অনেক লড়াই করে প্রতিষ্ঠা পেয়েছেন কুমোরটুলির নারী শিল্পীরা
দেবী দুর্গার মূর্তি তৈরির ক্ষেত্রে এতদিন নারীরা প্রায় ছিলেনই না। এখন কুমোরটুলিতে বেশ কয়েকজন নারী শিল্পী লড়াই করে নিজেদের জায়গা করে নিয়েছেন।
কুমোরটুলির নারী শিল্পীরা
লড়াইটা সহজ ছিল না। পুরুষতান্ত্রিক সমাজে অন্য বহু পেশার মতো, প্রতিমা তৈরির ক্ষেত্র ছিল পুরোপুরি পুরুষদের দখলে। কিন্তু এখন সময় বদলেছে। বেশ কয়েকজন নারী শিল্পী লড়াই করে কুমোরটুলিতে নিজেদের প্রতিষ্ঠা করেছেন। তাদের খ্যাতি এখন অনেক পুরুষ শিল্পীর থেকে বেশি।
প্রথম নারী শিল্পী
সম্ভবত কুমোরটুলির প্রথম নারী মৃৎশিল্পী কামাক্ষাবালা পাল। তার উৎসাহ ও অনুপ্রেরণায় নারীরা মূর্তি গড়ার কাজে এগিয়ে আসেন। তবে তার স্টুডিওটি আজ আর নেই। তিনি মারা যাওয়ার পর সেটি এখন অন্য কাজে ব্যবহৃত হয়।
মালার কাহিনি
১৯৮৫ সালে বাবা মারা যাওয়ার পর মৃৎশিল্পীর পেশায় আসেন মালা। বাবা চাননি বাড়ির মেয়ে এই পেশায় আসুক। দাদা গোবিন্দ পালের হাত ধরেই শুরু করেন মূর্তি গড়ার কাজ।
দেশে বিদেশে মালার প্রতিমা
আজ মালা পাল একটি ব্র্যান্ড। ইউরোপের বিভিন্ন দেশে গিয়েছে তার সৃষ্টি। নানান পুরষ্কারে ভূষিত হয়েছেন মালা। এই বছর সুইজারল্যান্ড, ইউক্রেন সহ অন্যান্য দেশে পোঁছেছে তার হাতের তৈরি দুর্গা।
প্রশিক্ষণ নিয়ে
দাদার ইচ্ছায় দিল্লির হস্তকলা অ্যাকাডেমি থেকে প্রশিক্ষণ নিয়েছেন মালা পাল। শুধু মূর্তি তৈরিই নয়, বছরের অন্যান্য সময় মালা তার স্টুডিয়োতে ভবিষ্যতের কারিগর তৈরিতে ব্যস্ত থাকেন।
চায়না পালের খ্যাতি ছড়িয়েছে
কুমারটুলির চায়না পাল আজ একটি বিখ্যাত নাম। ২২ বছর ধরে এই পেশায় জড়িয়ে চায়না। গত দু-বছর অতিমারির জন্য মন্দা গেলেও এই বছর দম ফেলার ফুরসৎ নেই চায়না আর তার দলবলের।
মূর্তি ভেঙেও দিয়েছে
চায়না বললেন, “আমাদের মা-কাকীমারা ঘরে বসে কাজ করতেন অনেক আগে থেকেই। তখন কিন্তু তারা বাবা-কাকাদের সহকারি হিসেবে কাজ করতেন, কিন্তু নিজস্ব পরিচয়ে আমি যখন কাজ শুরু করি, তখন অনেকের চক্ষুশূলও হয়েছিলাম। বাইরে মূর্তি রাখলে গাত্রদাহের জ্বালায় অনেকে ভেঙেও দিয়ে গিয়েছে।”
১০ বছর বয়স থেকে
ঠাকুরদাদার হাতে তৈরি ব্যবসার ঐতিহ্য এগিয়ে নিয়ে চলেছেন কাঞ্চী পাল। স্বামী বিদেশে অন্য পেশায় রয়েছেন। ১০ বছর বয়স থেকে “ পুতুল গড়তে গড়তে” আজ তিনি প্রতিষ্ঠিত শিল্পী কাঞ্চী পাল।
৪৫টি প্রতিমা
ছোটো বড় মিলিয়ে এইবছর ৪৫টি দুর্গাপ্রতিমা তৈরি করছেন তিনি। কাজের চাপে দুই মাস আগে থেকেই অর্ডার নেওয়া বন্ধ করে দিয়েছেন। “গত দু-বছর মুখ ফিরিয়ে ছিলেন, এইবছর মা আমাদের দু-হাত ভরে দিয়েছেন” বললেন কাঞ্চী।
মায়া পালের স্টুডিও
স্বামী মারা যাওয়ার পর মূর্তি তৈরির ব্যবসা নিজের হাতে তুলে নেন মায়া পাল। এক পুত্র আর তিন কন্যা নিয়ে চালাতেন তার স্টুডিও।
মেয়েদের সাহায্যে
ছেলের পুলিশের চাকরি আর মেয়েদের বিয়ের পর থেকে দায়িত্ব বেড়েছে মায়ার। দুর্গা-মরশুমে কাজের চাপ, তাই তিন মেয়েই নিয়ম করে বাপেরবাড়ি আসেন মা-কে সহযোগিতা করতে। মেয়েদের তিনজনই মূর্তি তৈরি ও চক্ষুদানে বিশেষ পারদর্শী।
স্বামীর মৃত্যুর পর
২০০৩ সালে স্বামী মারা যায় কাকলি পালের। দুই শিশু সন্তানকে বড় করতে শ্বশুর বাড়ির পেশাকেই জীবিকা হিসেবে বেছে নেন। মেয়েরা এখন কলেজ পড়ুয়া
২২টি দুর্গা করছেন
এবছর ২২টি দুর্গা তৈরির বায়না পেয়েছেন কাকলি। সারাবছরই কোনও না কোনও দেবদেবীর মূর্তি তৈরি হয় কাকলির ছোট্টো স্টুডিওতে। “এই ভাবেই চলে যায়” বললেন তিনি।
অন্যদের কাজ দিচ্ছেন
উত্তরাধিকারের প্রশ্নে সব থেকে এগিয়ে মীনাক্ষি পাল। বাপেরবাড়ির দিকের পাঁচটি আর শ্বশুরবাড়ির একখানি স্টুডিয়োর ‘মালকিন’ তিনি। ছয়টি কর্মশালা মিলিয়ে করেছেন বেশ কিছু মানুষের কর্মসংস্থান। জানালেন, “সারাবছর কাজের কোনও অভাব নেই।”
নারী শিল্পীদের লড়াই
এরা প্রত্যেকেই লড়াই করেছেন। নারী মৃৎশিল্পীর বিষয়টি অনেকেই ঠিকভাবে মেনে নেননি। নারীর অধীনে কাজ করে বলে এদের কারিগরদের কটু কথা শুনতে হয় অন্যদের কাছ থেকে। যার ফলে কাজের সময়ে দক্ষ কারিগর পেতেও সমস্যা হয়। তবু তারা এই সব প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে লড়াই করে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করেছেন। আগামী দিনে হয়ত তাদের দেখে আরো নারী এগিয়ে আসবেন মূর্তি তৈরির কাজে।