উত্তরাঞ্চলে গ্যাসহীন তিন দিনের প্রস্তুতি
১৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ওইসব এলাকায় গ্যাস সংযোগ অনেক কম থাকলেও যাদের আছে তার বিপাকে পড়ছেন৷ ওই এলাকায় এরই মধ্যে সিলিন্ডার গ্যাসের দাম বেড়ে গেছে৷ কেউ কেউ তিন দিনের খাবার এক সঙ্গে রান্না করে ফ্রিজে রেখে তিন দিন কোরোসিনের চুলা, হিটার বা অন্য কোনো উপায়ে গরম করে খাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন৷ আর যেসব শিল্প কারখানায় গ্যাস সংযোগ আছে, বিকল্প ব্যবস্থা না থাকায় তারা কারখানা বন্ধ রাখবেন বলে জানা গেছে৷
সিরাগঞ্জের হাটিকুমরুল এলাকায় গ্যাস সঞ্চালন লাইন প্রতিস্থাপন কাজের জন্য পশ্চিমাঞ্চল গ্যাস কোম্পানি লিমিটেড (পিজিসিএল)-এর আওতায় ওই জেলাগুলোর গ্রাহকরা ওই তিন দিন গ্যাস পাবেন না৷
পিজিসিএল-এর মহাব্যবস্থাপক (বিপনন) প্রকৌশলী শৈলজানন্দ বসাক ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘গ্যাস লাইন প্রতিস্থাপনের কাজ করবে গ্যাস ট্রান্সমিশন কোম্পানি (ডিটিসিল) তাদের কাছ থেকে আমরা গ্যাস নিয়ে বিতরণ করি৷ রোডস অ্যান্ড হাইওয়েজ-এর ডিমান্ডে গ্যাস লাইন শিফটিংয়ের এই কাজ হবে৷ ওখানে সড়ক উন্নয়নের কাজ হবে৷’’
পিজিসিএল-এর জনসংযোগ বিভাগের ব্যবস্থাপক মো. কাওছার আহমেদ জানান, ‘‘ওই এলাকায় গ্যাস ট্রান্সমিশন লাইনের ১.৩২ কিলোমিটার এলাকায় গ্যাস ট্রান্সমিশন লাইনের ৩০ ইঞ্চি পাইপ লাইন প্রতিস্থাপন করা হবে৷’’
তিনি বলেন, ‘‘আমরা আমাদের গ্রাহকদের নোটিশ ও পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি দিয়ে ওই তিনদিন যে গ্যাস থাকবে না তা জানিয়ে দিয়েছি৷ মাইকিংও করা হচ্ছে৷ আমাদের কাছে কোনো বিকল্প ব্যবস্থা নাই৷ গ্রাহকদেরই এই তিন দিনের ব্যবস্থা করতে হবে৷ তবে পাইপলাইনে কিছু গ্যাস থাকে৷ তা দিয়ে গৃহস্থালির রান্নার কাজে হয়তো কিছু গ্যাস পাওয়া যেতে পারে৷’’
আওতাভুক্ত এলাকা ও গ্রাহক
পিজিসিএল-এর গ্যাস সরবরাহের আওতাভুক্ত এলাকাগুলো হলো রাজশাহী সিটি কর্পোরেশন,সিরাজগঞ্জ জেলা,সিরাজগঞ্জ সদর উপজেলা, উল্লাপাড়া উপজেলা,শাহজাদপুর উপজেলা, পাবনা জেলা, পাবনা সদর উপজেলা, বেড়া উপজেলা,সাঁথিয়া উপজেলা,ঈশ্বরদী উপজেলা,বগুড়া জেলা,বগুড়া সদর উপজেলা ও শাজাহানপুর উপজেলা
পিজসিএলএর ওয়েবসাইটের তথ্য মতে, তাদের মোট গ্রাহক এক লাখ ২৯ হাজার ৪১১৷ তার মধ্যে ১০টি বিদ্যুৎ কেন্দ্র, ৫৩ টি ক্যাপটিভ পাওয়ার, ৩১টি সিএনজি স্টেশন, ১৩৩টি শিল্প প্রতিষ্ঠান, ৩৩২টি বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান ও এক লাখ ২৮ হাজার ৮৫২ আবাসিক গ্রাহক রয়েছে৷
ফলে ওই সময়ে উত্তরাঞ্চলের জেলাগুলোতে বিদ্যুৎ উৎপাদন ও শিল্প উৎপাদনও ব্যাহত হবে৷ সিএনজি স্টেশনগুলোতে গ্যাস থাকবে না, এ কারণে জিএনজি চালিত যানবাহনের জন্য সমস্যা হবে৷ আবাসিক গ্রাহকদেরও বিকল্প ব্যবস্থায় রান্নাবান্না করতে হবে৷
কারখানা বন্ধ
রাজশাহী চেম্বার অ্যান্ড কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাষ্ট্রির সভাপতি মাসুদুর রহমান রিংকু বলেন, ‘‘রাজশাহীসহ উত্তরাঞ্চলের জেলাগুলোতে শিল্প গ্যাস আসলে নাম মাত্র৷ শহরে সিএনজি স্টেশন আছে মাত্র একটি৷ তাও গ্যাসের অভাবে প্রায়ই বন্ধ থাকে৷ তারা যে সংখ্যা জানাচ্ছে ওগুলো কানেকশনের হিসাব৷ কিন্তু বাস্তবে গ্যাস দেয়া হয়নি৷ এসিআই'র একপি শিল্প গ্যাসে চলে তা-ও ঠিকমতো পায় না৷ আর এই তিন দিনে অল্প কয়েকটি শিল্প কারখানা, যাদের গ্যাস আছে, সেগুলো বন্ধ রাখতে হবে৷ বিকল্প কোনো ব্যবস্থা নাই৷’’
সিরাজগঞ্জের লাবলু বাবলু কম্পোজিট টেক্সটাইল মিলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক তোফাজ্জল হোসেন বাবলু বলেন, ‘‘আমাদের কোনো বিকল্প ব্যবস্থা নাই৷ ওই তিনদিন আমাদের কারাখানা বন্ধ থাকবে৷ আমার জানা মতে, আরো যে কয়েকটি কারখানায় গ্যাস সংযোগ আছে, তাদেরও বন্ধ রাখতে হবে৷ তাদেরও বিকল্প কোনো ব্যবস্থা নাই৷’’
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘‘তিন দিনে ক্ষতি হবে৷ শ্রমিক কর্মচারীদের বসিয়ে বেতন দিতে হবে৷ অর্ডার ফেল করবে৷ কিন্তু আমাদের তো কিছু করার নেই৷’’
সিলিন্ডার গ্যাসের দাম বাড়ছে
ঈশ্বরদীর মোতাহেরা জাহান লাবনী বলেন, ‘‘আমি কিছু খাবার রান্না করে এরইমধ্যে ফ্রিজে রেখেছি৷ পরে গরম করে আমরা খাবো৷ তবে তিন দিনের খাবার রান্না করে রাখা কঠিন৷’’
তার কথা, ‘‘গ্যাস লাইন থাকায় আমরা সিলিন্ডার গ্যাসও ব্যবহার করি না৷ আর সিলিন্ডারের চুলাও আলাদা৷ তিনদিনের জন্য অত টাকা খরচ করে সিলিন্ডার আর চুলা কেনা সম্ভব নয়৷ খুব সমস্যা হলে আত্মীয়-স্বজন যারা সিলিন্ডার গ্যাস ব্যবহার করে তাদের বাসায় চলে যাব তিনদিনের জন্য৷’’
পাবনা শহরের পবন আহমেদ বলেন, ‘‘আজকেই আমি সিল্ডিলন্ডার এবং চুলা কিনে এনেছি৷ এরই মধ্যে ১২ কেজি সিলিন্ডারের দাম ২০০ টাকা করে বেড়ে গেছে৷ চুলা, সিলিন্ডার মিলিয়ে আমার সাড়ে পাঁচ হাজার টাকা খরচ হয়েছে৷ তিন দিনের জন্য এই টাকা খরচ করতে বাধ্য হয়েছি, নয়তো রান্নাবান্না বন্ধ থাকবে৷’’
তিনি জানান, ‘‘আমার ছয় তলা বাড়ি৷ আরো যারা ভাড়াটিয়া আছেন তারাও একইভাবে সিলিন্ডার চুলা কিনে আনছেন৷ এছাড়া উপায় নেই৷''
সিলিন্ডার-নির্ভর উত্তরাঞ্চল
রাজশাহী শহরের সাদিয়া গ্যাস বিতানের সাইফুল ইসলাম শ্যামল বলেন, ‘‘রাজশাহীসহ উত্তরাঞ্চলে গ্যাস সংযোগ সামান্যই আছে৷ শহরে ১২ হাজারের মতো বাড়িতে গ্যাস লাইন আছে৷ এই অঞ্চলের অধিকাংশ পরিবারই সিলিন্ডার গ্যাস ব্যবহার করেন রান্নার কাজে৷’’
তিনি এক প্রশ্নের জবাবে বলেন, ‘‘আমি রাজশাহী শহরে প্রতি মাসে ৫০০ সিলিন্ডার বিক্রি করি৷ কেউ দুই হাজারও বিক্রি করেন৷ সিলিন্ডার বিক্রির আড়াইশ দোকান আছে৷’’
প্রতি দোকান মাসে গড়ে এক হাজার সিলিন্ডার বিক্রি করলে রাজশাহী শহরে মাসে দুই লাখ ৫০ হাজারটির মতো গ্যাস সিলিন্ডার বিক্রি হয়৷ ১২ কেজি সিল্ডিারের দাম এখন এক হাজার ৫০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে৷ বাসবাড়িতে রান্নার কাজে ১২ কেজি সিলিন্ডারেরই চাহিদা বেশি৷ ৩৫-৪৫ কেজির সিলিন্ডারও আছে৷ সেগুলোর চাহিদা হোটেল-রেস্টুরেন্টে বলে জানান তিনি৷ তিনি বলেন, ‘‘তিন দিন গ্যাস থাকবে না- এ খবরে সিলিন্ডারের চাহিদা কিছুটা বেড়েছে৷'' তবে দাম বাড়ানোর অভিযোগ অস্বীকার করেন তিনি৷
জাতীয় ভোক্তা সংরক্ষণ অধিদপ্তরের হিসেবে সবচেয়ে বেশি চাহিদার ১২ কেজি সিলিন্ডার সারাদেশে মাসে ৯০ লাখ বিক্রি হয়৷ আর এলপিজি ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন বলছে, দেশে মাসে এক লাখ ২০ হাজার টনের বেশি এলপিজির চাহিদা আছে৷
বসুন্ধরা এলপিজির হেড অব মর্কেটিং জাকারিয়া জালাল জানান, ‘‘দেশে পাঁচ কোটি সিলিন্ডার আছে৷ এর মধ্যে মাসে ৯০ লাখ থেকে এক কোটি সিলিন্ডার গ্যাস বিক্রি হয়৷’’
তিনি বলেন, ‘‘উত্তরাঞ্চলে গ্যাস সংযোগ কম৷ পশ্চিমাঞ্চল গ্যাস কোম্পানি লিমিটেড গ্যাস পায় অনেক কম৷ তাই তারা সংযোগ দিতে পারে না৷ তাই ওই অঞ্চলে যারা রান্নার গ্যাস ব্যবহার করেন, তাদের অধিকাংশই সিলিন্ডার গ্যাস ব্যবহার করেন৷ সিলিন্ডার গ্যাসের ওটা বড় মার্কেট৷’’
তিনি জানান, ‘‘আমার কাছে যে হিসাব আছে তাতে সারাদেশের চাহিদার মধ্যে উত্তরাঞ্চলে, যমুনা ব্রিজের পর থেকে রংপুর পর্যন্ত মাসে সিলিন্ডারের চাহিদা ১৮ থেকে ২০ শতাংশ, অর্থাৎ, ১৮-২০ লাখ সিলিন্ডার বিক্রি হয়৷’’ তিনি মনে করেন, ‘‘যেহেতু উত্তরাঞ্চলে খুব কম পরিবার পাইপ লাইনের গ্যাস ব্যবহার করে, তাই এই তিন দিন ভোগান্তিও কম মানুষের হবে৷’’