‘বাণিজ্যকে উচ্চতর কূটনীতির মাধ্যমে বের করে আনতে হবে'
২৩ মে ২০২৫ট্রান্সশিপমেন্টের জন্য ভারতের বন্দর ব্যবহার বাংলাদেশের জন্য আগেই বন্ধ করা হয়েছিল। এবার স্থলবন্দর দিয়ে ভারতের বাজারে পন্য রপ্তানি বন্ধ করা হলো। ভারতের এই সিদ্ধান্ত বাংলাদেশের রপ্তানিতে কতটা প্রভাব পড়তে পারে? পণ্য রপ্তানিতে খরচ বাড়লে তার প্রভাব কি কারখানাতেও পড়তে পারে ?
ডয়চে ভেলে : বাংলাদেশের পণ্য স্থলপথ দিয়ে রপ্তানিতে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে ভারত। এই সিদ্ধান্ত কি রাজনৈতিক?
ড. মামুন রশীদ : আমি যতটুকু পর্যালোচনা করে দেখেছি, এটা যত না বেশি বানিজ্য-প্রসূত, তার চেয়ে বেশি পারস্পরিক রাজনীতি-প্রসূত।
এই বিধিনিষেধে পণ্য রপ্তানিতে খরচ বাড়লে ফলাফল কী হতে পারে?
প্রতিযোগিতামূলক বাজারে আল্টিমেটলি খরচটা যদি বায়ারের কাঁধে গিয়ে পড়ে স্বাভাবিকভাবেই সেই ক্রেতা দেশ, গোষ্ঠী কিংবা প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশের পণ্য কেনার ক্ষেত্রে এই পদ্ধতিতে ভারতের মাধ্যমে নেওয়া কমিয়ে দেবে। এটাই স্বাভাবিক। কারণ, যখন খরচ বেড়ে যায়, সেটা কর হোক আর পণ্য পরিবহণের খরচ হোক, সেক্ষেত্রে ক্রেতা প্রতিষ্ঠান দু'বার ভাববে পণ্য কেনার আগে। স্বাভাবিকভাবে দাম বেড়ে যাবে এবং পণ্য বিক্রি কমে যাবে।
যেসব কোম্পানি পণ্য রপ্তানি করে, তারা আশঙ্কা করছেন যে রপ্তানি হাতছাড়া হতে পারে। এতে কি কারখানা বন্ধ হওয়ার আশংকা তৈরি হচ্ছে কিনা?
যেমন আমাদের প্রাণের পণ্য প্রচুর ভারতে যায় এবং বেশিরভাগ পণ্য স্থলবন্দর দিয়ে যায়। স্বাভাবিকভাবে প্রণ-এর মতো অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের পণ্য যেগুলো যাচ্ছে, এমনকি আপনি জেনে থাকবেন আমাদের বেশ কিছু গার্মেন্টস বিলাতের একটি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে সেখানে যায়। এছাড়া কিছু স্পোর্টস অয়্যার ওই সমস্ত রিটেল চেইনে প্রচুর পাওয়া যাচ্ছিল। এখন এই নিষেধাজ্ঞার কারণে এই পণ্যগুলো অনেক বেশি চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বে। এখন পরিবহন খরচ যদি বেড়ে যায় বা বিকল্প পথে যদি পরিবহন করতে হয় তাহলে এর প্রভাব তো পড়বেই। আমাদের যারা ভারতের বাজারে বা রিটেল চেইনগুলোতে রপ্তানি করে থাকেন, তাদের পণ্য রপ্তানি কমবে। শুধুমাত্র ভারতের বাজারে পণ্য রপ্তানি করে আমাদের এমন প্রতিষ্ঠান খুব কম। প্রাণও কিন্তু ভারত ছাড়া অন্য অনেক দেশে পণ্য রপ্তানি করে। ফলে ওই ভারতের অংশে রপ্তানি কমে যেতে পারে, চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে পারে। ফলে সেই প্রোডাকশন প্রতিষ্ঠানগুলোর শ্রমিকরাও চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে পারেন যদি না তাদের অন্য লাইনে ডাইভার্ট করা যায়।
ভারতে কিছু বিদেশি কোম্পানি আছে ,যারা ভারতে বিক্রির জন্য বাংলাদেশের পোশাক নেয়। সেই কোম্পানিগুলো কি আর পোশাক নেবে?
যেমন মার্কস অ্যান্ড স্পেনসার, ডেকাথলন মূলত স্পোর্টস ওয়ারের বিদেশি চেইন। স্বাভাবিকভাবে তাদের তো খরচ বেড়ে যাবে। এখন খরচ বাড়লেও তারা আগ্রহ দেখাতে পারে, যদি ভারতের পণ্যের চেয়ে দাম কম থাকে। ওই সুপারস্টোরগুলোতে বা চেইনগুলোতে পণ্যের মূল্য বেড়ে গেলে ভারতের ব্যক্তি পর্যায়ে ক্রেতারা কিন্তু তখন ভারতের পণ্যটাই কিনবে। মার্কস এন্ড স্পেনসারে কিন্তু বেশ কিছু শার্ট যাচ্ছে, প্যান্ট যাচ্ছে, টি-শার্ট যাচ্ছে বাংলাদেশ থেকে। বাংলাদেশ থেকে টমি হিলফিগারের পণ্য যাচ্ছে, অ্যারোর শার্ট যাচ্ছে, সেগুলো যদি প্রতিযোগিতায় টিকতে না পারে স্বাভাবিকভাবেই রপ্তানি কমে যাবে।
ভারত হয়ে আমরা কী পরিমাণ পণ্য বিদেশে রপ্তানি করি?
একটা হলো কী পরিমান পণ্য আমরা বিদেশে রপ্তানি করি, সেটা আমাদের ৫০০ মিলিয়নের ডলারের মতো। প্রথম দিকে দেখেছি আমরা ভারতের বন্দর ব্যবহার করতে দেবে না ট্রান্সশিপমেন্টের জন্য। এবার যেটা করেছে, ভারতের স্থলবন্দর ব্যবহার করে ভারতের সুপারশপ ও চেইনগুলোতে এবং তাদের বাজারে বিক্রির জন্য পণ্যের কথা বলেছে। গত অর্থ বছরে ৯ বিলিয়ন ডলারের পণ্য আমরা ভারত থেকে কিনেছি এবং এক দশমিক ৬ বিলিয়ন ডলারের পণ্য ভারতে রপ্তানি করেছি। সেটার মধ্যে বেশিরভাগই আমাদের অনেকগুলো পণ্যকে ভারত শুল্কমুক্ত ঘোষণা করেছে বা অতি কম শুল্কের পণ্যগুলো ছাড়া বেশিরভাগ পণ্যই আমাদের তৈরি পোশাক পণ্য। এগুলো তো ক্ষতিগ্রস্থ হবেই।
এটা বিদেশে রপ্তানির মোট কত শতাংশ?
আমাদের সবমিলিয়ে রপ্তানি যদি হয়ে থাকে প্রায় ৪৫ বিলিয়ন ডলার, এর মধ্যে ভারতে দেড় বিলিয়নের কিছু বেশি। আমাদের ৩-৪ শতাংশ রপ্তানি ভারতে যাচ্ছে।
ভারতের বিধিনিষেধ বৈশ্বিক বাণিজ্যে কতটা প্রভাব ফেলতে পারে?
আপনারা তো জানেন প্রত্যেক রাষ্ট্রের সঙ্গেই আলাদা আলাদা রপ্তানি সম্পর্ক আছে। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে, ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে, ক্যানাডার সঙ্গে এমনকি অন্য সকল দেশের সঙ্গে আমাদের আলাদা আলাদা রপ্তানির সম্পর্ক রয়েছে। এগুলো যার যার টেরিফ পলিসি দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। ভারতে পার ক্যাপিটা ইনকাম বাড়ছে, ভারতে মধ্যবিত্তের সংখ্যা বাড়ছে ফলে ব্যান্ডেড শপগুলো সেখানে যাচ্ছে। কৃত্রিম বাজার তৈরি না করা হলে আমাদের আরো অনেক বেশি ব্যান্ডেড পণ্য ভারতে যেতো। শুধু গার্মেন্ট না, স্পোর্টস ওয়ার না, আমাদের অনেক বেশি জুতা সেখানে যেতে পারতো। কারণ আমরা মার্কস অ্যান্ড স্পেনসারে জুতা রপ্তানি করছি। এখানে কিন্তু ভারত নিজেও জুতা রপ্তানি করে। আমাদের প্লাস্টিক পণ্য, চামরাজাত পণ্য যেতে পারতো। ফলে হঠাৎ করে একটা বাধা আসাতে বা চ্যালেঞ্জ আসাতে আমরা যে এগোচ্ছিলাম সেখান থেকে পিছনে চলে গেলাম।
এতে কি বাংলাদেশের প্রতি বৈশ্বিকভাবে আস্থার সংকট দেখা দিতে পারে?
এটা আমি মনে করছি না। কারণ, এই সংকট ভারত-বাংলাদেশ আন্তঃদেশীয়। আগের সরকারের সঙ্গে ভারতের বন্ধুত্ব, এই কারণে আমরা সরাসরি ভারতকে দায়ি করেছি। আর বর্তমান সরকারের ক্ষেত্রে ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক ব্যবস্থাপনায় সংকট, চ্যালেঞ্জ এবং ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক ব্যবস্থাপনার দুর্বলতার বর্হিঃপ্রকাশ ঘটছে।
ভারতের এই সিদ্ধান্তে বাংলাদেশের কী করা উচিত বলে মনে করেন?
আমি মনে করি, এটা কমার্শিয়াল ডিপ্লোম্যাসি। আরো বেশি ডিপ্লোম্যাটিক্যালি এনগেজড হতে হবে। ভারত আমাদের বিরাট প্রতিবেশী। ভারতের উপর আমাদের বিভিন্ন ধরনের প্রকাশ্য, অপ্রকাশ্য নির্ভরশীলতা রয়েছে। ভারতের ব্যক্তিরা, প্রোফেশনালদের আন্তর্জাতিক সংগঠনগুলোতে নিবিড়তা বাড়ছে। সেক্ষেত্রে গ্লোবাল সাপ্লাই চেইনে ভারতের একটা বিরাট প্রভাব রয়েছে। প্রনিধানযোগ্য প্রভাব রয়েছে। এমনকি আপনি যেটা সুন্দরভাবে বলেছেন, অন্যান্য দেশেও আমাদের রপ্তানিকে প্রভাবিত করতে পারবে কিনা? আমরা ইদানিংকালে দেখতে পাচ্ছি অনেক আন্তর্জাতিক সংস্থায় নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে ভারতীয়দের সংখ্যা বাড়ছে। সেটাও কিন্তু আমাদের চ্যালেঞ্জ হিসেবে আর্বিভূত হচ্ছে। সেই কারণে ভারতের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ককে বিশেষ করে বাণিজ্যিক সম্পর্ককে এবং কূটনৈতিক সম্পর্ককে অবশ্যই আরো দক্ষতার সঙ্গে, সক্ষমতার সঙ্গে ব্যবস্থাপনা করা উচিত বলে আমি মনে করি। শুধুমাত্র হিংসা বিদ্বেষ ছড়িয়ে আমরা ভারতকে একটা ব্যবস্থাপনার মধ্যে আনতে পারবো বলে আমার মনে হয় না।
যদি রাজনৈতিক সমঝোতা না হয় ,তাহলে দীর্ঘমেয়াদে আমাদের অর্থনীতিতে কি কোন প্রভাব পড়তে পারে?
প্রথমে আমদানির কথা বলি, আমদানিকে বহুমুখিকরণ করার জন্য আমরা কিছু কিছু ভোগ্য পণ্য পাকিস্তান থেকে, তুরস্ক থেকে আনছি, আরো আনার প্ল্যান করছি। কিন্তু আমাদের খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তন না হলে ভারতের সঙ্গ আমাদের নিকট প্রতিবেশী হিসেবে তাদের পেঁয়াজের ধরন, লবনের গন্ধ, তাদের মাছ, তাদের অন্যান্য পণ্য সামগ্রী, তাদের ফল এগুলো আমাদের মতোই। স্বাভাবিকভাবে আমরা এবার পাকিস্তান থেকে কিছু পেঁয়াজ এনেছিলাম, আমাদের অভিজ্ঞতা ভালো না। তুরস্ক থেকে কিছু ভোগ্যপণ্য এনেছিলাম, সে অভিজ্ঞতাও ভালো না। শিপমেন্টের কারণে হোক অনেকদিন লেগে যাচ্ছে। চীন থেকে আমরা কিছু ভোগ্যপণ্য আমদানি করি। এক্ষেত্রে একটা হচ্ছে শিপমেন্ট কস্ট, আরেকটা হচ্ছে আমাদের পণ্যটার স্বাদ। ওই পণ্যটার সঙ্গে ভারতের আদা, পেঁয়াজ, রসুন, চাল প্রতিযোগিতায় অনেক এগিয়ে আছে। আমরা খুব দ্রুত ও অল্প দামে ভারত থেকে আনতে পারি। কোন সময় যদি কোনো ক্রাইসিস হয় তখন ভারতের পূর্বাঞ্চল থেকে আমাদের পণ্য আনতে লাগে সর্বোচ্চ ৬ দিন এবং সর্বনিম্ন দেড় দিন। আর পশ্চিমাঞ্চল থেকে, অর্থাৎ ,গুজরাট বা বোম্বে থেকে আনলে লাগে সর্বোচ্চ ৬ দিন এবং সর্বনিম্ন ৪ দিন। অন্যদিকে আমরা যদি চীনের সাংহাই পোর্ট থেকে আনি তাহলে সর্বনিম্ন লাগে ২১ দিন। পাকিস্তান থেকে আনলে ১২-১৪ দিন লাগে। তুরস্ক থেকে আনলে ৩৫-৩৬ দিন লাগে। এর প্রেক্ষিতে পণ্যমূল্য বেড়ে যেতে পারে, স্বাদের বিষয়টি আছে। অন্যদিকে রপ্তানির ক্ষেত্রে ভারতে বর্ধিষ্ণু মধ্যআয়ের মানুষ রয়েছে। তাদের পার ক্যাপিটা ইনকাম বাড়ছে। ফলে আমাদের জন্য ভারত একটা বিরাট বাজার হতে পারে যদি আস্তে আস্তে নেগোসিয়েশন করে আরও বেশি পণ্য ভারতে রপ্তানি করতে পারতাম। এর ফলে আমাদের আমদানি-রপ্তানির ফারাকটা কমিয়ে আনতে পারতাম। চীনের সঙ্গে কিন্তু ভারতের সম্পর্ক অত্যন্ত খারাপ। কিন্তু ভারতের বাজারে চীনের রপ্তানি দিন দিন বাড়ছে। আমাদের বানিজ্যকে রাজনীতি থেকে উচ্চতর কূটনীতির মাধ্যমে বের করে আনতে হবে।