আইন কলেজে ছাত্রীকে ধর্ষণ : যা হয়েছে, যা হচ্ছে
আরজি করের ঘটনা দেখিয়েছিল, কলকাতার হাসপাতালে নারী সুরক্ষিত নয়। ল কলেজের ঘটনা দেখালো, পথে-ঘাটে তো বটেই, এমনকি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেও নারীরা অসুরক্ষিত।
আবার ধর্ষণ
কলকাতা আছে কলকাতাতেই। আরজি কর নিয়ে প্রতিবাদ, প্রতিরোধ, অসংখ্য প্রতিশ্রুতি, সমালোচনার পরও কলকাতায় ধর্ষণ কমেনি। বরং সাউথ ক্যালকাটা ল কলেজের ছাত্রীকে প্রাক্তন ছাত্র ও বর্তমানে কলেজের অস্থায়ী কর্মী ও তার দুই সঙ্গীর ধর্ষণ দেখিয়ে দিলো, কলকাতার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেও নারীরা সুরক্ষিত নয়। একসময় নারী-সুরক্ষা নিয়ে গর্ব করা এই শহরের পরিস্থিতি এখন কতটা খারাপ, তা একের পর এক ঘটনা দেখিয়ে দিচ্ছে।
ফর্ম ভরতে এসে
ওই ছাত্রী কলেজে ফর্ম ভরতে এসেছিলেন। অভিযোগ, তারপর তাকে অপেক্ষা করতে বলে ধর্ষক ও তার সঙ্গীরা। অনেকক্ষণ তাকে ইউনিয়ন রুমের বাইরে অপেক্ষা করতে দেখা যায়। তারপর সন্ধ্যায় তাকে জোর করে গার্ডের ঘরে নিয়ে যায় অভিযুক্তরা। তারপর চলে অকথ্য নির্যাতন। বাইরে থেকে দরজা বন্ধ করে ভিতরে ধর্ষণ করা হয়। তার ভিডিও তুলে তাকে ভয় দেখানো হয় বলে অভিযোগ। মেয়েটি পরে তার বাড়িতে ফোন করলে তারা পুলিশে অভিযোগ করেন।
পুলিশের এফআইআর
কসবা থানার পুলিশের কাছে ধর্ষিতা তিনজন অভিযুক্তর নাম নেন। তবে পুলিশ তিন অভিযুক্তের নামের অদ্যাক্ষর দিয়ে 'এম', 'জি 'ও 'পি'-র বিরুদ্ধে এফআইআর করে। পরে পুলিশ আদালতে জানায় ও আদালতের নথিতে আছে, 'এম' হলো মূল অভিযুক্ত মনোজিৎ মিশ্র, 'পি' হলো প্রমিত মুখোপাধ্যায় ও 'জি' হলো জাইব আহমেদ। ধর্ষিতার ডাক্তারি পরীক্ষা হয়। তিন অভিযুক্তকে পুলিশ গ্রেপ্তার করে।
কেন এফআইআরে নাম লেখা হলো না?
পুলিশের এফআইআর-এ কেন তিন অভিযুক্তের পুরো নাম লেখা হলো না? কেন তাদের নামের অদ্যাক্ষর লেখা হলো? তাহলে কি কিছু লুকাতে চাওয়া হচ্ছে,এ ই প্রশ্ন ওঠে। কলকাতা পুলিশের যুগ্ম কমিশনার রূপেশ কুমার বলেছেন, ''মেয়েটি পুরো নামই নিয়েছিল। এফআইআর লেখার সময় তা যাচাই করার পর্যায়ে ছিল। অপ্রাপ্তবয়স্ক হলে পুরো নাম লেখা যায় না। তাই এই সতর্কতা।'' আইনজীবীরা বলছেন, তারা এই ধরনের এফআইআর দেখে অবাক হয়ে যাচ্ছেন।
মূল অভিযুক্তর তৃণমূল যোগ
মূল অভিযুক্ত মনোজিৎ দাস তৃণমূল ছাত্র পরিষদের সঙ্গে যুক্ত। তৃণমূলের ছোট-বড় নেতার সঙ্গে সে নিয়মিত ছবি পোস্ট করত সামাজিক মাধ্যমে। সাউথ ক্যালকাটা ল কলেজে তার খুব প্রতাপ ছিল বলে অভিযোগ। সাবেক ছাত্র হওয়া সত্ত্বেও তার অবাধ গতিবিধি ছিল। তাকে অস্থায়ী কর্মী হিসাবেও নিয়োগ করা হয়। কলেজে তার নামে এখনো পোস্টার আছে। কলেজে সে অত্যন্ত প্রভাবশালী বলে পরিচিত। ঘটনার পর তাকে তৃণমূল ছাত্র পরিষদ থেকে বহিষ্কার করা হয়।
ছাত্র থাকার সময়
মনোজিৎ ছাত্র থাকা অবস্থায় কলেজের প্রিন্সিপালকে সারারাত ঘেরাও করে রাখে। সাবেক প্রিন্সিপাল দেবাশিস চট্টোপাধ্য়ায়ের স্ত্রী নবনীতা টিভি৯কে বলেছেন, ''আমার স্বামী বারবার চেষ্টা করেও কোনো ব্যবস্থা নিতে পারেননি। মনোজিৎ দুইটি বিশ্ববিদ্যালয়ে রেজিস্ট্রেশন করিয়ে রেখেছিল। রেজিস্টারকে বলেও লাভ হয়নি। পুলিশে বারবার অভিযোগ করা সত্ত্বেও তারা কোনো ব্যবস্থা নেয়নি।'' প্রশ্ন উঠেছে, কার আশকারায় মনোজিতের এই বাড়বাড়ন্ত?
একের পর এক প্রতিবাদ
এই ঘটনার পর একের পর এক ছাত্র সংগঠন কসবা থানার সামনে প্রতিবাদ দেখায়। কংগ্রেস, এসএফআই, ডিএসও, ডিওয়াইএফআই-এর তরফে প্রতিবাদ দেখানো হয়.। প্রশ্ন করা হয়, কেন ছাত্রীকে কলেজের ভিতরে ধর্ষণ করা হবে? কী করে এই সাহস পায় ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র সংগঠনের নেতা? কোনো ঘটনা ঘটলে পুলিশ কিছু বলে না বলেই কি এরকম ঘটনা বারবার ঘটছে।? পুলিশ বলপ্রয়োগ করে বিক্ষোভকারীদের সরিয়ে দেয়।
হাতাহাতিও হয়
পুলিশের সঙ্গে বিক্ষোভকারীদের সংঘর্ষ হয়। আরজি করের সময়ও একই ধরনের ছবি দেখা গিয়েছিল। এই ধরনের ভয়ংকর ঘটনা ঘটে যায়। কিন্তু প্রতিবাদ দেখাতে গেলেই পুলিশের লাঠি জোটে বিক্ষোভকারীদের।
মশাল মিছিল
রোববার রাতে কলকাতায় মশাল মিছিলও বের হয়। নারীদের সুরক্ষার দাবি, দোষীাদের শাস্তির দাবি নিয়ে সোচ্চার হন বিক্ষোভকারীরা।
অভয়া মঞ্চের মিছিল
রাস্তায় নেমেছিল অভয়া মঞ্চও। আরজি করের ঘটনার পর কলকাতার সাধারণ মানুষ রাস্তায় নেমে প্রতিবাদ দেখিয়েছিলেন। তাদের সেই দাবিপূরণ হয়নি। কিন্তু সেই জোরদার আন্দোলন এখন স্তিমিত। ল কলেজের ধর্ষণের পর সেই অভয়া মঞ্চও রাস্তায় নেমেছে।
মামলা দায়েরের অনুমতি সুপ্রিম কোর্টে
সুপ্রিম কোর্টে সত্যম সিং নামে এক আইনজীবী এই ধর্ষণের ঘটনার সিবিআই তদন্ত চেয়ে মামলা দায়ের করার অনুমতি চেয়েছিলেন। সর্বোচ্চ আদালত সেই আবেদন মঞ্জুর করেছে। তিনি মামলা দায়ের করতে পারবেন। তারপর সর্বোচ্চ আদালত ঠিক করবে মামলা খারিজ করা হবে নাকি গ্রহণ করা হবে।
মদন-বচন
তৃণমূল বিধায়ক মদন মিত্র বলেছেন, ''ওই মেয়েটি যদি না যেত, তাহলে তো এই ঘটনা ঘটতো না। যাওয়ার সময় মেয়েটি কাউকে বলে গেলে, দুইজন বান্ধবী নিয়ে গেলে এরকম হতো না। আমরা যা দেখতে পাচ্ছি, যে এই খারাপ কাজ করেছে, সে পরিস্থিতির সুয়োগ নিয়েছে।'' এরপর তৃণমূলের তরফ থেকে মদন মিত্রকে শো কজ ক,রা হয়েছে। বলা হয়েছে, তার মন্তব্য, অপ্রয়োজনীয় ও সংবেদনহীন। তিন দিনের মধ্যে জানাতে হবে, তিনি কেন এই মন্তব্য করেছেন।
কল্যাণ বন্দ্যোপাায়ের মন্তব্য
ডানকুনিতে কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, "লজ্জা ! এতদিন ধরে দল করছি, এখন এসব জিনিস দেখছি । কেন এই ধরনের বিকৃত মনস্ক মানুষ আমাদের দলে থাকবে? তাদেরকে চিহ্নিত করে বের করে দেওয়া উচিত। কোনো ভুসিমাল দলের মধ্যে রাখবেন না। এমন লোককে বের করে দিলে মানুষ খুশি হবে। কী এমন নেতা সে। পাশ করে চলে গিয়েছে, ওকালতি করে ৷ আবার একটা অস্থায়ী কর্মী হিসেবে কাজও করে ? কী করে হয়?" তৃণমূল বলেছে, এটা কল্যাণের নিজস্ব মন্তব্য।
অগ্নিমিত্রা যা বলেছেন
বিজেপি নেত্রী অগ্নিমিত্রা পাল বলেছেন, ''এই মামলার তদন্ত সিবিআইয়ের হাতে দেওয়ার দরকার নেই। কারণ, আরজি করের তদন্ত নিয়ে সিবিআই কিছুই করেনি। পুলিশের বিশেষ তদন্তকারী দলই তদন্ত করুক।'' এই ধর্ষণের অভিযোগের তদন্ত কলকাতা পুলিশের নয় সদস্যের বিশেষ তদন্তকারী দল করছে। বিজেপি বলছে, এটা অগ্নিমিত্রার ব্যক্তিগত মন্তব্য, দলের নয়।
হাইকোর্টেও মামলা
কলকাতা হাইকোর্টেও কয়েকটি জনস্বার্থ মামলা দায়ের করা হয়েছে। এই মামলার বিচার দ্রুত করার আবেদনও জানানো হয়েছে। বিচারপতি সৌমেন সেন ও বিচারপতি স্মিতা দাসের ডিভিশন বেঞ্চ জানিয়েছে, মামলাগুলি নিয়ে বিরুদ্ধ পক্ষকে নোটিশ দিতে বলেছেন। দিন কয়েকের মধ্যে শুনানি হতে পারে।
এক ছাত্রীর ভাবনা
সাউথ ক্যালকাটা ল কলেজের তৃতীয় বর্ষের ছাত্রী সায়ন্তনী কলাপাত্র ডিডাব্লিউকে বলেছেন, ''আমাদের দাবি, সব জায়গায় সিসিটিভি ক্যামেরা লাগাতে হবে, বহিরাগতদের ঢুকতে দেয়া যাবে না। ছাত্রীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। নিয়মিত ক্লাস করতে হবে।'' তবে রাজ্যের সব কলেজের দাবি এটাই, ছাত্রীদের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে হবে। একের পর এক ধর্ষণ, সহিংসতার কাণ্ড হবে, তারপর রাজনীতির খেলায় মূল প্রশ্নটা পিছনে চলে যাবে, এটা হয় না।