ইসরায়েল-তুরস্কের কথার লড়াই কি যুদ্ধে পরিণত হবে?
৯ এপ্রিল ২০২৫বেশ কিছুদিন হলো দুই দেশ একে অপরকে হুমকি দিয়ে যাচ্ছে।
ইসরায়েলের এক উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা বলেছেন, ''তুরস্ক সিরিয়ায় নতুন অটোমান সাম্রাজ্য গড়ে তুলতে চাইছে। তারা যদি 'রেড লাইন' পার করে, তাহলে ইসরায়েলও চুপ করে বসে থাকবে না।''
তুরস্কের কর্মকর্তারা পাল্টা বলেছেন, গাজা, লেবানন ও সিরিয়ার উপর আক্রমণ করে ইসরায়েল তাদের 'মৌলবাদী ও জাতিগত চেহারা' সামনে এনেছে। তারা এই অঞ্চলের ক্ষেত্রে বড় বিপদের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
গত সপ্তাহে সিরিয়ার উপর ইসরায়েল হামলা করার পর এই ধরনের অভিযোগ ও পাল্টা অভিযোগ করেছে দুই পক্ষ।
সিরিয়ার স্বৈরাচারী শাসক বলে পরিচিত বাশার আসাদ ২০২৪ সালের ডিসেম্বরে ক্ষমতাচ্যূত হওয়ার পর ইসরায়েল সিরিয়ার উপর একাধিকবার আক্রমণ করে। সিরিয়ার নতুন শাসকরা ১৪ বছরের গৃহযুদ্ধের পর সব পক্ষকে এক করে চলার প্রয়াস করছে। তারা ইসরায়েলের সঙ্গে কোনো সংঘাতে যেতে চায় না।
তা সত্ত্বেও ইসরায়েল বলে, তারা বাধ্য হয়ে সিরিয়ায় বোমা ফেলছে, যাতে নতুন সরকার আগের আমলের অস্ত্র তাদের উপর প্রয়োগ না করে।
কিন্তু গত সপ্তাহের বিমান হামলা ছিল আলাদা। তার মধ্যে তুরস্ককে বার্তা দেওয়ার প্রয়াস ছিল বলে ইসরায়েলের কর্মকর্তা স্থানীয় মিডিয়ায় জানিয়েছেন।
ইসরায়েলের যুদ্ধবিমান একটি সামরিক বিমানবন্দরে হামলা করে, তাছাড়া আরেকটি বিমানঘাঁটি এবং দামাস্কে বৈজ্ঞানিক গবেষণা কেন্দ্রের উপর আক্রমণ করে।
তুরস্ক গত কয়েক মাস ধরে চুপচাপ সিরিয়ার নতুন সরকারের সঙ্গে প্রতিরক্ষা চুক্তি নিয়ে আলোচনা করছিল। সিরিয়ার সেনাকে প্রশিক্ষণ দেয়া, সিরিয়ার বিমানঘাঁটি ব্যবহার করা নিয়ে আলোচনা হচ্ছিল। এই বিমানঘাঁটিগুলিতেই ইসরায়েল আক্রমণ করেছে।
তুরস্কের যুক্তি, আসাদের সমর্থক ইরান ও রাশিয়া এখন সিরিয়া থেকে হাত গুটিয়ে নেয়ায় যে শূন্যতা সৃষ্টি হয়েছে, তা তারা পূরণ করতে চায়। তারা সিরিয়ার পরিস্থিতি স্থিতিশীল করতে চায় এবং আইএস গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে লড়াই করতে চায়।
কিন্তু ইসরায়েল তুরস্কের এই প্রয়াসকে ভিন্নভাবে দেখছে।
ইসরায়েলের সামরিক বিষয়ে খবর করা সাংবাদিক রন বেন-ইশাই স্থানীয় সংবাদপত্রে উত্তর সম্পাদকীয়তে লিখেছেন, তুরস্ক মধ্য সিরিয়ায় এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম ও রাডার বসাচ্ছে তাতে সিরিয়ায় ইসরায়েল যে স্বাধীনভাবে কাজ করছে, তা বাধাপ্রাপ্ত হবে। তিনি বলেছেন, সিরিয়ায় তুরস্কের উপস্থিতির ফলে ইসরায়েল আর খোলাখুলি ও বাধাহীনভাবে তাদের বায়ুসীমায় প্রবেশ করতে এবং ইরান বা অন্য কোনো দেশের দিকে যেতে পারবে না। আসাদের জামানায় সিরিয়ার বায়ুসীমা অনেক বেশি নিয়ন্ত্রিত ছিল।
ইসরায়েলের মিডিয়ায় এখন নাগেল কমিশনের রিপোর্ট নিয়ে খুব আলোচনা হচ্ছে। প্রতিরক্ষা বাজেট ও সেনাবাহিনী গড়ে তোলা নিয়ে কমিশন রিপোর্ট দিয়েছিল। ইসরায়েলের ভবিষ্য়ৎ প্রতিরক্ষা বাজেট কত হওয়া উচিত সে বিষয়ে তারা মতপ্রকাশ করে। গত জানুয়ারিতে এই রিপোর্ট প্রকাশের পর ইসরায়েলের মিডিয়া বলেছিল, সেখানে তুরস্কের বিরুদ্ধে সম্ভাব্য যুদ্ধের কথাও আছে।
কিন্তু সম্প্রতি এক সাক্ষাৎকারে নাগেল বলেছেন, মিডিয়া রিপোর্টে অযথা বিষয়টি ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে দেখানো হয়েছে। সিরিয়ায় তুরস্কের ক্রমবর্ধমান উপস্থিতির বিষয়টির উপর দৃষ্টি দেয়ার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু কখনোই তুরস্কের বিরুদ্ধে যুদ্ধের কথা বলা হয়নি।
ইসরায়েলে আরো একটা আলোচনা চলছে, সেটা হলো, তুরস্ক, সিরিয়া ও মিশর তাদের বিরোধিতায় এককাট্টা হতে পারে। এটাকে বলা হচ্ছে সুন্নি ক্রেসেন্ট। কিন্তু বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই তিনটি দেশের কেউই ইসরায়েলের সঙ্গে লড়াই করতে চায় না।
সিরিয়ায় ইসরায়েলের বিমান হামলার দুই দিন পর তুরস্কের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সংবাদসংস্থা রয়টার্সকে বলেছেন, তুরস্ক ইসরায়েলের সঙ্গে সংঘাত চায় না। সিরিয়া তুরস্ক বা ইসরায়েল কারো এলাকা নয়। যদি তারা কোনো দেশের সঙ্গে হাত মেলাতে চায়, তা হলে তাকে স্বাগত জানানো হবে।
সম্পর্কে ফাটল
দুই দেশের মধ্যে এই কথার লড়াইয়ের প্রভাব তুরস্ক-ইসরায়েল সম্পর্কের মধ্যে পড়েছে বলে পর্যবেক্ষকরা মনে করছেন।
ওয়াশিংটনের থিঙ্ক ট্যাঙ্ক উইলসন সেন্টারের প্রাক্তন বিশ্লেষক ও তুরস্ক বিশেষজ্ঞ ইউসুফ ক্যান বলেছেন, বহু বছরের মধ্যে সিরিয়া নিয়ে দুই দেশের মধ্যে সবচেয়ে তীব্র বিরোধ সামনে এসেছে। বহু বছর ধরে দুই দেশ একটা ব্যবস্থা অনুসরণ করত। তাদের মধ্যে বিরোধ হলেও তার প্রভাব বাণিজ্যে পড়তো না। কিন্তু এখন পরিস্থিতি বদলাচ্ছে। প্রক্সি ওয়ার এখন প্রকৃত হুমকিতে পরিণত হয়েছে। আগে তা ছিল না।
এখন কী হচ্ছে
পর্যবেক্ষকরা বলছেন, দুর্বল সিরিয়ার পরিকাঠামোর উপর আক্রমণ করে ইসরায়েল সিরিয়ার অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে প্রভাব ফেলছে এবং তাদের ক্রমশ তুরস্কের দিকে ঠেলে দিচ্ছে।
ব্রাসেলস ভিত্তিক থিঙ্ক ট্যাঙ্ক ক্রাইসিস গ্রুপ তাদের মার্চের প্রতিবেদনে বলেছে, দক্ষিণ সিরিয়াতে ইসরায়েলি আগ্রাসনের ফলে সিরিয়া খুব সম্ভবত তুরস্কের সঙ্গে প্রতিরক্ষা সহযোগিতার দিকে যাবে। তারা এভাবে ইসরায়েলের আগ্রাসন ঠেকাতে চাইবে।
ক্যান ডিডাব্লিউকে বলেছেন, দুই দেশই মনে করে, প্রতিপক্ষ হলো সব ঝামেলার মূলে। গাজায় ইসরায়েলের বিমান হামলার একটা আশঙ্কা থাকছে। আবার তুরস্ক যেভাবে সিরিয়ার ইসলামিক গোষ্ঠীকেসহায্য করছে, তাতে বিশৃঙ্খলা হওয়ার সম্ভাবনা আছে।
সম্প্রতি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সফরে গেছিলেন ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনইয়ামিন নেতানিয়াহু। তখন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্প বলেছেন, তুরস্ক ও তাদের নেতার সঙ্গে তার সম্পর্ক খুব ভালো। তাই নেতানিয়াহু যেন যৌক্তিকভাবে কাজ করেন।
ক্যাথরিন শিয়ার/জিএইচ