ইসরায়েলিদের চোখে গাজা সংঘাত এবং ফিলিস্তিনীদের দুর্দশা
১২ আগস্ট ২০২৫গাজা ভূখণ্ডে জঙ্গি গোষ্ঠি হামাসের হাতে এখনো জিম্মি হয়ে আছে ৫০ জনের মতো ইসরায়েলি৷ তাদের পরিবারের আশঙ্কা, গাজায় সামরিক অভিযানের বিষয়ে বেনইয়ামিন নেতানিয়াহুর পরিকল্পনা তাদের প্রিয়জনদের জীবনকে আরো বিপন্ন করে তুলতে পারে৷
হামাসের কাছে জিম্মি হওয়া কারমেল গাটের চাচাতো ভাই গিল ডিকমান বলেন, ‘‘আমরা জানি, গাজার আরো ভূমি দখল করতে চাওয়ার পরিকল্পনা জিম্মিদের জীবন ঝুঁকির মধ্যে ফেলবে৷''
উল্লেখ্য, ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবরের ঘটনায় জিম্মি হওয়া কারমেলকে হত্যা করেছে হামাস সদস্যরা৷ গিল ডিকমান বলেন, ‘‘কারমেলের সাথে ঠিক এই ঘটনাটিই ঘটেছে৷ সে রাফায় ছিল, তারা (ইসরায়েলের সেনাবাহিনী) রাফাহ দখলের সিদ্ধান্ত নিলো৷ তখন আরো পাঁচ বন্দির সাথে কারমেলকেও হত্যা করে জিম্মিদের পাহারাদারেরা৷''
হামাসের হাতে বন্দি আরেক জিম্মি এভিয়েটার ডেভিডের চাচাতো ভাই নামা শুয়েক বলেন, ‘‘আমরা জানি যে, তাদেরকে জীবিত উদ্ধার করার একমাত্র উপায় হলো, সবার মধ্যে একটি চুক্তি করা৷ তাই আমরা চিৎকার করে বলছি যে, দয়া করে থামুন৷ আমাদের প্রিয়জনদের বাঁচান, তাদেরকে অনাহারে মরতে দেবেন না৷''
কিছুদিন আগে হামাসের প্রকাশ করা এক ভিডিওতে এভিয়েটার ডেভিডকে দেখা গেছে৷
চুক্তির পক্ষে অধিকাংশ ইসরায়েলি
জিম্মিদের পরিবারের সদস্যদের মতো অনেক ইসরায়েলিই চুক্তির পক্ষে ৷ দেশটির অরাজনৈতিক থিংক ট্যাংক ইসরায়েল ডেমোক্র্যাসি ইনস্টিটিউট (আইডিআই)-র এক জরিপে দেখে গেছে, গাজা যুদ্ধের বিষয়ে ইসরায়েলের নাগরিকদের ভাবনা কীভাবে সময়ের সাথে সাথে পরিবর্তন হয়েছে৷
২০২৩ সালের ৭ অক্টোররের ঘটনার এক সপ্তাহ পর করা এক জরিপে দেখা গিয়েছিল, দেশটির মাত্র ১৭ ভাগ মানুষ মনে করেন, ইসরায়েলের উচিত হামাসের সাথে আলোচনার মাধ্যমে বন্দিদের মুক্ত করা৷ আর ঘটনার এক বছরের মাথায় দেশটির ৫৩ ভাগ মানুষ এমন মতামত দিয়েছেন৷
এদিকে চলতি বছরের জুলাইয়ের মাঝামাঝি সময়ে ইসরায়েলের সংবাদমাধ্যম চ্যানেল ১২-এর করা এক জরিপে দেখা গেছে, দেশটির ৭৪ ভাগ মানুষ বন্দিদের মুক্ত করতে এবং গাজা যুদ্ধ বন্ধ করতে হামাসের সাথে সরকারের একটি চুক্তিতে পৌঁছানোর বিষয়টিকে সমর্থন করেন৷
গাজার জন্য সহানুভূতি নেই
বেশিরভাগ জরিপের ফলাফল বলছে, ইসরায়েলিরা জিম্মিদের ফেরত চায়, তারা দেশের সেনাদের জীবন সুরক্ষার পক্ষে এবং নেতানিয়াহু সরকারের পরিকল্পনার বিরোধী৷
তবে কিছু গবেষণায় ভিন্ন ফলও দেখা গেছে৷ ওই সকল জরিপে অংশগ্রহণকারীরা জানান, ফিলিস্তিনীদের প্রতি তাদের কোনো সহানুভূতি নেই এবং তাদের সাথে সহযোগিতামূলক কার্যক্রমের ধারণার পক্ষে নন তারা৷
জুলাইয়ের শেষ দিকে আইডিআই পরিচালিত এক গবেষণায় অংশগ্রহণকারীদের প্রশ্ন করা হয়, ‘‘গাজায় ফিলিস্তিনীদের দুর্ভোগ এবং সেখানকার দুর্ভিক্ষ আপনাকে কতটা পীড়িত করে কিংবা করে না?''
ইহুদি ধর্মাবলম্বী ইসরায়েলিদের শতকরা ৭৯ ভাগ জানান, তারা ততটা ব্যথিত নন, কিংবা একেবারেই ব্যথিত নন৷ জরিপে অংশগ্রহণকারী এই সম্প্রদায়ের লোকেরা আরো জানান, তারা মনে করেন, অপ্রয়োজনীয় কষ্ট লাঘবের জন্য ইসরায়েলি সেনাবাহিনী যথেষ্ট কাজ করছে৷
এদিকে, আরব-ইসরায়েলিরা অনেকটাই ভিন্নমত পোষণ করেছেন৷ জরিপে অংশগ্রহণকারী ৮৬ ভাগ আরব-ইসরায়েলি জানান, গাজায় দুর্ভিক্ষ এবং দুর্ভোগের খবের তারা ব্যথিত৷
আইডিআই-এর করা এর আগের এক জরিপে অংশগ্রহণকারী ইসরায়েলিদরে অর্ধেকের বেশি জানিয়েছিলেন, জিম্মিদেরকে মুক্ত করা খুব গুরুত্বপূর্ণ৷ মাত্র ছয় ভাগ জানিয়েছিলেন, শান্তি আনয়নের জন্য এবং জীবন রক্ষার স্বার্থে যুদ্ধ বন্ধ হওয়া উচিত৷
তেল আবিবের এক বাসিন্দা ডয়চে ভেলেকে বলেন, এটি সত্য যে, গাজায় এখন যা ঘটছে তা নিয়ে কথা বলছেন অধিক সংখ্যক মানুষ৷ তিনি আরো বলেন, ‘‘১৭ বছর ধরে গাজায় চলমান অবরুদ্ধ অবস্থা এবং যুদ্ধ শুরুর আগে সেখানকার মানুষের যেই জরাজীর্ণ অবস্থা, তা নিয়ে এক ঘণ্টার দূরত্বে থাকা তেল আবিবের মানুষের তেমন আগ্রহ নেই৷'' বিষয়টি স্পর্শকাতর হওয়ায় নিজের নাম প্রকাশ করতে রাজি হননি তিনি৷
কট্টরপন্থিরা মূলধারায়
২০২৫ সালের মার্চ মাসে যুক্তরাষ্ট্রের পেনসিলভানিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক টামির সোরেক সংস্কৃতি কীভাবে ইসরায়েল-ফিলিস্তিন সংঘাতের সাথে সম্পৃক্ত সেই বিষয়ে একটি জরিপ পরিচালনা করেন৷
জরিপে দেখা যায়, ইহুদি ইসরায়েলিদের ৮২ ভাগ গাজা থেকে ফিলিস্তিনীদের বের করে দেওয়ার পক্ষে৷ এমন ফলাফল দেখে অধ্যাপক মন্তব্য করেন, একসময় যেই ভাবনাকে প্রান্তিক এবং উগ্রপন্থি ফিলিস্তিনীদের বলে বিবেচনা করা হতো, তা এখন ইসরায়েলের মূলধারায় আশ্রয় নিয়েছে৷
২০২৫ সালের মার্চে যুক্তরাষ্ট্রের পিউ রিসার্চের এক গবেষণায় দেখায় যায়, মাত্র ২১ ভাগ ইসরায়েলি মনে করেন যে, ইসরায়েল এবং ফিলিস্তিন শান্তিপূর্ণভাবে পাশাপাশি অবস্থান করতে পারে৷ আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম, যেমন, যুক্তরাজ্যের বিবিসি, যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক টাইমস এবং জার্মানির সুডডয়চে সাইটুংয়ের সাম্প্রতিক সময়ে সরেজমিনে করা প্রতিবেদনে একই চিত্র উঠে এসেছে৷
মাসের পর মাস ধরে ইসরায়েল সরকার যা করছে তার তীব্র সমালোচনা করে আসছেন দেশটির লেখক এগার কেরেট৷ দেশের অনেকেই এখন তার মতো সরকারের সমালোচনা করছেন দেখে ভাল লাগছে এই লেখকের৷
ডয়চে ভেলেকে তিনি বলেন, ‘‘আমি চাই যে, লোকজন আমার পাশে বৈশ্বিক, উদার এবং মানবপ্রেমের কল্যাণে সংগ্রাম করুক৷ তারা যদি না-ও করে, আমরা একই জিনিস চাইতে থাকবো৷''
ইসরায়েলিরা কেন ফিলিস্তিনীদের অবস্থার বিষয়ে উদ্বিগ্ন নয় তা-ও ব্যাখ্যা করলেন কেরেট৷ বললেন, ‘‘এমন অনেক মানুষ রয়েছে, যারা আতঙ্কিত এবং নেতানিয়াহু কী করছে জানে না৷ তারা একবার নেতানিয়াহুর দিকে, আরেকবার অন্যদিকে যাচ্ছে৷ আপনি যদি সপ্তাহের পর সপ্তাহ ইসরায়েলের সংবাদ দেখেন, বুঝতে পারবেন, মানুষগুলো ভিন্ন ভিন্ন কথা বলছে৷ কোনো কিছুতেই স্থিরতা নেই৷''
ইসরায়েলিদের বেশিরভাগই কোনো না কোনোভাবে সামাজিক মাধ্যম থেকে খবর পায়, যেখানে গাজার ছবি ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে থাকে৷ ২০২৫ সালের এপ্রিলে আইডিআই-এর এক জরিপে ইসরায়েলিদের তিন-চতুর্থাংশের বেশি জানান, তারা গাজার ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞের অনেক, কিংবা কিছু ছবি এবং ভিডিও দেখেছেন৷
তানিয়া ক্র্যামার/আরআর