ঈদযাত্রায় সড়কপথ কি মরণফাঁদ?
২৯ মার্চ ২০২৫ঈদের ছুটিতে নাড়ির টানে বাড়ি যেতে রাজধানী ঢাকা ছাড়েন অসংখ্য মানুষ। স্বজন-প্রিয়জনদের সঙ্গে কয়েক দিন উৎসবের আমেজে কাটাতে ঘরমুখো হন অনেকে। ফলে ট্রেন, লঞ্চ, বাস ও অন্যান্য বাহনে থাকে প্রচন্ড ভিড়। কিন্তু এই উৎসবমুখর ঈদযাত্রা দুর্ঘটনার কারণে হয়ে ওঠে শোকের। তাই ঈদ এলে ঘরমুখো মানুষের মধ্যে নির্বিঘ্নে বাড়ি ফেরা নিয়ে উৎকণ্ঠা দেখা যায়। কারণ একটি দুর্ঘটনাই বয়ে আনে সারা জীবনের কান্না।
বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতি ডিডাব্লিউকে জানিয়েছে, গত ঈদুল ফিতরে ৩৯৯টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৪০৭ জন নিহত ও ১ হাজার ৩৯৮ জন আহত হয়েছেন। বিগত ৯ বছরে শুধু ঈদুল ফিতরেই ২ হাজার ৩৭৭টি দুর্ঘটনায় ২ হাজার ৭১৪ জন নিহত ও ৭ হাজার ৪২০ জন আহত হয়েছেন। গত এক দশকের পরিসংখ্যান বলছে, সড়ক ও মহাসড়ক দৃশ্যত মরণফাঁদ।
ঈদযাত্রায় সড়ক দুর্ঘটনার কারণ ও উত্তরণের উপায় নিয়ে ডিডাব্লিউ এর সঙ্গে কথা বলেছেন নিরাপদ সড়ক চাই আন্দোলনের প্রতিষ্ঠাতা ও চেয়ারম্যান ইলিয়াস কাঞ্চন।
তিনি বলেন, ‘‘ঈদে সাধারণত প্রত্যেকেরই তাড়াহুড়া থাকে। সেই তাড়াহুড়া যদি থামানো না যায় তাহলে কিন্তু সড়ক দুর্ঘটনা রোধ করা কঠিন। চালকরা যেমন তাড়াহুড়া করে, বাসমালিকরাও বেশি আয়ের জন্য অতিরিক্ত ট্রিপ পরিচালনা করতে চালকদের প্ররোচিত করেন। এসব থেকে যদি বাসমালিকরা বিরত থাকে ও চালকদের যদি তারা শান্তিতে গাড়ি চালাতে দেন তাহলে দুর্ঘটনার শঙ্কা কমে যায়। চালকরা ঈদের সময় নির্ঘুমভাবে গাড়ি চালায়। কোনো বিশ্রাম না নিয়ে একটার পর একটা ট্রিপে যেতেই থাকে যতক্ষণ যাত্রী পাওয়া যায়। কিন্তু চালকদের দায়িত্ব হলো যাত্রীদের ঠিকমতো গন্তব্যে পৌঁছে দেওয়া। এটি কিন্তু একটি ইবাদতের কাজ। কারণ ঘরমুখো মানুষ আপনজনের সঙ্গে দেখা করতে যায়। তাই চালক হিসেবে যাত্রীদের যদি আপনজনের কাছে পৌঁছে দেন তাহলেই যথাযথভাবে দায়িত্ব পালন করা হবে। আর যদি পয়সার কথা ভেবে ট্রিপ বেশি পাওয়ার জন্য না ঘুমিয়ে গাড়ি চালায়, তাহলে কিন্তু কাজটা সুষ্ঠুভাবে হবে না। বেশি ট্রিপ নেওয়া মূলত চালকদের অভ্যাস। তাই বাসমালিকরা যদি তাদের সুযোগ না দেয় তাহলে কিছুটা নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়। কিন্তু বাসমালিকরা চালকদের সঙ্গে যুক্ত হয়ে যায়। এ কারণে তারা যত বেশি সম্ভব ট্রিপের চেষ্টা করে।''
যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ ও বুয়েটের অ্যাক্সিডেন্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউটের সহকারী অধ্যাপক কাজী মো. সাইফুন নেওয়াজ ডিডাব্লিউকে বলেন, ‘‘প্রতিবছরই ঈদে সড়কে যেসব দুর্ঘটনা ঘটে সেগুলোর মধ্যে সবচেয়ে গুরুতর তিনটি হলো মুখোমুখি সংঘর্ষ, যানবাহন উল্টে পড়া ও পথচারীকে ধাক্কা। দুর্ঘটনায় বেশি পড়ে বাস, ট্রাক, মোটরসাইকেল ও তিন চাকার নসিমন-করিমন। দুর্ঘটনার মূল দুটি কারণ হলো অতিরিক্ত গতি ও বেপেরোয়া গাড়ি চালানো। ফলে যানবাহনের অতিরিক্ত গতি নিয়ন্ত্রণ করতে হবে আগে। কারণ সড়ক ঈদের পরপর কিছুটা ফাঁকা থাকে। ঈদের আগে নজরদারি জোরদার থাকলেও পরে সেই কার্যক্রম কমে যায়। এ কারণে দ্রুতগতিতে যানবাহন চলাচল বাড়ে। বেশি ট্রিপ সম্পন্ন করার প্রবণতা থেকে তখন দুর্ঘটনা ও প্রাণহানি ঘটে।''
তবে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির মহাসচিব মো. সাইফুল আলমের দাবি, বাসমালিকরা যাত্রীদের নিরাপদ সেবাকেই গুরুত্ব দিয়ে থাকে। তিনি বলেন, ‘‘সরকারের পরিকল্পনার গলদে নানান অব্যবস্থাপনায় যাত্রী দুর্ভোগ ও সড়ক দুর্ঘটনা বাড়ছে। এর দায় অন্যায়ভাবে মালিকদের ওপর চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে।''
যাত্রী কল্যাণ সমিতির পূর্বাভাস, পবিত্র ঈদুল ফিতর উপলক্ষে ঢাকা থেকে দূরপাল্লার রুটে বাস-মিনিবাসে ৩০ লাখ ট্রিপে যাত্রীদের যাতায়াত সম্পন্ন হবে। সংগঠনটি জানিয়েছে, এবারের ঈদে ঢাকা ও আশেপাশের জেলা থেকে ১ কোটি ৫০ লাখ মানুষ বিভিন্ন গন্তব্যে যাবেন। দেশের এক জেলা থেকে অপর জেলায় আরও ৩ থেকে সাড়ে ৩ কোটি মানুষের যাতায়াত হওয়ার সম্ভাবনা আছে। এরমধ্যে ৭৫ শতাংশ সড়কপথ, ১৭ শতাংশ নৌপথ ও ৮ শতাংশ রেলপথ ধরবেন।
নাগরিক সংগঠন নৌ, সড়ক ও রেলপথ রক্ষা জাতীয় কমিটি ও ঢাকার গণমাধ্যমকর্মীদের সংগঠন শিপিং অ্যান্ড কমিউনিকেশন রিপোর্টার্স ফোরাম (এসসিআরএফ) এক যৌথ প্রতিবেদনে জানিয়েছে, ঈদুল ফিতর উপলক্ষে ঢাকা, গাজীপুর ও নারায়ণগঞ্জ মহানগরের মোট জনসংখ্যার ৫০ শতাংশ অর্থাৎ ১ কোটি ৫২ লাখ ৫০ হাজার মানুষ বাড়ি যাবে। এরমধ্যে ৬০ শতাংশ মানুষ যাতায়াত করবে সড়কপথে। বাকি ৪০ শতাংশ বেছে নেবে নৌ ও রেলপথ। সেই হিসাবে, ঈদে সড়কপথে মোট যাত্রীসংখ্যা দাঁড়াবে ১ কোটি ৩ লাখ ৬২ হাজার।
নৌ, সড়ক ও রেলপথ রক্ষা জাতীয় কমিটি ও এসসিআরএফ মনে করে, ঈদে বিপুলসংখ্যক মানুষের যাতায়াত সুশৃঙ্খল রাখার সক্ষমতা সড়ক পরিবহন খাতে নেই। দূরপাল্লার অনেক সড়কের কোনো কোনো স্থানে এখনো বেহাল দশা। এছাড়া সারা দেশে সড়কে পাঁচ শতাধিক ঝুঁকিপূর্ণ বাঁক রয়েছে। এগুলো দুর্ঘটনার অন্যতম কারণ। সড়ক দুর্ঘটনায় ক্ষতিপূরণ হিসেবে নিহতের পরিবার ৫ লাখ টাকা ও আহত ব্যক্তি ৩ লাখ টাকা পায়। ইলিয়াস কাঞ্চন মনে করেন, এই অর্থ বৃদ্ধি করা উচিত। তার কথায়, ‘এটুকু টাকা দিয়ে কী হয়? ক্ষতিপূরণের অঙ্ক অবশ্যই বাড়ানো প্রয়োজন। এছাড়া বাসচালকের পাঁচ বছরের কারাভোগের ব্যবস্থা আছে। এটা যথাযথভাবে প্রয়োগ হওয়া দরকার।'
বিগত সময়ের মতো এবারও ঈদে সড়ক দুর্ঘটনার পুনরাবৃত্তি যাতে না ঘটে, সেজন্য ঘরমুখো মানুষের নির্বিঘ্ন যাতায়াতে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে সড়ক পরিবহন মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতি, শ্রমিক ফেডারেশন, পুলিশ প্রশাসন ও বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) প্রতি আহ্বান জানিয়েছে কয়েকটি সংগঠন। এরমধ্যে যাত্রী কল্যাণ সমিতি সাতটি সুপারিশ তুলে ধরেছে। ঈদযাত্রায় ফিটনেসবিহীন লক্কড়-ঝক্কড় যানবাহন চলাচল বন্ধে কঠোর পদক্ষেপ নিতে বলেছে সংগঠনটি। যানবাহন ঝুঁকিপূর্ণ কিনা যাত্রীরা বুঝবেন কীভাবে? এমন প্রশ্নে সংগঠনটির মহাসচিব মো. মোজাম্মেল হক চৌধুরী ডিডাব্লিউকে বলেন, ‘কিছু যানবাহন দেখলেই বোঝা যায় সেগুলো ঝুঁকিপূর্ণ। এছাড়া কোন সড়কে কোন যানবাহন চলাচলের নিয়ম নেই সেগুলো মাথায় রাখতে হবে। যেমন জাতীয় মহাসড়কে অটোরিকশা ও ব্যাটারিচালিত রিকশা মোটেও নিরাপদ নয়। নিজের নিরাপত্তা নিয়ে নিজেকেই ভাবতে হবে বেশি। যাত্রীসাধারণ এসব দিকে নজর রাখলে যাত্রাপথ সহজ হতে পারে।'
ইলিয়াস কাঞ্চন বলেন, ‘‘যাত্রীদের বিরাট অংশ যত তাড়াতাড়ি পারা যায় বাড়ি যেতে চায়। সেই তাড়াহুড়া করতে গিয়ে দুর্ঘটনায় পড়ে তারা। তারা ভুলে বসেন জীবনটাই আসল। জীবন যদি বেঁচে থাকে তাহলে সবকিছুই করা যাবে। জীবন যদি না থাকে তাহলে কোনো কিছুই করা যাবে না। একটা জীবন হলো সবচেয়ে বড় বিষয়। তাই সড়ক দুর্ঘটনা রোধে যাত্রীরা ভূমিকা রাখতে পারেন বেশি। তারা যদি ঈদে ঠিকঠাক বাড়িতেই না পৌঁছাতে পারেন তাহলে তো লাভ হলো না। সেজন্য তাদের কিছু কাজ করতে হবে। গাড়িতে উঠে চালকদের প্রতি লক্ষ্য রাখতে হবে। চালক যদি উল্টাপাল্টা চালায় তাহলে গাড়ি দুর্ঘটনায় পড়বে। তখন যাত্রী ও চালক উভয়ের মৃত্যু হতে পারে। যাত্রীরা যদি বোঝেন গাড়ি দুর্ঘটনায় পড়তে পারে তাহলে চালককে সুন্দরভাবে কথা বলে শান্ত করে বুঝিয়ে ঠিকমতো চালাতে বলতে হবে। যাত্রীরা এক্ষেত্রে সচেতন থাকলে সড়ক দুর্ঘটনা রোধ করা সম্ভব।''
সংশ্লিষ্টরা মনে করেন, ত্রুটিপূর্ণ যানবাহন, অদক্ষ চালক, সড়ক-মহাসড়কে দুর্বল ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা ও আইনের কঠোর প্রয়োগের অভাব থাকায় দুর্ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটে। তাদের মতে, পরিবহন খাতে কর্মরত চালক-হেলপারদের বেতন-ভাতা ও কর্মঘণ্টা একটি সুনির্দিষ্ট নীতিমালার মধ্যে নিয়ে আসতে হবে। সড়ক দুর্ঘটনা এড়াতে অদক্ষ চালক, ফিটনেসবিহীন যানবাহন ও অতিরিক্ত যাত্রী বহন বন্ধ করা জরুরি।
ইলিয়াস কাঞ্চনের পরামর্শ, ‘‘আনফিট কিংবা ফিটনেসবিহীন ও যথাযথ কাগজপত্র না থাকা গাড়ি সড়কে নামানো যাবে না। এগুলো রাস্তায় নামালেই দুর্ঘটনা ঘটবে।''
ঈদে সড়ক দুর্ঘটনা এড়াতে ত্রুটিপূর্ণ ও রুট পারমিটবিহীন বাসসহ সব ধরনের অবৈধ যানবাহন ও লাইসেন্সবিহীন চালকদের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনার দাবি জানিয়েছে নৌ, সড়ক ও রেলপথ রক্ষা জাতীয় কমিটি ও এসসিআরএফ। রাজধানী ঢাকা ও বন্দরনগরী চট্টগ্রামসহ দেশের সব সড়ক, মহাসড়ক, আন্তঃজেলা সড়ক ও আঞ্চলিক সড়কে ভ্রাম্যমাণ আদালতের কার্যক্রম অব্যাহত রাখার আহ্বান জানিয়েছে সংগঠন দুটি। এছাড়া অবৈধ যানবাহন, লাইসেন্সবিহীন ও অপ্রাপ্তবয়স্ক চালকসহ আইন ভঙ্গকারীদের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নিতে সব ধরনের পুলিশ ও জেলা প্রশাসনের প্রতি আহ্বান জানানো হয়েছে এক যৌথ প্রতিবেদনে।
ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) পক্ষ থেকে গণপরিবহন মালিকদের গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি নির্দেশনা মেনে চলতে বলা হয়েছে। এগুলো হলো– ড্রাইভিং লাইসেন্সের বৈধতা যাচাই করে গাড়িচালক নিয়োগ করতে হবে, মালিকরা চালককে টানা ৮ ঘণ্টার বেশি চালাতে বাধ্য করতে পারবেন না, ফিটনেসবিহীন, যান্ত্রিক ত্রুটিযুক্ত ও কালো ধোঁয়া নির্গমনকারী বাসগুলো রাস্তায় নামানো যাবে না।
বিআরটিএ'র পরিচালক মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ গণমাধ্যমে দেওয়া এক বিবৃতিতে বলেন, ‘‘ফিটনেসবিহীন যানবাহন বন্ধে বিআরটিএ কঠোর অবস্থানে রয়েছে। সড়ক দুর্ঘটনা রোধে সীমিত সামর্থ্য নিয়ে বিআরটিএ প্রাণপন চেষ্টা চালাচ্ছে। যাত্রী সচেতনতা, পরিবহন মালিক সমিতি, শ্রমিক ফেডারেশন ও পুলিশসহ বিভিন্ন সংস্থার সমন্বিত প্রচেষ্টায় নিরাপদ ও স্বস্তির ঈদযাত্রা নিশ্চিত করা সম্ভব।''
যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মো. মোজাম্মেল হক চৌধুরী যাত্রীদের উদ্দেশে কয়েকটি পরামর্শ দিয়েছেন। এরমধ্যে তিনি উল্লেখ করেন– পরিবার-পরিজনকে ধাপে ধাপে বাড়ি পাঠানো, ঝুঁকিপূর্ণ যানবাহন এড়িয়ে চলা, যানবাহনের নম্বর ও পুলিশের হেল্পলাইন নম্বর সংগ্রহে রাখা।
যাত্রীদের নিরাপত্তা ও সুবিধার্থে কিছু নির্দেশনা দিয়েছে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ (ডিএমপি)। যেমন– অপরিচিত কারও দেওয়া খাবার বা পানীয় গ্রহণ করা থেকে বিরত থাকা, মালামাল নিজ দায়িত্বে রাখা, জরুরি প্রয়োজনে টার্মিনালের পুলিশ কন্ট্রোলরুম বা ৯৯৯ নম্বরে যোগাযোগ করা, মোবাইল ফোনে কথা বলার সময় রাস্তা পারাপার না করা, রাস্তা পারাপারে ফুট ওভারব্রিজ, আন্ডারপাস কিংবা জেব্রাক্রসিং ব্যবহার করা, চলন্ত গাড়িতে ওঠানামা না করা ও পণ্যবাহী মোটরযানে যাত্রী হয়ে যাতায়াত না করা।
ঈদে প্রবাসীদের লাগেজ-ব্যাগেজ নিয়ে বাড়ি যেতে হাইওয়ে পুলিশের সেবা নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন হাইওয়ে পুলিশের ডিআইজি অপারেশন মো. শফিকুল ইসলাম। তিনি বলেন, ‘‘সড়কে ডাকাতিতে জড়িত ১৪৪৩ জনকে চিহ্নিত করে অভিযান শুরু হয়েছে। ৩৯০০ কিলোমিটার জাতীয় মহাসড়কে আমাদের ৩৪০টি অপারেশন টিম কাজ করছে।''
সড়ক ও মহাসড়কে দুর্ঘটনা প্রতিরোধ ও নির্বিঘ্ন যাতায়াত নিশ্চিতে বিশেষ ব্যবস্থা নিয়েছে সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগ। হাইওয়ে পুলিশ, জেলা প্রশাসন ও ট্রাফিক বিভাগের সমন্বয়ে মনিটরিং টিম কাজ করছে। অনিরাপদ যানচলাচল রোধে মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করা হচ্ছে। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী সার্বক্ষণিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করছে। ঢাকার বাস টার্মিনালে হেল্প ডেস্ক স্থাপন ও এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়েতে গতি নিয়ন্ত্রণ করার কথা বলা হয়েছে এক বিজ্ঞপ্তিতে।
ঈদকে কেন্দ্র করে মহাসড়কগুলোতে হাজার হাজার মোটরসাইকেল চলবে। এ নিয়ে শঙ্কার কথা জানিয়েছেন অধ্যাপক কাজী মো. সাইফুন নেওয়াজ। তিনি ডিডাব্লিউকে বলেন, ‘‘ঈদে মোটরসাইকেলে দীর্ঘ রুটে যাতায়াত করেন অনেকে। মোটরসাইকেলে দেখা যায় দুই জনের বেশি যাত্রী বহন করলে ও ভারী মালামাল থাকলে চালকের পক্ষে ভারসাম্য বজায় রাখা কঠিন হয়ে যায়। তখন পাশ দিয়ে বড় যানবাহন গেলে পেছনে বাতাসের যে টান থাকে সেটির সঙ্গে দক্ষ হলেও মোটরসাইকেল চালকদের জন্য নিয়ন্ত্রণ রাখা দুরূহ হয়ে পড়ে। ফলে মোটরসাইকেলে লম্বা যাত্রাপথে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে দুর্ঘটনা ঘটে।''
সড়ক দুর্ঘটনার কারণে একসময়ের ব্যস্ত চিত্রনায়ক ইলিয়াস কাঞ্চনের জীবনে সবচেয়ে বড় শোক গেঁথে আছে। ১৯৯৩ সালের ২২ অক্টোবর চট্টগ্রামের পটিয়ায় মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারান তার স্ত্রী জাহানারা কাঞ্চন। সেই শোক থেকে নিরাপদ সড়ক চাই আন্দোলন শুরু করেন ইলিয়াস কাঞ্চন। এরপর কেটে গেছে ৩২ বছর। তিনি যখন এই আন্দোলন শুরু করেন তখন তার সোনালি সময়। সম্প্রতি একটি অনুষ্ঠানে নায়ক নিজেই বলেছেন, ‘এমনও সুসময় গেছে যখন টাকা গোনার সময় পেতাম না। বিছানার ওপর টাকার বান্ডিল ফেলে বলতাম গুনে নিও।' দীর্ঘ তিন দশকের বেশি সময় আন্দোলন করেও দেশের বিভিন্ন স্থানে নিয়মিত সড়ক দুর্ঘটনা ও ধারাবাহিক হতাহতের ঘটনা অব্যাহত থাকায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন তিনি।
সড়কের নিরাপত্তায় দীর্ঘ সময় কাজ করার অভিজ্ঞতা কি তাহলে হতাশায় ভরা? উত্তরে ডিডাব্লিউকে ইলিয়াস কাঞ্চন বলেন, ‘‘একেবারেই কিছু যে হয়নি তা নয়। তবে আরও অনেক কিছু হতে পারতো। সড়কের নিরাপত্তা নিশ্চিতে আমি যে সুপারিশগুলো দিয়ে এসেছি, সরকার যদি সেভাবে কাজ করতো তাহলে দুর্ঘটনা কমে আসতো। একটা জীবনও যদি বাঁচানো যেতো অনেক বড় উপকার হতো। কিছু মানুষের জীবন হয়তো রক্ষা হয়েছে। কিন্তু যে মানুষগুলো প্রাণ হারালো সেসব দায় কে নেবে? এ নিয়ে কষ্ট হয় আমার।''
ইলিয়াস কাঞ্চনের অভিযোগ, দুর্ঘটনার জন্য ত্রুটিপূর্ণ ও অবৈধ যানবাহন এবং অদক্ষ ও লাইসেন্সবিহীন চালকদের ওপর সরকারের দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা দায় চাপালেও সংশ্লিষ্ট সরকারি সংস্থাগুলোকে এসব অনিয়ম ও অব্যবস্থাপনার বিরুদ্ধে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে দেখা যায় না। তিনি বলেন, ‘‘আমার ব্যক্তিগত কষ্ট থেকে যে আন্দোলন শুরু করেছিলাম, ৩২ বছরেও সেটা শেষ করতে পারিনি। সেজন্য নতুনভাবে চিন্তা করছি কীভাবে এই আন্দোলনকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া যায়। মনে হচ্ছে, রাজনীতি ছাড়া আর বোধহয় নিরাপদ সড়ক চাই আন্দোলন এগিয়ে নেওয়া সম্ভব না। সামনে রাজনীতিতে আসবো। এজন্য নতুন দল গঠনের চেষ্টায় আছি।''
ইলিয়াস কাঞ্চন মনে করেন, সড়ক-মহাসড়কে সব ধরনের চাঁদাবাজি বন্ধের বিকল্প নেই। তিনি বলেন, ‘‘সরকারের উদ্যোগ না নেওয়ার প্রধান কারণ চাঁদাবাজি বন্ধ না করতে চাওয়া। সরকার বদলালেও চাঁদাবাজি বন্ধ হয় না। সেটা কেবল হাতবদল হয়। সরকার যদি এসব বন্ধ না করে তাহলে কোনোদিনই সড়কের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা যাবে না। রাষ্ট্রের সদিচ্ছা ছাড়া নিরাপদ সড়ক সম্ভব নয়।''
ইলিয়াস কাঞ্চনের দৃষ্টিতে, সড়ক-মহাসড়কে অহরহ দুর্ঘটনা ও অনাকাঙ্ক্ষিত মৃত্যু ঘটলেও দুর্ঘটনার ঝুঁকিমুক্ত সড়ক প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট মহলগুলোর জোর তৎপরতা দৃশ্যমান নয়। অন্তর্বর্তী সরকার কি তাহলে সড়কের নিরাপত্তায় অংশীজনদের মতামত নেয়নি? তার উত্তর মোটেও আশাব্যঞ্জক নয়, ‘‘এ পর্যন্ত যত সরকারই এসেছে, কেউই সড়কের নিরাপত্তাকে তেমন গুরুত্ব দেয়নি। আমি যেভাবে ভাবি কিংবা যেভাবে নিবেদিত থাকি, সেভাবে কেন জানি তারা ভাবে না। আমার কাছে সড়কে একটি প্রাণ ঝরে যাওয়াও অনেক বড় ঘটনা। অন্তর্বর্তী সরকার এসেছে, তারাও সড়কের নিরাপত্তাকে সেই চোখে দেখছে না। আলোচনায় বসলে সবাই একমত হয় এই করতে হবে, ওই করতে হবে। কিন্তু পরে আর কিছুই বাস্তবায়ন হয় না। সড়ক পরিবহন ও সেতু উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান একাই আরো কয়েকটি মন্ত্রণালয় সামলাচ্ছেন। এভাবে হয় না। তাই সরকার বদলালেও সড়ক দুর্ঘটনা কমেনি। অন্তর্বর্তী সরকার আসার পরও কিন্তু প্রতিনিয়ত সড়ক দুর্ঘটনা হচ্ছে, বরং আগের চেয়ে বেড়েছে।''
এবারের ঈদে শঙ্কার আরেকটি বড় কারণ হিসেবে অটোরিকশা বেড়ে যাওয়ার দিকটি উল্লেখ করেছেন অধ্যাপক কাজী মো. সাইফুন নেওয়াজ। তিনি ডিডাব্লিউকে বলেন, ‘‘অটোরিকশা মহামারির মতো বেড়েছে। এগুলো বেশি আয়ের আশায় মহাসড়কে চলে আসবে। দুই-তিন থেকে ১০ কিলোমিটার পথ পর্যন্ত এক চার্জেই চলাচলের চেষ্টা করবে এগুলো। এ কারণে মারাত্মক দুর্ঘটনা ঘটতে পারে, বিশেষ করে রাতে। এক্ষেত্রে কঠোর নজরদারি দরকার। এর মাধ্যমে পথচারীদের দুর্ঘটনায় পড়া রোধ করা সম্ভব।''
একই শঙ্কা থেকে যাত্রী কল্যাণ সমিতি নিজেদের সুপারিশে গুরত্বের সঙ্গে উল্লেখ করেছে, যানজট ও দুর্ঘটনা কমাতে জাতীয় মহাসড়ক থেকে প্যাডেল রিকশা, ব্যাটারিচালিত ইজিবাইক, নসিমন-করিমন, সিএনজিচালিত অটোরিকশা ঈদের ১০ দিন আগে উচ্ছেদ করতে হবে। সংগঠনটির মহাসচিব মো. মোজাম্মেল হক চৌধুরী ডিডাব্লিউকে বলেন, ''আমাদের পর্যবেক্ষণ বলছিল, এগুলো মহাসড়কে পাঁচ লাখ থাকবে। তবে কিছু মনিটরিং হওয়ায় এখন মহাসড়কে দেড় লাখের মতো ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে।''
বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের সভাপতি আবদুর রহিম বক্স দুদু মনে করেন– ব্যাটারিচালিত ইজিবাইক, মোটরসাইকেলসহ ছোট যানবাহন নিয়ন্ত্রণের উদ্যোগ নিতে হবে।
অধ্যাপক কাজী মো. সাইফুন নেওয়াজের দৃষ্টিতে, ‘‘ঈদের সময় ঢাকা ফাঁকা হয়ে যায়। তখন অপ্রাপ্তবয়স্ক অনেকে গাড়ি ও মোটরসাইকেল নিয়ে বের হয়। তাদের মধ্যে রেস দেওয়ার প্রবণতা থাকে। এসব কারণে কিন্তু বিশঙ্খলা ও দুর্ঘটনার ঝুঁকি বেড়ে যায়।''
ঈদে ঢাকা মহানগরী ও ঢাকার বাইরে ঈদযাত্রা সুষ্ঠু ও নিরাপদ রাখতে গণপরিবহন শ্রমিক, যাত্রী ও পথচারীদের কিছু গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশনা অনুসরণ করতে বলেছে ডিএমপি। যেমন– বাসের ছাদে অতিরিক্ত যাত্রী বহন করা যাবে না, গাড়িচালককে গতিসীমা মেনে গাড়ি চালাতে হবে ও অতিরিক্ত গতিতে গাড়ি চালানো থেকে বিরত থাকতে হবে; ওভারটেকিং নিষিদ্ধ এলাকা, রাস্তার বাঁক ও সরু ব্রিজে ওভারটেকিং করা যাবে না, নেশাজাতীয় দ্রব্য সেবন করে, শারীরিকভাবে অসুস্থ কিংবা ঘুমন্ত অবস্থায় গাড়ি চালানো যাবে না, বৈধ ড্রাইভিং লাইসেন্স ও হালনাগাদ কাগজপত্র ছাড়া গাড়ি চালানো যাবে না, গাড়ি চালানোর সময় মোবাইল ফোন বা হেডফোন ব্যবহার করা যাবে না ও গাড়িতে উচ্চস্বরে গান বাজানো যাবে না, উল্টো পথে গাড়ি চালানো নিষেধ।
এসব উদ্যোগকে ইতিবাচক হিসেবে দেখছে যাত্রী কল্যাণ সমিতি। সংগঠনের মহাসচিব মো. মোজাম্মেল হক চৌধুরী ডিডাব্লিউকে বলেন, ‘‘সরকার আমাদের কয়েকটি সুপারিশ অনুযায়ী কার্যক্রম পরিচালনা করছে। এজন্য আমরা সন্তুষ্ট।''
একইভাবে সরকারের সিদ্ধান্ত ও নির্দেশনাকে ইতিবাচক হিসেবে দেখছে জাতীয় কমিটি ও এসসিআরএফ। তাদের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সরকার নির্বিঘ্ন ঈদ যাতায়াতের লক্ষে ইতোমধ্যে বিভিন্ন সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এগুলো বাস্তবায়নের জন্য সংশ্লিষ্ট সব মহলকে কঠোর নির্দেশনা দিয়েছে। সরকারের নির্দেশনা কার্যকর হলে জনভোগান্তি ও দুর্ঘটনা কমবে বলে মনে করেন সংগঠন দুটির নেতারা।
যাত্রী কল্যাণ সমিতির তথ্যানুযায়ী, এবারের ঈদে ঢাকা থেকে ৮০ হাজার যাত্রী ট্রেনের ছাদে চড়ে বাড়ি যাবেন। রেলের ৮৩ শতাংশ কোচ ও ৬০ শতাংশ লোকোমোটিভ মেয়াদোত্তীর্ণ। এছাড়া ৮২ শতাংশ রেলক্রসিং অরক্ষিত। এমন পরিস্থিতিতে রেল দুর্ঘটনা ও লাইনচ্যুতির শঙ্কা প্রকাশ করেন সংগঠনটির নেতারা।
যাত্রী কল্যাণ সমিতি আরো জানিয়েছে, এবারের ঈদে ঢাকার সদরঘাট ও নারায়ণগঞ্জ নদীবন্দরসহ বিভিন্ন ঘাট দিয়ে নৌপথে ২০০টি ছোট-বড় নৌযানে প্রায় ৪০ লাখ যাত্রী দেশের বিভিন্ন গন্তব্যে যাবেন। ঈদযাত্রায় নৌপথে অতিরিক্ত যাত্রী বহনের অভিযোগ পেলে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে জানিয়েছেন নৌপরিবহণ এবং শ্রম ও কর্মসংস্থান উপদেষ্টা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) ড. এম সাখাওয়াত হোসেন। ঈদে ফিটনেসবিহীন জলযান যেন নৌপথে চলাচল করতে না পারে সেজন্য নৌপরিবহন অধিদফতরসহ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে কঠোরভাবে মনিটরিং করার নির্দেশ দিয়েছেন তিনি। নৌদুর্ঘটনা রোধে ঈদের আগের ও পরের পাঁচ দিন সার্বক্ষণিক বাল্কহেড (বালুবাহী) চলাচল বন্ধ রাখতে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন কর্তৃপক্ষকে (বিআইডব্লিউটিএ) নির্দেশনা দিয়েছেন নৌপরিবহন উপদেষ্টা।
নিরাপদ নৌচলাচল ও যাত্রীদের সার্বিক নিরাপত্তা নিশ্চিতে রাতে চলাচলকারী দূরপাল্লার লঞ্চগুলোতে চার জন করে আনসার সদস্য নিয়োগের জন্য মালিক পক্ষকে বলেছে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়। এর ব্যত্যয় হলে ও কোনো দুর্ঘটনা ঘটলে মালিকপক্ষ দায়ী থাকবে। লঞ্চে বা ফেরিঘাটে কর্মরত স্টাফদের নির্ধারিত ইউনিফর্ম ও আইডি কার্ড থাকতে হবে। নারায়ণগঞ্জের শীতলক্ষ্যা নদী, মুন্সীগঞ্জের গজারিয়া, বরিশালের মেঘনা নদীসহ অপরাধপ্রবণ অঞ্চলগুলোতে কোস্টগার্ড, নৌ-পুলিশের পাশাপাশি নৌবাহিনী বিশেষ টহল দেবে।