি এখন অনেকটাই রাজনীতি প্রভাবিত। এ প্রবণতা শুরু হয়েছে আরো কয়েক দশক আগে থেকেই। বর্তমানে এর চরম রূপ দেখা যাচ্ছে।
একজন সাংবাদিকের প্রধানতম কাজ হচ্ছে ক্ষমতাকে প্রশ্ন করা। সেই প্রশ্নটা কি এখন করা যাচ্ছে? এর বিপরীতে এখন যা কিছু চলছে, তার উদ্দেশ্যটা আসলে কী? নাকি উদ্দেশ্যহীনভাবেই চলছে? আমরা কেউ কি সাংবাদিকতা করছি, নাকি কেবলই একটা মিডিয়া হাউজে চাকরি করছি? প্রশ্ন করছি, নাকি প্রতিনিয়ত আপোষ করছি? বিভুরঞ্জন সরকার বা মিনার মাহমুদরা আপোষ করতে চাননি, সাহসী ছিলেন, নিজেদের অস্তিত্বকেই সরিয়ে নিয়েছেন। আমরা অতটা সাহসী নই। তাই প্রতিনিয়ত আপোষ করে কাপুরুষের মতো টিকে থাকার চেষ্টা করি। আমরা টিকে আছি, কিন্তু বেঁচে কি আছি?
মাঝেমধ্যে মনে হয়, এই আমার ৩৬ বছরের সাংবাদিকতা জীবন, এটা বুঝি উদ্দেশ্যহীন যাত্রাতেই কেটে গেল!