উগ্রবাদ ও নারীবিদ্বেষী তৎপরতা মাথাচাড়া দিয়ে ওঠার চেষ্টা
২১ মার্চ ২০২৫তারা নিজেদের এই পরিবর্তনের অংশীদার দাবি করে তাদের চিন্তা এবং মতবাদ চাপিয়ে দিতে চাইছেন৷ তারা প্রধানত তৌহিদী জনতার ব্যানার ব্যবহার করছেন৷
সাভারে টিকটকার হৃদয় খানকে পুলিশ আটক করে ১০ মার্চ৷ তিনি মানসিক ভারসাম্যহীন সেজে লাঠি হাতে নারীদের বোরখা ও হিজাব পরার উপদেশের প্রাঙ্ক ডিডিও ছেড়েছিলেন৷ ব্যাপক সমালোচনার মুখে তাকে যখন পুলিশ আটকের জন্য খুঁজছিল তখন তিনি আরেকটি ভিডিও সামাজিক মাধ্যমে ছাড়েন৷ সেখানে তিনি নিজেকে জুলাই আন্দোলনের একজন হিসাবে দাবি করে তার কাজকে বৈধতা দেয়ার চেষ্টা করেন৷ তিনি বলেন, ‘‘পর্দা করার উপদেশ দিয়ে আমি কোনো ভুল করিনি৷''
মানবাধিকার কর্মী নূর খান তার নিজের অভিজ্ঞতার কথা জানিয়ে বলেন, ‘‘কয়েকদিন আগে আমি লালমাটিয়া এলাকায় দেখলাম একজন সঙ সেজে মানুষকে হ্যান্ড মাইকে মাস্ক পরার কথা বলছে৷ নারীদের ওড়না ছাড়া বাইরে আসতে নিষেধ করছে৷ আমি তো একজনকে দেখেছি৷ এরকম আরো অনেকে তৎপর বলে আমার কাছে খবর আছে৷ তার মানে হচ্ছে উগ্রবাদীরা কৌশলে তাদের অবস্থান তৈরি করতে চায়, নারীবিদ্বেষ ছড়ায়৷''
তিনি বলেন, ‘‘বিভিন্ন ওয়াজ মাহফিলে পর্দার নামে নারীর শরীর বর্ণনা করে নারীবিদ্বেষ ছাড়ানো হচ্ছে৷ তা সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে দেয়া হচ্ছে৷ জোর করে তারা তাদের মতো ইসলামীকরণের চেষ্টা করছে৷ কিন্তু সরকার এখানে নির্বিকার৷ তাদের শক্ত হাতে দমন করা দরকার৷''
বাংলাদেশ ইসলামী আন্দোলনের যুগ্ম মহাসচিব মাওলানা গাজী আতাউর রহমান জানান, ‘‘কিছু লোক আছে ইসলামের নামে নারীদের নিয়ে ওয়াজের নামে কুরুচিপূর্ণ কথা বলেন৷ তারা ইসলামের জন্য ভালো কিছু করছেন না৷ সরকারের উচিত তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া৷ তাদের ভিন্ন কোনো উদ্দেশ্য আছে কিনা তাও দেখা দরকার৷''
তিনি বলেন, ‘‘ইসলামে যে পর্দার বিধান আছে সেটা ইসলাম যেভাবে বলে সেভাবে অনুসরণে উদ্বুদ্ধ করা যাবে৷ কিন্তু রাস্তাঘাটে এটা নিয়ে যা করা হচ্ছে সেটা মেনে নেয়া যায় না৷ কাউকে ওড়না পরানো, বোরখা পড়ানো-এই মোরাল পুলিশিং-এর কাজ কেউ কাউকে দেয়নি৷ মোরাল পুলিশিং আমাদের কাজ নয়৷ কারুর স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করা যাবে না৷''
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. ফাতেমা সুলতানা শুভ্রা বলেন, ‘‘কোনো কোনো ওয়াজের পুরাটাই নারীকে নিয়ে, কিন্তু দর্শক শ্রোতা পুরুষ৷ পুরুষ যা শুনতে চায় তা বলা হয়৷ ফলে জমজমাট ব্যবসা হয়৷''
বাংলাদেশে একসময় এই নারীবিরোধী ওয়াজ নিয়ন্ত্রণের সরকারিভাবে উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল৷ ইসলামিক ফাউন্ডেশনে বৈঠকও হয়েছিল আলেমদের নিয়ে৷ কিন্তু প্রভাবশালী কিছু ওয়াজেরিনের কারণে তা সফল হয়নি৷ আর ওই গোষ্ঠীটি চিহ্নিত হলেও তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি৷ এই নিয়ে ইসলামিক ফাউন্ডেশনের পরিচালক মাওলানা আনিসুজ্জামানের সাথে কথা বলতে চাইলে তিনি কথা বলতে রাজি হননি৷ কিন্তু তখন তিনি ওই উদ্যোগের সঙ্গে ছিলেন৷
প্রতিবাদকারীরা বিপদে
সম্প্রতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষার্থীকে ক্যাম্পাসে ওড়না ঠিক করার কথা বলে হেনস্তা করায় বিশ্ববিদ্যালয়েরই এক কর্মচারী আসিফ অর্ণবকে অভিযোগের ভিত্তিতে আটক করে পুলিশ৷ কিন্তু তাকে ছাড়িয়ে নিতে রাতে শাহবাগ থানা ঘেরাও করে তৌহিদী জনতা৷ থানা তাকে না ছাড়লেও তাকে আদালত থেকে জামিন দেয়া হয়৷ জামিনের পর তৌহিদী জনতা তাকে ফুলের মালা আর পাগড়ি আর হাতে পবিত্র গ্রন্থ দিয়ে বরণ করে নেয়৷ ছাত্রীটিকে সমঝোতায় বাধ্য করে ওই জামিনের ব্যবস্থা করা হয়৷ ওই শিক্ষার্থী এখন আর বাইরেও বের হতে পারছেন না৷ তার মোবাইল ফোনও বন্ধ পাওয়া যায়৷ তার এক বান্ধবী জানান, ‘‘ওই ঘটনার পর সে অনেকটা ট্রমায় ভুগছে৷ ভয়ে হল থেকে বাইরেও বের হতে চায় না৷ নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে রেখেছে৷'' আর বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এখনো ঐ কর্মচারীকে চাকরিচ্যুত করেনি৷
সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ইশরাত হাসান বলেন, ‘‘আমরা দেখলাম ওই ইভটিজারকে গলায় ফুলের মালা, মাথায় পাগড়ি আর হাতে পবিত্র কোরআন শরিফ দিয়ে বের করে আনা হলো৷ এটাও একটা প্রচারণা যে তুমি নারীর পোশাক নিয়ে বলো৷ রাস্তায় গিয়ে ড্রেসের কথা বলো, টিজ করো৷ পরে কিছু হলে ধর্মের দোহাই দেবে৷''
১ মার্চ মোহাম্মদপুরে একটি টি স্টলে প্রকাশ্যে ধূমপানের অজুহাত তুলে নারীবিদ্বেষীরা দুই তরুণীর ওপর আক্রমণ করলেও পুলিশ ওই মবের পক্ষেই অবস্থান নেয়৷ দুই তরুণীকে থানায় নিয়ে যায়৷ দুই সপ্তাহ পরে অবশ্য সমালোচনার মুখে ওই মবের হোতাকে আটক করা হয়৷
দুই তরুণীকে হেনস্তার প্রতিবাদে শাহবাগে যারা প্রতিবাদ করেছিলো তাদের ছবিকে নানা ট্যাগ দিয়ে আবার ওই গোষ্ঠী সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে দেয়৷ তাদের একজন বলেন, ‘‘এখন আমি বাইরে যেতে সাহস পাচ্ছি না৷ আমরা ছবি যেভাবে কুরুচিপূর্ণভাবে ছড়ানো হয়েছে তাতে আমি আর স্বাভাবিকভাবে চলাফেরা করতে পারব কিনা জানি না৷''
মাগুরায় শিশু ধর্ষণের প্রতিবাদে শাহবাগে যারা প্রতিবাদ করেন তাদের বিরুদ্ধে পুলিশের ওপর হামলার মামলা হয়েছে৷ তাদের ছবিও নানাভাবে ফেসবুকে ছাড়ানো হয়েছে৷
আইনজীবী ইশরাত হাসান বলেন, ‘‘এইসব কারণে সমাজে ও রাষ্ট্রে পোটেনশিয়াল রেপিস্ট তৈরি হচ্ছে৷ তারা দেখছে নারীকে হেনস্তা করলে যৌন নিগ্রহ করলে নন্দিত হওয়া যায়৷ বাহবা পাওয়া যায়৷ এই যদি হয় অবস্থা তাহলে নারী তো যৌন নিগ্রহের শিকার হবেই৷ ওয়াজে নারীকে যে বিকৃতভাবে উপস্থাপন করা হয় তাতে তো রাস্তায় নেমে নারীকে ওড়না পরাতে বোরখা পরাতে উৎসাহিত হবে৷''
‘পরিবর্তনের প্রথম শিকার হন নারীরা'
বিএনপির সাবেক সংসদ সদস্য ব্যারিস্টার রুমিন ফারহানাকে অভিনব পন্থায় হেনস্তা করা হয়েছে৷ বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের সময় কেউ একজন তার ফোন নম্বর চাইলে তিনি যখন তাকে ফোন নম্বর বলেন তখন পাশ থেকে কেউ একজন সেটা ভিডিও করে নেয়৷ পরে সেই ভিডিও সামাজিক মাধ্যমে ছেড়ে দেয়া হয়৷ আর তারপরই অসংখ্য ফোন কল আসতে শুরু করে৷ শেষ পর্যন্ত তিনি সেই ফোন নম্বর পরিবর্তন করতে বাধ্য হন৷
রুমিন ফারাহানা বলেন, ‘‘আমাদের সমাজব্যবস্থা যে কেবল পুরুষতান্ত্রিক তাই নয়, নারীবিদ্বেষী একটা সমাজ ব্যবস্থা৷ তাই যে-কোনো পরিবর্তনের প্রথম শিকার হন নারীরা, যে-কোনো প্রান্তিক জনগোষ্ঠী৷ এটা ধর্ম, জাতিগোষ্ঠী বা বিশ্বাসের ভিত্তিতে হতে পারে৷ ফলে এই সমাজে নারীর প্রতি যা ঘটছে তাতে অবাক হওয়ার কিছু নেই৷ তবে পরিবর্তনের আওয়াজ যদি আমরা এখনই তা তুলি আমরা তাহলে পরিস্থিতি আরো অসহনীয় হয়ে উঠবে৷ এরইমধ্যে আমরা অনেক দেরি করে ফেলেছি৷''
বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সাধারণ সম্পাদক মালেকা বানু বলেন, ‘‘নারী এগিয়ে যাচ্ছে৷ এটা পুরুষতান্ত্রিক সমাজের অনেকেই মেনে নিতে পারছে না৷ তাই তারা কখনো ধর্মের নামে অথবা অন্য কোনো উপায়ে দমিয়ে রাখতে চায়৷''
তার কথা, ‘‘পোশাক কখনো ধর্ষণের কারণ হতে পারে না৷ তাহলে কুমিল্লার তনু তো হিজাব পরতেন৷ তিনি কেন ধর্ষণের শিকার হয়েছিলেন৷ শিশুরা কেন ধর্ষণের শিকার হয়৷ ছেলে শিশুরা কেন বলাৎকারের শিকার হয়?''
মালেক বানু বলেন, নারীর প্রতি সহিংসতার বিচারহীনতাই হচ্ছে এটা বেড়ে যাওয়ার বড় কারণ৷ একইসঙ্গে রাষ্ট্র ও সমাজেই রয়েছে এর সক্রিয় উপাদান৷ পরিবারের মধ্যে এবং পরিচিতজনের মাধ্যমেই নারী সবচেয়ে বেশি নির্যাতন ও যৌন সহিংসতার শিকার হন৷ আর বিচার ও পুলিশি তদন্তের দুর্বলতার কারণে মাত্র তিন শতাংশ নারী শিশু নির্যাতন মামলায় আসামিরা শাস্তি পান৷
ড. ফাতেমা সুলতানা শুভ্রা মনে করেন, ‘‘নারীর প্রতি সহিংসতা, যৌন সহিংসতা বন্ধ করতে আইনই যথেষ্ট নয়, প্রয়োজন সমাজ, রাষ্ট্র ও নাগরিকদের মনোজাগতিক পরিবর্তন৷''
পরিসংখ্যান
আইন ও সালিশ কেন্দ্রের হিসাবে ২০২৪ সালে সারাদেশে পারিবারিক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন মোট ৫২৩ জন নারী৷ যার মধ্যে নির্যাতনের কারণে মারা যান ২৭৮ জন এবং আত্মহত্যা করেন ১৭৪ জন৷ ২০২৩ সালে পারিবারিক নির্যাতনের শিকার হয়েছিলেন ৫০৭ জন নারী৷
অন্যদিকে ২০২৪ সালে যৌতুকের জন্য নির্যাতনের শিকার হয়েছেন মোট ৭৭ জন নারী৷ এর মধ্যে শারীরিক নির্যাতনের পর হত্যার শিকার হন ৩৬ জন নারী এবং আত্মহত্যা করেন ৭ নারী৷
ওই বছর সারাদেশে ধর্ষণ ও দলবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হয়েছেন মোট ৪০১ জন নারী৷ এর মধ্যে ধর্ষণ পরবর্তী হত্যার শিকার হয়েছেন ৩৪ জন এবং ধর্ষণের পর আত্মহত্যা করেছেন সাত জন৷ ধর্ষণের চেষ্টার শিকার হয়েছেন ১০৯ জন৷ ধর্ষণের চেষ্টার পর হত্যা করা হয় এক জনকে৷
যৌন হয়রানি ও উত্ত্যক্তকরণের শিকার হয়েছেন কমপক্ষে ১৬৬ জন নারী৷ উত্ত্যক্তকরণের কারণে আত্মহত্যা করেছেন দুই জন নারী ও খুন হয়েছেন তিন জন নারী৷
চলতি বছরের জানুয়ারি এবং ফেব্রুয়ারি এই দুই মাসে ৮৫ জন নারী ধর্ষণের শিকার হয়েছেন৷ চারজনকে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে৷ এই সময়ে যৌন হয়রানির শিকার হয়েছেন ৩৫ জন৷
হিউম্যান রাইটস সাপোর্ট সোসাইটির তথ্য অনুসারে, ২০২০-২০২৪ সাল পর্যন্ত গত পাঁচ বছরে বাংলাদেশে কমপক্ষে ১১ হাজার ৭৫৮ জন নারী ও মেয়ে শিশু নির্যাতন ও সহিংসতার শিকার হয়েছেন, যার মধ্যে ছয় হাজার ৩০৫ জনকে ধর্ষণ করা হয়েছে৷
যাদের ধর্ষণ করা হয়েছে তাদের মধ্যে তিন হাজার ৪৭১ জনের বয়স ১৮ বছরের নিচে, যা মোট ঘটনার ৫৫ শতাংশেরও বেশি৷
অন্তত ৫০ জন ভয়াবহ সহিংসতার ট্রমা সহ্য করতে না পেরে আত্মহত্যা করেছেন৷ গত পাঁচ বছরে দুই হাজার ৬২৪ জন নারী ও মেয়ে শিশু যৌন হয়রানির শিকার হয়েছেন৷
আইন সংশোধন
পরিস্থিতি সামাল দিতে বৃহস্পতিবার উপদেষ্টা পরিষদের সভায় ধর্ষণ মামলার তদন্তে ১৫ দিন এবং বিচারের জন্য তিন মাস সময় বেধে দিয়ে আইন সংশোধন অনুমোদন করা হয়েছে৷ বিয়ের প্রলোভনে ধর্ষণের শাস্তি করা হয়েছে সাত বছরের কারাদণ্ড৷ আর মৃত্যুদণ্ডের বিধান বহাল আছে৷
অ্যাডভোকেট ইশরাত হাসান বলেন, ‘‘তদন্ত ও বিচারের সময় কমিয়ে কোনো লাভ নেই৷ প্রয়োজন পর্যাপ্ত বিচারক ও আদালত৷ আর সময় বেধে দিলেও আপিল আদালতে তো আর সময় বেধে দেয়া যায় না৷''
মালেকা বানু বলেন, ‘‘আইন পর্যাপ্ত আছে৷ প্রয়োজন আইনের প্রয়োগ এবং বিচার পাওয়ার ব্যবস্থা নিশ্চিত করা৷''