ইরানে ইসরায়েলের হামলায় আফগান শরণার্থীদের বিপদ
২০ জুন ২০২৫ইসরায়েল-ইরান সংঘাতের প্রভাব আফগানরা নিজ দেশেও টের পাচ্ছেন৷ আফগানিস্তানে ইরান থেকে আমদানি করা পণ্যের দাম এরইমধ্যে আকাশচুম্বী৷
অন্যদিকে, নিরাপত্তার খোঁজে ইরানে পালিয়ে আসা লাখ লাখ আফগান নতুন অনিশ্চয়তা এবং চাপের মুখে পড়েছেন৷ আফগান শরণার্থী রাহেলা রাসা ডিডাব্লিউকে বলেন, ‘‘আমাদের থাকার কোনো জায়গা নেই৷ আমাদের চলাচলের স্বাধীনতা কেড়ে নেওয়া হয়েছে৷ আমাদের হয়রানি, অপমান এবং নির্যাতন করা হচ্ছে৷’’
আফগানদের জীবন ক্রমশ খারাপের দিকে যাচ্ছে
জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থা ইউএনএইচসিআর-এর দেয়া তথ্যমতে, ইরানে প্রায় ৪৫ লাখ আফগান বাস করেন৷ তবে অন্যান্য নানা সূত্র বলছে, এই সংখ্যা আরও অনেক বেশি হতে পারে৷ সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ইরান হাজার হাজার আফগানকে দেশ থেকে বহিষ্কারের পদক্ষেপ নিয়েছে৷ তবে, তালেবান শাসন থেকে পালিয়ে কর্মসংস্থান বা আশ্রয়ের জন্য নিয়মিতই ইরানে আসছেন আফগানরা৷
২০২১ সালে আফগানিস্তান থেকে মার্কিন সেনা প্রত্যাহারের পরের বছরগুলোতে দেশটিতে স্বাধীন গণমাধ্যম এবং শক্তিশালী নাগরিক সমাজ প্রায় অনুপস্থিত৷ নতুন প্রশাসন আগের আমলের নিরাপত্তা কর্মীদের লক্ষ্যবস্তু করেছে এবং নারীদের ওপর কঠোর বিধিনিষেধ আরোপ করেছে, তাদের কাজ ও শিক্ষা থেকে নিষিদ্ধ করেছে৷
ইরানে বসবাসকারী আফগানদের জন্যও পরিস্থিতির অবনতি ঘটেছে৷ শরণার্থীরা কেবল উচ্চ মূল্যে খাবার কিনতে পারছেন এবং তাদের তেহরান ছেড়ে যাওয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা দেয়া হয়েছে৷
ডয়চে ভেলেকে একজন শরণার্থী বলেছেন, তিনি তার শিশুর জন্য ফর্মুলা (শিশুখাদ্য) কিনতে পারছেন না৷
নাম প্রকাশ না করার শর্তে তিনি বলেন, ‘‘আমার কাছে সঠিক কাগজপত্র নেই, সেজন্য আমি যেখানেই যাই তারা আমার কাছে এটা বিক্রি করতে চায় না৷’’
‘আমার হৃদয় চুরমার হয়ে গেছে’
ইরানে ইসরায়েলি হামলায় নিহতদের মধ্যে রয়েছেন আফগান শরণার্থীরাও৷ ডিডাব্লিউ কথা বলেছে আফগানিস্তানের ঘোর প্রদেশের আব্দুল গনির সঙ্গে৷ তার ১৮ বছর বয়সি ছেলে আব্দুল ওয়ালি সম্প্রতি স্কুলের পড়াশোনা শেষ করে পরিবারের ভরণপোষণ চালানোর জন্য ইরানে চলে এসেছেন৷
গনি ডিডাব্লিউকে বলেন, ‘‘সোমবার আমি আমার ছেলের সাথে কথা বলেছি এবং তাকে কিছু টাকা পাঠাতে বলেছিলাম৷ গত রাতে (১৮ জুন) তার নিয়োগকর্তা ফোন করে আমাকে জানান যে, সে একটি হামলায় নিহত হয়েছে৷’’
তিনি বলেন, ‘‘আমার হৃদয় চুরমার হয়ে গেছে৷ আমার ছেলে চলে গেছে৷’’
অনেক আফগানের জন্য দেশে ফেরারও উপায় নেই
তালেবান শাসনামলে নির্যাতনের আশঙ্কায় থাকা বেশিরভাগ আফগান শরণার্থীর জন্য আফগানিস্তানে ফিরে যাওয়া কোনো বিকল্প নয়৷ নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আফগানিস্তানের নিরাপত্তা বাহিনীর একজন সাবেক সদস্য ডিডাব্লিউকে বলেছেন, তিনি ক্রমাগত ভয়ের মধ্যেই বাস করছেন৷
তিনি বলেন, ‘‘আমরা আফগানিস্তানে ফিরতে পারবো না৷ তালেবানরা আমাদের বিচার করবে৷’’
তালেবান-পূর্ববর্তী সরকারের সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এবং ইরানে দেশটির সাবেক রাষ্ট্রদূত মোহাম্মদ ওমর দাউদজাই ডিডাব্লিউকে বলেন, ইসরায়েল-ইরান সংঘাত দীর্ঘস্থায়ী হলে অনেকেই আফগানিস্তানে ফিরে যেতে বাধ্য হতে পারেন বলে শঙ্কা তার৷
দাউদজাই বলেন, ‘‘তালেবানের ক্ষমতা দখলের পর ইরানে পালিয়ে যাওয়া সাবেক সামরিক ও সরকারি কর্মচারীদের নিয়ে আমি বিশেষভাবে উদ্বিগ্ন৷ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে তালেবানের জবাবদিহিতা এবং প্রত্যাবর্তনকারীরা যাতে নির্যাতনের শিকার না হয়, সেটা নিশ্চিত করতে হবে৷’’
অভিবাসীদের সতর্ক থাকার আহ্বান
মানব-পাচারকারী চক্রগুলো সংঘাতে অনিশ্চয়তার সুযোগ কাজে লাগিয়ে তৎপর হয়ে উঠেছে৷ ইরানে গুজব ছড়িয়ে পড়েছে যে তুরস্ক সীমান্ত খুলে দিয়েছে৷
কিন্তু অভিবাসী অধিকার কর্মী আলী রেজা কারিমি সীমান্ত খুলে দেয়ার এমন দাবিকে পাচারকারীদের ছড়িয়ে দেয়া মিথ্যা তথ্য বলে উল্লেখ করেছেন৷ তিনি জানিয়েছেন, এখন বিমান চলাচল বন্ধ রয়েছে এবং তুরস্কের সীমান্ত কেবল বৈধ পাসপোর্ট এবং ভিসাধারী ইরানি নাগরিক এবং ভ্রমণকারীদের জন্য খোলা রয়েছে৷ আফগান অভিবাসীদের জন্য এই সীমান্ত বন্ধ বলেও জানান তিনি৷
আফগান শরণার্থীরা যাতে পাচারকারীদের মিথ্যাচারের ফাঁদে না পড়েন, সে বিষয়ে সতর্ক থাকার আহ্বান জানিয়েছেন কারিমি৷
দাউদজাই ডিডাব্লিউকে বলেছেন, ‘‘আমি জেনেছি যে, চোরাচালানকারীরা সীমান্ত খোলা থাকার দাবি করে শরণার্থীদের তুরস্কের দিকে যেতে বলছে৷ এটি আরেকটি ট্র্যাজেডিতে পরিণত হয়৷ তারা গিয়ে দেখে যে সীমান্ত আসলে বন্ধ৷’’
ইরানে আফগান শরণার্থীরা আপাতত যেখানে আছেন সম্ভব হলে সেখানেই থাকার আহ্বান জানিয়েছেন দাউদজাই৷
তিনি বলেন, ‘‘যতটা সম্ভব আমাদের জনগণকে যেখানে আছে সেখানেই থাকা উচিত এবং ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করা উচিত৷ যদি কোনও কারণে তাদের সরে যেতে বাধ্য করা হয়, তাহলে তাদের আফগান সীমান্তের দিকে যাওয়া উচিত - তুরস্কের দিকে নয়৷’’
শাকিলা এব্রাহিমখিল, আহমাদ ওয়াহিদ আহমাদ/এডিকে