‘প্রয়োজনীয় অনুশাসন না দিলে কোনো পরিবর্তন হবে না’
২৪ জানুয়ারি ২০২৫সবচেয়ে আলোচিত পোশাক পরিবর্তনের উদ্যোগ৷ এসব নিয়েই ডয়চে ভেলের সঙ্গে কথা বলেছেন পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক মো. নুরুল হুদা।
ডয়চে ভেলে : পুলিশের পোশাক পরিবর্তনের প্রয়োজন কতটুকু?
মো. নুরুল হুদা : আমার কাছে এটা অগ্রাধিকারের মধ্যে আসে না। এই মুহুর্তে যে সমস্ত কাজ করা দরকার, তার মধ্যে এটা পড়ে না। পোশোকের পরিবর্তন কাজের মান উন্নত করেছে- এ ধরনের কোনো গবেষণার ফল আমার জানা নেই। বিগত ১০০ বছরে পুলিশের ইউনিফর্ম অন্তত ৩-৪ বার বদল হয়েছে, কিন্তু আচরণগত কোনো পরিবর্তন দেখা যায়নি। অতত্রব, এই পোশাক পরিবর্তন কী ধরনের আচরণগত পরিবর্তন আনতে পারবে সে বিষয়ে আমার সন্দেহ আছে। সামনের দিনগুলোতে দেখতে হবে।
পুলিশ সদস্যদের মনোবল ফেরাতে কি কোন উদ্যোগ আপনার নজরে এসেছে?
কিছু তো আছে। একটা বিরাট বড় ঘটনা ঘটে গেছে। সেখানে পুলিশ মাত্রাতিরিক্ত বল প্রয়োগ করেছে। কিছু কিছু জায়গায় পুলিশ ভার্চুয়ালি গণশত্রুতে পরিণত হয়েছিল। এমন একটি বিরাট ঘটনার পর একটা মনস্তাত্বিক প্রভাব রয়েছে। যেভাবে পুলিশকে দোষারোপ করা হচ্ছে, যদিও পুলিশ একা এই দোষের ভাগীদার না। কিন্তু তুলনামূলকভাবে তাকেই দোষটা বেশি দেওয়া হচ্ছে। যেহেতু সে অস্ত্র ব্যবহার করেছে। এটা কাটিয়ে উঠতে সময় লাগবে। কাজ হচ্ছে, কিন্তু এটা অত্যন্ত কঠিন। নতুন লোক পাওয়া মুশকিল, পুরনো লোকদের দিয়েই কাজ করতে হয়। মোটামুটি সন্তোষজনক, কিন্তু আমাদের যে প্রত্যাশা সেটা সম্ভব না।
সংস্কার কমিশন যেসব প্রস্তাবনা দিয়েছে তাতে কি জনবান্ধব পুলিশ গড়ে তোলা সম্ভব?
এটা নির্ভর করছে তারা কী ধরনের আইনি রক্ষাকবচের কথা বলেছেন। আমার মনে হয়, তারা সেরকম কিছু বলেননি। আসলে রাজনৈতিক সদিচ্ছার উপরই এটা নির্ভর করে। আইন-শৃঙ্খলা ঠিকমতো রাখতে হলে, যে অনুশাসন প্রয়োজন সেটা যদি না দেওয়া হয় তাহলে তো কোনো পরিবর্তন হবে না। আর যেসব রক্ষাকবচের কথা বলা হচ্ছে, সেক্ষেত্রে পুলিশের তদন্তের বিষয়টা রাজনৈতিক নির্বাহীর নিয়ন্ত্রণ থেকে বের করে বিচার বিভাগের কাছে জবাবদিহির আওতায় আনা উচিত। তার জাবদিহি হতে হবে বিচারিক কর্তৃপক্ষের কাছে। সে যেন ফাংশানালি অটোনোমাস হিসেবে কাজ করতে পারে। পুরো স্বাধীনতা ঠিক না, তার কাজের জন্য অটোনোমাস হবে। তার কাজে কেউ বাধা দেবে না। আর কোর্টের তো এখতিয়ার আছেই। তদন্তের সময় যদি সে উল্টোপাল্টা করে, তাহলে কোর্ট তাকে বাদ দিতে পারে। আরো অনেক পরামর্শ আছে, যেগুলো করতে গেলে প্রচুর সম্পদের বিনিয়োগ করতে হবে। আমরা যদি সেই সম্পদের বিনিয়োগ করতে রাজি থাকি, তাহলে হবে। এগুলো প্রস্তাব হিসেবে ঠিক আছে। কিন্তু বাস্তবায়নের জন্য রাজনৈতিক ইচ্ছা ও সম্পদের বিনিয়োগ লাগবে।
পুলিশের উপর রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ বন্ধে কী ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন?
প্রথমত, পুলিশ রাজনীতিবিদের কথায় চলবে না, আইন মোতাবেক চলবে। আইন মোতাবেক চললে তার বিরুদ্ধে যেন কোনো বন্দোবস্ত না নেওয়া হয়। হয়রানি না করা হয়। এ বিষয়ে দেশে যে বিচারিক কর্তৃপক্ষ আছে, তারা তাকে সুরক্ষা দেবে। উন্নত বা পরিণত গণতান্ত্রিক দেশে পুলিশকে এটা নিয়ে চিন্তা করতে হয় না। সেখানে এই হস্তক্ষেপ হয় না। যেটা আইনত না, এমন কোনো ব্যবস্থা ওই সব দেশে পুলিশের বিরুদ্ধে নেওয়া হলে আদালত তাকে সুরক্ষা দেয়। এটা থাকতে হবে। পুলিশ তদন্তের জন্য দায়ী থাকবে বিচার বিভাগের কাছে। এটা আমাদের আইনেও আছে। পুলিশের পদায়ন ও পদোন্নতিতে রাজনৈতিক নির্বাহীদের নাক গলানো বন্ধ করতে হবে। আইজিপিকে ক্ষমতাবান করতে হবে। তাহলে আপনি তার কাছ থেকে জবাবদিহিতা চাইতে পারবেন। এখনো তাকে জবাবদিহিতা করতে হয়, কিন্তু অনেক সিদ্ধান্ত নেওয়ার এখতিয়ার তার নেই।
পুলিশের তো ৫৮টি থানাসহ বিপুল পরিমান গাড়ি ও স্থাপনা পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। এগুলো কিভাবে রিপ্লেস হবে?
যেসব স্বীকৃত পন্থা আছে, সেই পথে যেতে হবে। টেন্ডার করতে হবে। গভর্নমেন্ট টু গভর্নমেন্ট কেনার প্রক্রিয়ায় বেশি সময় লাগে না। তাহলে দ্রুত এগুলো পুনর্স্থাপন করা সম্ভব। এখন ওখানে সম্পদের বিনিয়োগ করতে হবে, যদিও এখন আমাদের কৃচ্ছতা সাধন করতে হচ্ছে। অর্থনৈতিক অবস্থা ভালো না। তারপরও আমরা যদি মৌলিক চাহিদা তিনটাকে ধরি- শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা, অর্থাৎ এই নিরাপত্তাকে যদি আমরা যথেষ্ট গুরুত্ব দেই, তাহলে এখানে সম্পদের বিনিয়োগ করতে হবে।
এখনো পুলিশকে মাঠে সক্রিয় হতে দেখা যাচ্ছে না, কেন?
এটার বিভিন্ন কারণ আছে। একটা তো মনোবলের উপর আঘাত। এখনো কয়েকশ' পুলিশ অফিসারের বিরুদ্ধে মামলা আছে। অনেকেই চিন্তায় থাকতে পারে, ‘আমি কাজ করতে গেলে আবার আমার বিরুদ্ধে মামলা হবে কিনা৷’ কোন দিকে কিভাবে কাজ করবো সেটা একটা। এছাড়া কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ব্যাপক হারে বদলি হয়েছে। নতুন জায়গায় এসে কাজ করতে গেলে, বিশেষ করে ঢাকার মতো মেট্রোপলিটন শহরে নতুন লোকজনের পক্ষে সফলভাবে কাজ করা অতি অল্প সময়ের মধ্যে কঠিন। রাস্তা-ঘাট চিনতে হয়, তার ইনফর্মেশন সিস্টেম ঠিক করতে হয়, আরো বেশ কিছু জিনিস আছে। মেট্রোপলিটন পুলিশিং একটু আলাদা হয়। এত বড় একটা রাজনৈতিক পরিবর্তনের পর একদল লোককে মনে করা হচ্ছে তারা বিশ্বাসী না, আরেক দলকে মনে হচ্ছে হয়তো তারা বিশ্বাসী। এরকম একটা অবস্থার মধ্যে আমাদের এই সমাজে তো একটা বিভাজন রয়েছে। এই রাজনৈতিক বিভাজনের একটা প্রভাব তো পড়ে মনোবলের উপরে। যদি প্রজাতন্ত্রের স্বার্থে কাজ করা হয়, তাহলে ঝামেলা হওয়ার কথা না। যখন রাজনৈতিক দলের স্বার্থে কাজ করা হয়, তখন এই ধরনের প্রভাব বেশি পড়ে। তখন যে পরিমান দ্রুত গতিতে কাজ করা দরকার, সেটা সম্ভব হয় না।
পুলিশ তো একটা শৃঙ্খলাবদ্ধ বাহিনী। অধস্তন পুলিশ সদস্যরা তো ঊর্ধ্বতনদের নির্দেশ পালন করেন, সেক্ষেত্রে তাদের অভিযুক্ত করা কতটা যুক্তিসঙ্গত?
অধস্তনরা ঊর্ধ্বতনদের বেআইনি নির্দেশ শুনতে বাধ্য নয়। এটা বুঝতে হবে, একজন এসআইকে যদি আইজিও অযৌক্তিক আদেশ দেন, তিনি সেটা শুনতে বাধ্য নন। যদিও এটা কেতাবের কথা। কিন্তু বাস্তবে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের কথা যদি সব ক্ষেত্রে শুনতেই হয়, তাহলে তো আর আইনের প্রয়োজন নেই। আইনে বলা আছে, তুমি আইন অনুযায়ী অর্ডারগুলো মানবে। তবে ডিসিপ্লিন দেখার জন্য এখানে ঊর্ধ্বতনাদের কথা শুনতে হয়। এগুলো হচ্ছে সভ্য সমাজের একটা সিস্টেম। ঊর্ধ্বতন তাকে বেআইনি অর্ডার দেবে না। অধস্তনরাও জানে কোনটা আইনসিদ্ধ আর কোনটা আইন অনুযায়ী না। অতএব ১০০টা ঘটনার মধ্যে বা এক হাজারটা ঘটনার মধ্যে দুই-তিনটা ঘটনায় মতভিন্নতা থাকতে পারে, কিন্তু বেশিরভাগ সময় ঊর্ধ্বতনদের আইনানুগ সঠিক নির্দেশনা দেওয়ার কথা। এটাই স্বাভাবিক সময় হয়। এখন কথা হলো, কেউ যদি আইন মোতাবেক কাজ না করে বা তার বিবেক-বুদ্ধি কাজে না লাগিয়ে শুধু ঊর্ধ্বতনদের নির্দেশনা পালন করেন, তাহলে তো তিনি অভিযুক্ত হতেই পারেন।
নিহত পুলিশ সদস্যদের পরিবারের সঙ্গে কেউ যোগাযোগ করেনি, বিচার বা ক্ষতিপূরণ তারা পাবেন কিনা তা নিয়ে হতাশায় দিন কাটছে তাদের। পুলিশ হত্যার বিচার কি আদৌ সম্ভব হবে? যদিও এ ব্যাপারে সরকার এক ধরনের দায়মুক্তি দিয়েছে।
আমি যতদূর শুনেছি, তাদের অর্থনৈতিক সুবিধা দেওয়া হচ্ছে। যদিও এটা অফিসিয়াল না। সরকারিভাবে দেওয়া হচ্ছে কিনা জানি না। তবে ফৌজদারি অপরাধের তদন্ত বা বিচারের ক্ষেত্রে কোনো সময়সীমা নেই। যেটা আজকে হলো না বলে ভবিষ্যতে আর হবে না- এমনটি ভাবা যাবে না। কোনো বিষয়ে দায়মুক্তির কথা বলা হচ্ছে, যেখানে পুলিশ অফিসাররা বেআইনি কাজ করেছে, বেআইনি কাজ করতে গিয়ে যদি তিনি মারা গিয়ে থাকেন, তাহলে সেখানে তার প্রটেকশন থাকবে না। কিন্তু তার উপর যদি আক্রমণ হয়ে থাকে এবং তিনি আক্রান্ত হয়ে থাকেন, তাহলে সেখানে তদন্ত এবং বিচার হওয়াটা বাঞ্ছনীয়। এ বিষয়ে বিভিন্ন পর্যায়ে উদ্বেগ আছে। তাই যেটা বললাম, এখন যদি বিচার না হয় ভবিষ্যতে যে হবে না সেটা বলা যাবে না।
পুলিশ সদস্য নিয়োগের ক্ষেত্রে সব সময় একটা দলীয় প্রভাবের কথা আমরা শুনি। এখন যাদের নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে, সেটা কতটা দলীয় প্রভাবমুক্ত হয়ে সম্ভব হবে বলে আপনি মনে করেন?
যে দেশে একটা বিষাক্ত বিভাজন হয়েছে সমাজে, বিশেষ করে রাজনৈতিক পর্যায়ে, এখানে দেখা যায় যে একসময় এই জেলার লোক হলে সে চাকরি পাবে না, আরেক সময় আরেক জেলার লোক হলে চাকরি পাবে না৷ এরকম একটা বিপজ্জনকভাবে বিভাজিত সমাজে যখন নিয়োগ হয়, তখন সেটার মধ্যে যে কোনো রাজনৈতিক প্রভাব থাকবে না সেটার গ্যারান্টি তো দেওয়া মুশকিল। অতএব, সন্দেহ থাকবে এখানে একটা বায়াসনেস কাজ করতে পারে।
পুলিশ কমিশন গঠনের প্রয়োজনীয়তা কতটুকু?
এটা তো দরকার হয়ই। তবে নিয়মিত সবাই যদি তাদের কাজটা ঠিকমতো করে, তাদের তত্ত্বাবধানের পর্যায়ের লোকগুলো যদি কাজগুলো ঠিকমতো করে এবং রাজনৈতিক উদ্দেশ্য যদি ঠিক থাকে, তাহলে তো ঘন ঘন পুলিশ কমিশনের প্রয়োজন পড়ে না। তবে একটা পুলিশ কমিশন হলে তারা অনেক জিনিস দেখতে পারে। ফলে এটা হতে পারে।