রাতে অপরাধীর ঘুম হারামের আশ্বাস, দিনে ‘তৃপ্তির ঢেঁকুর’
২৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৫রবিবার দিবাগত রাত তিনটায় আচমকা নিজের বাসায় সংবাদ সম্মেলন ডাকেন স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লে. জেনারেল(অব.) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী। তার কয়েক ঘণ্টা আগেই নগরীতে একাধিক ছিনতাইয়ের ভয়াবহ দৃশ্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়। মধ্যরাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আর ইডেন কলেজের শিক্ষার্থীরা দেশব্যাপী আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতিতে রাস্তায় নেমে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার পদত্যাগ দাবি করেন।
গভীর রাতের সংবাদ সম্মেলনে আশ্বস্ত করতে চাইলেও স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার কথায় আশ্বত্ব হতে পারেননি শিক্ষার্থীরা। তারা মঙ্গলবার পর্যন্ত সময় দিয়েছেন স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টাকে। তারা মনে করছেন, স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা ঢাকাসহ সারা দেশের আইন-শৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ। তাই স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার পদত্যাগের দাবিতে এখনো অনড় তারা৷
রবিবার রাতে বনশ্রী এলাকায় একটি ছিনতাইয়ের দৃশ্য দ্রুতই ভাইরাল হয়ে যায়। রাত সাড়ে ১০টার দিকে স্বর্ণ ব্যবসায়ী আনোয়ার হোসেনকে তার বাসার সামনে মোটর সাইকেলে আসা ছিনতাইকারীরা কুপিয়ে ১৬০ ভরি স্বর্ণ এবং এক এক লাখ টাকা ছিনিয়ে নেয়। একই রাতে মোহাম্মদপুর এলাকায় আরেকটি ছিনতাইয়ের ঘটনার ভিডিও ছড়িয়ে পড়ে সোশাল মিডিয়ায়।এছাড়া মান্ডা এলাকার গ্রিন মডেল টাউন এলাকার ছিনতাইয়ের দৃশ্যও ভাইরাল হয়। তবে ওই ছিনতাইকারীকে অবশ্য জনতা পাকড়াও করেছে।
রবিবার রাত রাজধানীর অনেক এলাকার মানুষের জন্যই ছিল আতঙ্কের রাত৷ ধানমন্ডির শঙ্কর এলাকায় তাই ডাকাত প্রতিরোধের আহ্বান জানানো হয় মসজিদের মাইক থেকে।ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও ইডেন কলেজের শিক্ষার্থীরা অবশ্য আতঙ্কে চারদেয়ালে বন্দি থাকেননি৷ মধ্যরাতেই রাস্তায় নামেন তারা স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার পদত্যাগ দাবিতে। এমন দাবির মুখেই স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লে. জেনারেল (অব.) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী বারিধারার ডিওএইচএস-এ নিজ বাসভবসনে সংবাদ সম্মেলন ডাকেন। রাত তিনটায় নগরজুড়ে যখন ডাকাতি, ছিনতাইয়ের আতঙ্ক, তখন সাংবাদিকদের হাজির হতে হয় সেখানে৷ গভীর রাতের সংবাদ সম্মেলনে আইন-শৃঙ্খলার অবনতির জন্য পতিত আওয়ামী লীগ সরকারকে দায়ী করে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা দাবি করেন, ‘তারা’ তাদের কালো টাকা দেশে এনে সন্ত্রাসীদের দিয়ে এই পরিস্থিতি সৃষ্টি করছে। একই সঙ্গে তিনি পরিস্থিতির উন্নতি হচ্ছে দাবি করে ‘আরো উন্নতি হবে’-এমন আশ্বাসও দেন। এ সময় ‘‘অপরাধীদের ঘুম হারাম করে দেয়া হবে-’’ এমন কথাও বলেন তিনি। পদত্যাগের দাবির প্রসঙ্গে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা বলেন, “ পদত্যাগ আগেও চাওয়া হয়েছে। তারা তো আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি চায়। সেটা করে দিলেই তো হলো।”
রবিবার রাত তিনটার পরে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা অপরাধীদের ঘুম হারামের ঘোষণা দিলেও সোমবার সকালেই বাসাবো এলাকায় আবার ছিনতাইয়ের অভিযোগ পাওয়া যায়।
স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার মধ্যরাতের সংবাদ সম্মেলনের বক্তব্যে আশ্বস্ত হতে পারেননি শিক্ষার্থীরা। তাই সোমবারও তার পদত্যাগের দাবিতে ‘ধর্ষণ ও নিপীড়নের বিরুদ্ধে বাংলাদেশ’ ব্যানারে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার পদত্যাগের দাবিতে সচিবালয় অভিমুখে পদযাত্রা হয়েছে। শিক্ষা ভবনের সামনে যেতেই পুলিশ মিছিলটি আটকে দেয়৷ বাধার মুখে টিএসসিতে ফিরে গেলেও আগামী ২৪ ঘন্টার মধ্যে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টাকে পদত্যাগের আল্টিমেটাম দিয়েছেন তারা।
কখনো কঠোর, কখনো ‘কোমল’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষার্থী তানজিলা তাসনিম পদযাত্রায় অংশ নিয়েছেন৷ ডয়চে ভেলেকে তিনি বলেন, “ আজ আমাদের আটকে দিতে পুলিশ যেভাবে শক্ত অবস্থান নিলো, অপরাধীদের ধরতে তারা তো এভাবে শক্ত অবস্থান নেয় না। ঘরে-বাইরে, রাতে-দিনে আমাদের নিরাপত্তা নেই। বাসে পর্যন্ত ধর্ষণের ঘটনা ঘটছে। কোনো বিচার নাই। আমরা এই স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টাকে চাই না। তিনি শুধু কথাই বলছেন। কোনো কাজ করছেন না। আমরা আমাদের জীবনের নিরপত্তা চাই।”
আর দর্শন বিভাগের শিক্ষার্থী মোহাম্মদ সজীব হোসেন বলেন, “ স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা মধ্যরাতে সংবাদ সম্মেলন ডেকে আমাদের ধোঁকা দিয়েছেন। তার কথা আমাদের আশ্বস্ত করেনি। তিন বলেছেন, পতিত স্বৈরাচার কালো টাকা ছড়িয়ে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটাচ্ছে। তাহলে উনি কী করছেন? এটা বন্ধ করা তো ওনার কাজ। আর আগের স্বৈরাচার যেভাবে অন্যের ওপর দোষ চাপাতো, তিনিও তাদের মতোই করছেন।”
আরেক শিক্ষার্থী রক্তবীর অর্ক বলেন, “ অপারেশন ডেভিল হান্ট শুরুর পর ডেভিল না কমে আরো বাড়ছে। ডেভিলদের তারা খুঁজে পাচ্ছে না কেন? প্রতিদিনই তো অনেককে গ্রেপ্তার করা হচ্ছে। তাহলে কাদের গ্রেপ্তার করা হচ্ছে?”
“এই সরকার আমাদের রক্ত আর আন্দোলনের ফসল। এভাবে তাদের ব্যর্থ হতে দিতে পারি না। যারা পারবে না, তারা সরে যাবে,” বলেন তিনি।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাও স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার পদত্যাগের দাবিতে সোমবার ঢাকা-আরিচা মহাসড়ক অবরোধ করে।
রাজশাহীগামী বাসে গণডাকাতি এবং দুই নারীকে ধর্ষণের পর পুলিশ নানাভাবে ঘটনা ধামাচাপা দেয়ার চেষ্টা করে আসছিল। ওই ঘটনার পর ঢাকাসহ সারাদেশে নিরাপত্তা এবং অপরাধীদের গ্রেপ্তারের দাবিতে প্রতিবাদ সমাবেশ হয়ে আসছে। শাহবাগে কয়েকদিন ধরেই নিয়মিত প্রতিবাদ, কর্মসূচি পালিত হচ্ছে।
১৭ দিনে গ্রেপ্তার ৯ হাজার ২৫৩ জন
গাজীপুরে সাবেক মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেলের বাড়ি ভাঙচুরের ঘটনাকে কেন্দ্র করে বৈষম্যবিরোধী ছাত্রদের ওপর হামলার পর ৮ ফেব্রুয়ারি সারাদেশে যৌথ বাহিনীর ‘অপারেশন ডেভিল হান্ট’ শুরু করা হয়। সোমবার বিকাল পর্যন্ত ১৭ দিনে এই অভিযোনে মোট ৯ হাজার ২৫৩ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। অভিযান শুরুর পর স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা বলেছিলেন, “ ডেভিল মানে শয়তান, এই অভিযানে শয়তানদের ধরা হবে। আইন-শৃঙ্খলার উন্নতি হবে।”
কিন্তু পুলিশের সাবেক আইজি নূর মোহাম্মদ বলেন, “অনেক গ্রেপ্তার হচ্ছে সত্য, কিন্তু আসল অপরাধীরা কতটা গ্রেপ্তার হচ্ছে সেটাই প্রশ্ন। তারা যদি গ্রেপ্তার হতো তাহলে আইন-শৃঙ্খলার তো উন্নতি হওয়ার কথা। আসলে এই ধরনের অভিযানের সমস্যা হলো, যারা অভিযানে নিয়োজিত থাকে, তারা আটকের সংখ্যা বাড়িয়ে ক্রেডিট নিতে চায়।”
তিনি মনে করেন, “ অভিযানের সাফল্য নির্ভর করে গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে প্রকৃত ও তালিকাভুক্ত সন্ত্রাসী এবং অপরাধীদের গ্রেপ্তারের ওপর। আমি সেটা দেখতে পাচ্ছি না। সেনা সদস্যদেরও ঢিলেঢালা মনে হচ্ছে। পুলিশও তাই। আসলে পুলিশের নৈতিক সাহস কমে গেছে। তাই তারা এখনো ভয় পায়।”
তার কথা,“ স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা শুধু কথাই বলছেন। মধ্যরাতে সংবাদ সম্মেলন ডেকে কথাই বললেন। আসলে তার কাজ তো দৃশ্যমান হতে হবে। এত কথা বলে তো লাভ নেই।”
পুলিশের হিসাব অনুযায়ী, জানুয়ারি মাসে রাজধানীতে ৩৬টি হত্যা ৫৪টি ছিনতাই, ১৪৬টি চুরি এবং আটটি ডাকাতির ঘটনা ঘটেছে। পুলিশ দাবি করছে, এই সময়ে তারা ঢাকা শহর থেকে ৭১৯ জন ছিনতাইকারীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
পুলিশের আইজি বাহারুল আলমও মনে করেন ছিনতাই বেড়ে গেছে। সোমবার তা স্বীকার করেই তিনি রাজশাহীতে বলেন, “ আমরা বিষয়টি আমলে নিয়েছি। বিশেষ একটি ব্যবস্থা নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ, র্যাব ও অ্যান্টি টেরোরিজম ইউনিট যৌথ পেট্রোলিং করবে। আজ (সোমবার) থেকে এটি বাস্তবায়িত হবে আশা করি। আমরা দেখি, এভাবে উন্নতি হয় কিনা। না হলে আমাদের অন্য কৌশলে যেতে হবে।”
তিনি আরো বলেন, “ অপারেশন ডেভিল হান্ট মূলত যারা সমাজবিরোধী, সন্ত্রাস করে, তাদের বিরুদ্ধে। যৌথবাহিনীতে একটা সাইজেবল কম্পোনেন্ট থাকে। পুলিশে এত বড় কম্পোনেন্ট নেই। এটি একটি জয়েন্ট পার্টি। ডেভিল হান্টে কারা ধরা পড়ছে, আপনারা একটু দেখেন। বড় সন্ত্রাসী, চোরাকারবারি সবাই ধরা পড়ছে। একটি গোষ্ঠী চায় না বাংলাদেশে স্থিতিশীল পরিবেশ বজায় থাকুক। সেটার পেছনে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য থাকতে পারে।”
সেনা্প্রধানের ‘অতিরিক্ত’ বল প্রয়োগ না করার আহ্বান
বর্তমান আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি ও চলমান অভিযান সম্পর্কে সোমবার সেনাবাহিনীর এক অনুষ্ঠানে সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান বলেন, “ অতিরিক্ত বল প্রয়োগ করা যাবে না। মাঝে মাঝে এই কাজগুলো করতে যেয়ে কিছু বলপ্রয়োগ হয়ে যায়।” তিনি আরে বলেন, “বল প্রয়োগ করতে গেলেও একেবারে প্রোপোরশনেট যেন হয় এবং যত কম বল প্রয়োগের মাধ্যমে এই কাজগুলো করা যায়, ততই ভালো।”
‘স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার সরে যাওয়া উচিত’
সিনিয়র সাংবাদিক মাসুদ কামাল ডয়চে ভেলেকে বলেন, “ আসলে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা এখন মধ্যরাতের নাটক করছেন। তিনি স্বপ্ন দেখেছেন মধ্যরাতে কিছু বলা দরকার, তাই রাত তিনটায় প্রেস কনফারেন্স করে দেশের মানুষকে আরো একবার হতাশ করলেন। তার আসলে এখন সরে যাওয়া উচিত।”
“অতীতের সরকারের ওপর দায় দিয়ে নিজের ব্যর্থতা ঢাকার কোনো সুযোগ নেই। কেউ তো আপনাকে বলেনি অতীতের সরকারের লোকজন করলে তাদের ধরা যাবে না। ধরছেন না কেন?” প্রশ্ন তার।
শিক্ষক ও বিশ্লেষক ড. জাহেদ উর রহমান মনে করেন, “ শুধু স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা নয়, পুরো সরকার পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হচ্ছে। এর জন্য কাউকে দায় দিয়ে লাভ নেই। সরকারের কাজ হলো কথা বলা নয়, কাজ করা। আওয়ামী লীগ করলো, না সন্ত্রাসীরা করলো- সেটা বলে লাভ নেই। তাদের ধরা এবং দমন করাই সরকারে কাজ। মানুষকে স্বস্তিতে রাখাই তাদের কাজ।”
“আর স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা মধ্যরাতে একটি নাটকীয় ঘটনা ঘটিয়েছেন। এইসব নাটক করে তো কিছু হবে না,” বলেন তিনি।
গভীর রাতের সংবাদ সম্মেলনের পর স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লে. জেনারেল(অব.) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী সোমবার সচিবালয়ে আইন-শৃঙ্খলা কমিটির বৈঠকেও অংশ নিয়েছেন৷ বৈঠকের পর তিনি দাবি করেন, ‘‘আইন-শৃঙখলার উন্নতি হয়েছে।’’