ইউসুফের জন্য দোভাষী ও পাচক, অভিজিতের জন্য শুভেন্দু
১৩ মার্চ ২০২৪একজন হলেন ভারতের সাবেক ক্রিকেট তারকা। গুজরাট থেকে পশ্চিমবঙ্গে ভোটের ময়দানে নেমে পড়েছেন ইউসুফ। অপরজন বিচারপতির কুর্সিকে বিদায় জানিয়ে নেমেছেন রাজনীতিতে। অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্য়ায় তারপর সময় নষ্ট না করে প্রচার শুরু করেছেন নিজের সম্ভাব্য লোকসভা আসনে।
বহরমপুরে ইউসুফ
লোকসভা নির্বাচনের জন্য তৃণমূল যে ৪২ জন প্রার্থীর নাম ঘোষণা করেছে, তার মধ্যে বড় চমক জাতীয় ক্রিকেট দলের সাবেক তারকা ইউসুফ পাঠান। ব্রিগেডের মঞ্চে ইউসুফকে হাঁটিয়ে গোটা দেশে নজর কেড়েছেন তৃণমূল নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
আইপিএলে কলকাতা নাইট রাইডার্স দলের হয়ে খেলা ইউসুফ শুধু ভোটেই নামেননি, তিনি লড়াই করতে চলেছেন প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীর চৌধুরীর বিরুদ্ধে। বহরমপুর কেন্দ্রে ইতিমধ্যে ইউসুফের সমর্থনে দেয়াল লিখন শুরু করে দিয়েছে তৃণমূল।
একে নতুন পিচে পরীক্ষা দিতে চলেছেন পাঠান। তার উপর প্রতিদ্বন্দ্বী পাঁচবারের সাংসদ, দাপুটে নেতা অধীর। লোকসভায় কংগ্রেসের নেতা ও কট্টর তৃণমূল বিরোধী হিসেবে পরিচিত অধীর ইতিমধ্যেই হুংকার ছেড়েছেন, বহরমপুরে হারলে রাজনীতি ছেড়ে দেবেন!
তাই ইউসুফের জন্য বাড়তি ঘাম ঝরাতে হচ্ছে তৃণমূল জেলা নেতৃত্বকে। সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব পাচ্ছে নতুন প্রার্থীর ভাষার সমস্যা।
বহরমপুর লোকসভা কেন্দ্রের মধ্যে রয়েছে সাতটি বিধানসভা-- বহরমপুর, বেলডাঙা, নওদা, রেজিনগর, কান্দি, ভরতপুর ও বড়ঞা। বড় গ্রামীণ এলাকায় প্রচার চালাতে হবে পাঠানকে। বাংলা ভাষায় কথা বলা তার পক্ষে সম্ভব নয়। বোঝার ক্ষেত্রেও সীমাবদ্ধতা রয়েছে। ফলে দোভাষীর উপর নির্ভর করতে চলেছে শাসক দল।
দোভাষী ও পাচকের সন্ধান
তৃণমূল সূত্রের খবর, প্রতিটি বিধানসভা এলাকার জন্য আলাদা আলাদা দোভাষীর দল গঠন করা হচ্ছে। প্রতি দলে একাধিক দোভাষী থাকবেন, যারা হিন্দি ও ইংরেজি ভাষায় দক্ষ। এরা জনসভায় প্রার্থীর বক্তব্য বাংলা ভাষায় জনতার কাছে পৌঁছে দেবেন।
২২ গজে মারকুটে ব্যাটার হিসেবে পরিচিত ছিলেন ইউসুফ পাঠান। তার অসংখ্য গুণমুগ্ধ রয়েছেন পশ্চিমবঙ্গে। সাবেক ক্রিকেটার কোনো এলাকায় গেলে ভিড় জমে যাবে বলে মনে করছেন তৃণমূল নেতারা। সেই সময় প্রার্থীর সঙ্গে কথা বলতে চাইবেন গ্রামবাসী। এক্ষেত্রে যাতে মত বিনিময়ের সমস্যা না হয়, সেটাও খেয়াল রাখবেন দোভাষীরা।
লোকসভা নির্বাচনে প্রার্থী যদি ভূমিপুত্র না হন, তাহলে তাকে ওই কেন্দ্রে অস্থায়ীভাবে বসবাস করতেই হয়। নিয়মিত প্রচার ও দলীয় কর্মসূচিতে অংশ নিতে বাড়ি ভাড়া নিয়ে থাকতে হয়। সাবেক ক্রিকেট তারকা যে ধরনের জীবনযাত্রায় অভ্যস্ত, তার সঙ্গে সাযুজ্য রেখে উপযুক্ত বাড়ি খোঁজা হচ্ছে বহরমপুরে।
তৃণমূল নেতাদের নজর রাখতে হচ্ছে পাঠানের খাবারদাবারের দিকেও। গুজরাটের ছেলে একটানা বাঙালি খাবার খেতে পারবেন না বলে তার জন্য গুজরাটি পাচকের কথা ভেবেছেন স্থানীয় নেতৃত্ব। চৈত্র, বৈশাখের প্রচন্ড তাপপ্রবাহের মধ্যে প্রচার করতে হবে ইউসুফকে। গুজরাতি খাবার যেন এই পরিবেশের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হয়, সেটাও বিবেচনায় রাখতে হচ্ছে।
এনিয়ে তৃণমূলকে কটাক্ষ করে বহরমপুরের সাবেক কংগ্রেস বিধায়ক মনোজ চক্রবর্তী বলেন, ''এর আগেও বহিরাগত প্রার্থীরা এসেছেন ইন্দ্রনীল সেন বা অন্যান্যের মতো। কিন্তু কী ফল হয়েছে সবাই জানেন। এখানে গুজরাট থেকে এসে বাড়িভাড়া নেবেন আর ভোটের পর খুঁজে পাওয়া যাবে না।''
তৃণমূল মুখপাত্র শান্তনু সেনের প্রশ্ন, ''প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী যদি গুজরাট থেকে বারাণসী গিয়ে লড়তে পারেন, তা হলে জাতীয় তারকা ইউসুফ পাঠানের ক্ষেত্রে কী সমস্যা?''
তমলুকে অভিজিৎ
সদ্য সাবেক বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়তার পদ ছেড়ে যোগ দিয়েছেন বিজেপিতে। নিয়োগ দুর্নীতি মামলাকে কেন্দ্র করে চাকরিপ্রার্থীদের একাংশ তাকে 'ভগবান' তকমা দিয়েছেন। তার একাধিক রায় ও পর্যবেক্ষণে রাজ্যের স্কুলে নিয়োগে দুর্নীতিতে সিলমোহর পড়েছে। কিন্তু তিনি রাজনীতিতে যোগ দেয়ার পরই প্রশ্ন উঠেছে, এইভাবে রাতারাতি বিচারপতির পদ থেকে ইস্তফা দিয়ে রাজনীতিতে য়োগ দিয়ে ভোটে লড়াই করা কতটা নৈতিক?
অভিজিতের বিজেপিতে যোগদান নিয়ে যে হইচই শুরু হয়, তার রেশ এখনো কাটেনি। তিনি পূর্ব মেদিনীপুরের তমলুক আসন থেকে পদ্ম প্রতীকে প্রার্থী হতে পারেন বলে জল্পনা। নাম ঘোষণার আগে তার তারকা ভাবমূর্তিকে কাজে লাগাতে চাইছে বিজেপি। তাই বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী মঙ্গলবার তাকে নিয়ে তমলুকে গিয়েছেন।
বিজেপির মতো শৃঙ্খলাবদ্ধ দলে নাম ঘোষণার আগে এ ধরনের প্রচারমূলক সফর তেমন দেখা যায় না। কার্যত তারকার ঢঙে আজ বিজেপি কর্মীরা স্বাগত জানান সাবেক বিচারপতিকে। বাইক মিছিল করে অভিজিৎকে নিয়ে আসা হয় তমলুকে। সেখানে বিরোধী দলনেতা বরণ করেন তাকে। দুজনে আসেন বিজেপির দলীয় কার্যালয়ে।
আজ তমলুকের বিখ্যাত বর্গভীমা মন্দিরে যান অভিজিৎ। তাকে ঘিরে বিজেপি কর্মীদের উচ্ছ্বাস ছিল নজরকাড়া। এই কেন্দ্রে ইতিমধ্যে প্রার্থী ঘোষণা করেছে তৃণমূল কংগ্রেস। তাদের প্রার্থী দেবাংশু ভট্টাচার্য প্রচারেও নেমে পড়েছেন। তাই নাম ঘোষণার আগেই আসরে অভিজিৎ।
বিজেপি সূত্রের খবর, অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায় তমলুকে থেকে গ্রামে গ্রামে প্রচার চালাবেন। তার পক্ষে নির্বাচনের দায়িত্ব অনেকটাই কাঁধে তুলে নিয়েছেন জেলার ভূমিপুত্র শুভেন্দু। সাবেক বিচারপতির মতো উচ্চ মর্যাদাসম্পন্ন ব্যক্তির পক্ষে যাতে প্রচারের পর্ব স্বাচ্ছন্দের হয়, সেদিকের লক্ষ্য রাখছেন বিজেপি জেলা নেতৃত্ব।
এই নির্বাচনে দেখা যাবে রাজনীতির বাইরে থাকা আরও তারকাকে। যেমন হুগলি কেন্দ্রের প্রার্থী অভিনেত্রী রচনা বন্দ্যোপাধ্যায়। তবে আলোচনা বেশি ইউসুফ ও অভিজিৎকে নিয়ে।
প্রবীণ সাংবাদিক দেবাশিস দাশগুপ্ত ডয়চে ভেলেকে বলেন, ''ইউসুফ পাঠানকে নিয়ে তৃণমূল যে রাজকীয় ব্যাপার ঘটাচ্ছে, তা নজিরবিহীন। বোঝা যাচ্ছে না যে তিনি ভোটে দাঁড়াচ্ছেন, নাকি কোনো অভিষেকে যাচ্ছেন। বহরমপুরের খেটে খাওয়া, সংখ্যালঘু এলাকায় এই তারকা ট্রিটমেন্ট কতটা ভাল চোখে জনতা নেবে, প্রশ্ন থেকে যাচ্ছে। তৃণমূল যেখানে মা মাটি মানুষের কথা বলে, সেখানে এরকম রাজকীয় ট্রিটমেন্ট হিতে বিপরীত না হয়ে যায়। অভিজিতের ক্ষেত্রেও একই কথা বলা চলে।''