ইউনূস-মোদী বৈঠক: দ্বিপাক্ষিক আলোচনার সূত্রপাত
৪ এপ্রিল ২০২৫অন্যদিকে ভারতীয় বিশ্লেষকদের মতে, ভারত যে বাংলাদেশের সঙ্গে সুসম্পর্ক রাখতে চায় এই বৈঠক সেই বার্তা দিচ্ছে৷
থাইল্যান্ডের রাজধানী ব্যাংককের সাংরিলা হোটেলে বিমসটেক শীর্ষ সম্মেলন শেষে শুক্রবার স্থানীয় সময় দুপুরের পর দুই প্রতিবেশী দেশের শীর্ষ নেতারা দ্বিপক্ষীয় বৈঠক করেন৷ অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্ব নেয়ার পর নরেন্দ্র মোদীর সঙ্গে অধ্যাপক ইউনূসের প্রথম বৈঠক এটি৷
বৈঠকের পর বাংলাদেশ ও ভারত উভয় দেশের পক্ষ থেকে সাংবাদিকদের ব্রিফিং করা হয়েছে৷ বাংলাদেশের প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব সফিকুল আলম জানিয়েছেন, ‘‘বৈঠকে শেখ হাসিনার প্রত্যর্পণসহ দ্বিপাক্ষিক বিষয় তুলে ধরা হয়েছে৷'' বৈঠক ‘‘খুবই গঠনমূলক ও ফলপ্রসূ'' বলেও মন্তব্য করেন তিনি৷
অন্যদিকে ভারতের পররাষ্ট্র সচিব বিক্রম মিশ্রি বলেন, ‘‘প্রধানমন্ত্রী (নরেন্দ্র মোদী) একটি গণতান্ত্রিক, স্থিতিশীল, শান্তিপূর্ণ, প্রগতিশীল এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক বাংলাদেশের প্রতি ভারতের সমর্থন পুনর্ব্যক্ত করেছেন৷’’
কী কথা হলো?
বৈঠক শেষে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম বলেন, ‘‘বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের পারস্পরিক যতগুলো ইস্যু আছে, সবগুলো নিয়েই কথা হয়েছে বৈঠকে৷ আমাদের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট যতগুলো বিষয় ছিল সবগুলোই প্রধান উপদেষ্টা বৈঠকে বলেছেন৷ যেমন: শেখ হাসিনার প্রত্যর্পণ বিষয়ে কথা হয়েছে৷ শেখ হাসিনা ওখানে বসে যে উসকানিমূলক মন্তব্য করছেন, সেগুলোর বিষয়ে কথা বলেছেন৷ সীমান্ত হত্যা নিয়ে কথা হয়েছে৷ আমাদের দুই দেশের মধ্যে যে গঙ্গা পানি চুক্তির মেয়াদ শেষ হয়ে গেছে , চুক্তি আবার হওয়ার কথা হচ্ছে, তিস্তার পানি-এই সবগুলো নিয়েই কথা হয়েছে৷’’
অন্যদিকে ভারতের পররাষ্ট্র সচিব বিক্রম মিশ্রি সাংবাদিকদের বলেন, ‘‘প্রধানমন্ত্রী একটি গণতান্ত্রিক, স্থিতিশীল, শান্তিপূর্ণ, প্রগতিশীল এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক বাংলাদেশের প্রতি ভারতের সমর্থন পুনর্ব্যক্ত করেছেন৷ তিনি জোর দিয়ে বলেন যে, ভারত সম্পর্কের ক্ষেত্রে জনগণকেন্দ্রিক দৃষ্টিভঙ্গিতে বিশ্বাস করে৷ তিনি দীর্ঘ সময় ধরে দুই দেশের মধ্যে সহযোগিতার কথা তুলে ধরেন যা উভয় দেশ ও দেশের জনগণকে বাস্তব সুবিধা দিয়েছে৷ এই আলোকে বাস্তবতার নিরিখে একটি ইতিবাচক ও গঠনমূলক সম্পর্ক গড়তে ভারতের আকাঙ্ক্ষার কথা তিনি প্রফেসর ইউনূসকে জানিয়েছেন৷৷’’
সম্প্রতি চীন সফরে গিয়ে মুহাম্মদ ইউনূস ভারতের সেভেন সিস্টার্সকে ‘স্থলবেষ্টিত' হিসেবে উল্লেখ করে বক্তব্য রাখেন৷ এই অঞ্চলে বাংলাদেশকে ‘সমুদ্রের একমাত্র অভিভাবক' হিসেবেও উল্লেখ করেন তিনি৷ তার এই বক্তব্যকে ভারতের রাজনীতিবিদেরা ভালোভাবে নেননি৷ প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রী জয়শঙ্করও৷
শুক্রবার বিক্রম মিশ্রি বলেন, ‘‘প্রধানমন্ত্রী আহ্বান জানিয়েছেন (সম্পর্কের) পরিবেশ নষ্ট করে, এমন যে-কোনো বাগাড়ম্বরপূর্ণ বক্তব্য এড়িয়ে চলাই ভালো৷’’
আলোচনায় সীমান্তের প্রসঙ্গ উঠে আসার কথা জানিয়েছেন ভারতের মুখপাত্রও৷ বলেন, ‘‘তিনি সীমান্তে স্থিতিশীলতা ও নিরাপত্তা রক্ষায় অবৈধভাবে সীমান্ত পারাপার প্রতিরোধে , বিশেষ করে রাতে, আইনের কঠোর প্রয়োগের ওপর জোর দিয়েছেন৷’’
ভারতের পররাষ্ট্র সচিব বলেন , ‘‘প্রধানমন্ত্রী মোদী বাংলাদেশেহিন্দুসহ সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা ও সুরক্ষা নিয়ে ভারতের উদ্বেগের কথা তুলে ধরেছেন এবং বাংলাদেশ সরকার তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করবে বলে আশা প্রকাশ করেছেন৷ তিনি নৃশংসতার সব ঘটনার পুঙ্খানুপুঙ্খ তদন্তের ওপরও জোর দিয়েছেন৷’’
বিশ্লেষকেরা যা বলছেন
‘মোদী-ইউনূস বৈঠক অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ' বলে মনে করেন ভারতীয় সেনা বাহিনীর সাবেক লেফটন্যান্ট জেনারেল উৎপল ভট্টাচার্য৷ ডয়চে ভেলেকে তিনি বলেন, ‘‘ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক ঐতিহাসিক৷ সে দেশে যে সরকারই থাকুক না কেন, ভারত সুসম্পর্ক বজায় রাখতে চায়৷ কারণ, ভারতের ‘প্রতিবেশী প্রথম' নীতিতে বাংলাদেশের গুরুত্ব অপরিসীম৷’’
তার মতে, বৈঠকে ভারত বাংলাদেশের সঙ্গে সুসম্পর্কের বার্তাই দিয়েছে৷ তবে পাশাপাশি নিজেদের উদ্বেগের বিষয়গুলিও স্পষ্ট করে দিয়েছে৷
ভারতের সাবেক আইপিএস অফিসার এবং ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক বিষয়ে বিশেষজ্ঞ শান্তনু মুখোপাধ্যায়ের কাছে এই বৈঠককে ‘সৌজন্য সাক্ষাৎ' বলেই মনে হয়েছে৷ কারণ, হিসেবে তিনি বলেন, ‘‘আলোচনায় এমন কোনো কথা ওঠেনি, যা ভারত আগে বাংলাদেশকে জানায়নি৷’’
শান্তনুর মতে, বৈঠকে ভারতের প্রধানমন্ত্রী বুঝিয়ে দিয়েছেন, ভারত বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয় নিয়ে কথা বলতে চায় না৷ ডয়চে ভেলেকে তিনি বলেন, ‘‘কিন্তু (ভারত)প্রতিবেশী হিসেবে বাংলাদেশের গুরুত্ব স্বীকার করে৷ দুই দেশের সুসম্পর্ক যে ভারতের কাছে গুরুত্বপূর্ণ তা আবার স্পষ্ট করে দেয়া হয়েছে৷ কিন্তু এই পরিস্থিতিতে ভারতের যে আশঙ্কাগুলি তৈরি হয়েছে তা-ও বাংলাদেশকে জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী৷’’
তবে কী আলোচনা হয়েছে তার চেয়ে বৈঠক অনুষ্ঠিত হওয়াকে গুরুত্বের সঙ্গে দেখতে চান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাক ড. লাইলুফার ইয়াসমিন৷ তিনি বলেন, ‘‘কী আলোচনা হলো তার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ হলো ইউনূস-মোদীর দেখা হওয়া, বৈঠক হওয়া৷ ৫ আগস্ট হাসিনা সরকারের পতনের পর এই প্রথম দুই দেশের সরকার প্রধানের সঙ্গে বৈঠক হলো৷ সম্পর্কের যে অস্বস্তিকর অবস্থা চলছিলো, আমি মনে করি তার বরফ গলা শুরু হলো৷’’
এর মধ্য দিয়ে দুই দেশের মধ্যে আলোচনার ক্ষেত্র তৈরি হয়েছে বলে ধারণা করেন এই অধ্যাপক৷ তিনি বলেন, ‘‘দুই দেশের সরকার প্রধান তাদের ইস্যুগুলো বলেছেন৷ এখন সেই ইস্যু নিয়ে কাজ করা যাবে৷ ভারত বাংলাদেশের ইস্যুগুলো জানলো৷ আর বাংলাদেশও ভারতের ইস্যুগুলো জানলো৷ ফলে দুই দেশই বিষয়গুলো নিয়ে ভাবতে পারবে৷ যদি কথা না হয়, আলোচনা না হয়, তাহলে তো সম্পর্ক এগোবে না৷ এই বৈঠকটি তার একটি ক্ষেত্র তৈরি করলো বলে আমি মনে করি৷’’
একই মত সাবেক কূটনীতিক সাকিব আলীরও৷ তিনি বলেন, ‘‘আমার বিবেচনায় বাংলাদেশের প্রধান উপদেষ্টা ও ভারতের প্রধানমন্ত্রীর মধ্যে একটি ওয়ার্কিং রিলেশনশিপ থাকা উচিত৷ যেকোনো সংকটে তারা যেন সরাসরি কথা বলতে পারেন৷ দুই দেশের মধ্যে একটা আস্থার সম্পর্ক দরকার৷ আমি মনে করি, এই বৈঠকটি তার সুযোগ তৈরি করেছে৷''
তবে স্বল্প সময়ের এই বৈঠককে ততটা গুরুত্ব দিতে নারাজ সাবেক রাষ্ট্রদূত মোফাজ্জল করিম৷ তিনি বলেন, ‘‘এই বৈঠক কোনো গুরুত্ব বহন করে না৷ একটি সম্মেলনের সাইডলাইনে তারা কথা বলেছেন মাত্র৷ তবে এমন যদি হতো তারা এই বৈঠকে সিদ্ধান্ত নিতে পারতেন যে, অল্প সময়ের মধ্যে তারা একটি পরিপূর্ণ দ্বিপাক্ষিক বৈঠকে বসবেন, তাহলে সেটাকে অগ্রগতি বলতে পারতাম৷’’