হেফাজত-বিএনপি বৈঠক এবং ইসলামি দলগুলোর নির্বাচনি রাজনীতি
৬ এপ্রিল ২০২৫অরাজনৈতিক সংগঠন হলেও হেফাজতে ইসলামের অনেক শীর্ষ নেতারা আলাদাভাবে ইসলামি রাজনৈতিক দল পরিচালনা করেন৷ সেই দলের নেতারা মনে করেন, বিএনপির সঙ্গে নির্বাচনি জোট হতে পারে, তবে তা সময়ই বলে দেবে৷আর বিএনপি বলছে, নির্বাচনের আগে তারা জোটের কথা ভাববে না৷ অন্যদিকে জামায়াতে ইসলামীও হেফাজতসহ অন্যান্য ইসলামি দলের সঙ্গে অনানুষ্ঠানিক আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে৷ আর ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ চাইছে নির্বাচনের আগে বৃহত্তর ইসলামি জোট গঠন করতে৷ তাই জোট গঠনে বিএনপি নয়, জামায়াতই তাদের পছন্দের বড় দল৷
নির্বাচনের সময় নিয়ে এই দলগুলোর মতপার্থক্য আছে৷ বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস বিভিন্ন সময়ে জানিয়েছেন, আগামী ডিসেম্বর থেকে জুনের মধ্যে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে পারে৷ ধর্মভিত্তিক সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক দল জামায়াতে ইসলামীও মনে করে ডিসেম্বর থেকে আগামী বছরের জুনের মধ্যেই নির্বাচন হওয়া সঠিক৷ ইসলামী আন্দোলনেরও একই ধরনের অভিমত৷ তবে বিএনপি চলতি বছরের ডিসেম্বরের মধ্যেই নির্বাচন চায়৷
বিএনপি ও হেফাজতের যেসব বিষয়ে ঐকমত্য
বাংলাদেশের কওমি মাদ্রাসাভিত্তিক সংগঠন হেফাজতে ইসলামের সঙ্গে শনিবার বৈঠক করেছে বিএনপি৷ দলটির পক্ষ থেকে ছিলেন মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর এবং স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাউদ্দিন আহমেদ৷ আর হেফাজতে ইসলামের পক্ষ থেকে সংগঠনটির মহাসচিব মাওলানা সাজেদুর রহমান, নায়েবে আমির ড. আহমদ আবদুল কাদের, যুগ্ম-মহাসচিব মাওলানা মাহফুজুল হক, মাওলানা মহিউদ্দিন রব্বানী, মাওলানা বাহাউদ্দিন জাকারিয়া, মাওলানা জুনাইদ আল হাবিব, মাওলানা আজিজুল হক ইসলামাবাদী, মুফতি মনির হোসাইন কাসেমী বৈঠকে অংশ নেন৷
এই বৈঠকে বিএনপির মূল লক্ষ্য ছিল ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচনের ব্যাপারে হেফাজাতের সমর্থন আদায়৷ বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাউদ্দিন আহমেদ ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচনের ব্যাপারে হেফাজতে ইসলাম আমাদের সঙ্গে একমত৷ তারা এটা নিয়ে কথা বলবেন৷’’
এর বাইরে আওয়ামী লীগের বিচার, শাপলা চত্বরসহ আওয়ামী লীগের শাসনামলে তাদের বিরুদ্ধে হওয়া মামলা প্রত্যাহারের দাবি জানিয়েছে হেফাজতে ইসলাম৷ বিএনপি তাদের সঙ্গে এ বিষয়ে একমত হয়েছে বলে জানিয়েছেন সালাউদ্দিন৷
হেফাজতে ইসলাম সংবিধানে ‘আল্লাহর ওপর আস্থা ও বিশ্বাসকে' ফের মূলনীতি হিসেবে চায়৷ রাজনৈতিক দল না হওয়ার পরও হেফাজাতের সঙ্গে বিএনপি কেন বৈঠক করলো জানতে চাইলে সালাউদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘‘তারাই আমাদের সঙ্গে বৈঠকের আগ্রহ দেখিয়েছেন৷ তাদের দাবি দাওয়া ছিল সেগুলো তারা বলেছেন৷ আর তাদেরও একটা গুরুত্ব আছে আমাদের কাছে৷''
হেফাজত আলাদাভাবে রাজনৈতিক দল না হলেও দলটির নেতারা ইসলামি দল বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস, খেলাফত মজলিস, জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম, নেজামে ইসলাম, খেলাফত আন্দোলন, ইসলামী ঐক্যজোটের নেতৃত্বে রয়েছেন৷ খেলাফত, জমিয়ত, ইসলামী ঐক্যজোট এক সময়ে বিএনপির জোটে থাকলেও আওয়ামী লীগ শাসনামলে হেফাজত সংশ্লিষ্ট মামলায় পড়ার পর ওই জোট থেকে বেরিয়ে যায়৷
ইসলামি দলগুলোর সঙ্গে নতুন করে নির্বাচনি জোট হবে কিনা এমন প্রসঙ্গে সালাউদ্দিন আহমেদ জানান এই বিষয়ে তারা সিদ্ধান্ত নেননি৷ তিনি বলেন, ‘‘এখনই আমরা কোনো নির্বাচনি জোটের কথা চিন্তা করছি না৷ নির্বাচনের সময় এলে তখন চিন্তা করা যাবে৷ আমরা যুগপৎ আন্দোলনের শরিকদের কথাও মাথায় রেখেছি৷ আমরা ইসলামি দলগুলোর সঙ্গেও আমাদের যোগাযোগ রাখছি৷ ডিসেম্বরে নির্বাচন নিয়েও আমরা সবার সঙ্গে কথা বলছি৷’’
হেফাজত যা চায়
হেফাজতে ইসলামের যুগ্ম মহাসচিব মাওলানা মহিউদ্দিন রাব্বানী বলেন, ‘‘আমরা কোনো রাজনৈতিক দল না হলেও আমাদের সংগঠনের যারা অন্য ইসলামি রাজনৈতিক দল করেন তারা যদি তাদের স্বকীয়তা রক্ষা করে বিএনপির সঙ্গে নির্বাচনি জোট করেন তাহলে তো আমাদের আপত্তি থাকবে না৷ তারা তো একসময় বিএনপির সঙ্গে ২০ দলীয় জোটে ছিলেন৷''
তিনি বলেন, ‘‘আমরা এই কথা বারবার বলেছি যে আওয়ামী লীগ আমাদের প্রতি যে জুলুম অত্যাচার করেছে, হত্যা করেছে আমাদের উপরে যা করেছে সেটার বিচার আমরা দাবি করি৷ উনি ওনার পক্ষ থেকে বলেছেন বিচার চান, কিন্তু নির্বাচন যেন সময় মোতাবেক হয়, ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন হয়৷ এই ব্যাপারে উনি ওনার পক্ষ থেকে আমাদের কাছে জোর দাবি করেছেন৷...আমরা মনে করি যদি সংস্কার সহ ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন হয় এটা ভালো৷''
বিএনপির সঙ্গে বৈঠকের বিষয়ে তিনি জানান, নিজেদের ১৩ দফা দাবিসহ আরও কিছু বিষয় তারা দলটির কাছে তুলে ধরেছেন৷ ২০১৩ সালে মতিঝিলের শাপলা চত্ত্বরে সমাবেশ করে সরকারের কাছে ১৩টি দাবি তুলে ধরেছিল হেফাজতে ইসলাম৷ এরমধ্যে ছিল, ‘সংবিধানে ‘আল্লাহর ওপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস' পুনঃস্থাপন এবং কোরআন-সুন্নাহবিরোধী সব আইন বাতিল করা, আল্লাহ্, রাসুল (সা.) ও ইসলাম ধর্মের অবমাননা এবং মুসলমানদের বিরুদ্ধে কুৎসা রোধে সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ডের বিধান রেখে জাতীয় সংসদে আইন পাস, প্রকাশ্যে নারী-পুরুষের অবাধ বিচরণ, মোমবাতি প্রজ্বালনসহ সব বিজাতীয় সংস্কৃতির অনুপ্রবেশ বন্ধ করা' ইত্যাদি৷
মহিউদ্দিন রাব্বানী বলেন, ‘‘আমরা বিএনপির কাছে আমাদের ১৩ দফাসহ আরো কিছু বক্তব্য তুলে ধরেছি৷ বিএনপি আমাদের সঙ্গে একমত হয়েছে৷ বাংলাদেশে মৌলবাদী বলতে আলেম ওলেমাদের মনে করা হয়৷ তাদের ওপর দায় চাপানো হয়৷ কিন্তু এটা ঠিক না৷ বিএনপি নেতারা এই শব্দটি ব্যবহারে সতর্ক হবেন বলে জানিয়েছেন৷''
আওয়ামী লীগের আমলে তাদের নেতাদের বিরুদ্ধে হওয়া মামলা প্রত্যাহার চেয়েছেন তারা৷ ‘‘মানবতাবিরোধী অপরাধে আওয়ামী লীগের বিচার এবং সংবিধানে ‘আল্লাহর ওপর আস্থা ও বিশ্বাসকে' মূলনীতি হিসাবে চাই,'' বলেন তিনি৷
ইসলামি দলগুলোর নির্বাচনি জোট ভাবনা
হেফাজতে ইসলামের যুগ্ম মহাসচিব এবং ইসলামি দল নেজামে ইসলামীর যুগ্ম মহাসচিব মাওলানা আজিজুল হক ইসলামাবাদী বলেন, ‘‘বিএনপি যদি ইসলামী দলগুলোকে নিয়ে জোট করতে চায় নির্বাচনের জন্য তাহলে সেই জোটে যেতে আমাদের দলের কোনা আপত্তি থাকবে না৷ আমাদের সমমনা অন্য ইসলামি দলও সেই জোটে যেতে পারে৷ আমাদের যে দাবি আছে সেই দাবিগুলো বিএনপি মেনে নিলে তো জোট হতে পারে৷ তবে এটা আদর্শিক নয়, নির্বাচনি জোট হবে৷''
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘‘জামায়াত একটি ইসলামি দল৷ তাই নির্বাচনের আগে বোঝা যাবে জোট কার সাথে হবে৷ বিএনপি যদি আওয়ামী লীগের ভাষায় কথা বলে তাহলে তো হবে না৷''
জামায়াতে ইসলামীও বিভিন্ন ইসলামি দলের সঙ্গে আলাপ আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে৷ জামায়াতে ইসলামীর প্রচার সম্পাদক মতিউর রহমান আকন্দ বলেন, ‘‘আমাদের সাথে যারা একই মত পোষণ করে তাদের সঙ্গে নির্বাচনের আগে আমরা জোট করার কথা সক্রিয়ভাবে চিন্তা করছি৷ যারা ইসলামি আদর্শে বিশ্বাসী, আমাদের যে চিন্তা এবং আদর্শ তার সঙ্গে যারা একমত হবেন তাদের সঙ্গে আমাদের জোট করার চিন্তা আছে৷''
তবে নির্বাচনি জোট নিয়ে এখনো আনুষ্ঠানিক আলোচনা তারা শুরু করেননি বলে জানান৷ তিনি বলেন, ‘‘আমাদের দলের আমির বিভিন্ন দলের সঙ্গে কথা বলছেন, তবে আনুষ্ঠানিকভাবে কোনো বৈঠক এখনও হয়নি৷ নির্বাচনের তারিখ হলে তখন আনুষ্ঠানিকভাবে আমরা কথা বলবো৷''
আর হেফাজত প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘‘তাদের সঙ্গে আমাদের যোগাযোগ হয়৷ যোগাযোগ আছে৷''
সংস্কার ও নির্বাচন নিয়ে অধ্যাপক ইউনূসের কথায় জামায়াতের আস্থা রয়েছে বলেও উল্লেখ করেন মতিউর রহমান আকন্দ৷ বলেন, ‘‘আমরা যেহেতু বড় সংস্কার চাই তাই প্রধান উপদেষ্টা যেভাবে বলেছেন চলতি বছরের ডিসেম্বর থেকে আগামী বছরের জুনের মধ্যে নির্বাচন-এই কথায় আমাদের আস্থা আছে৷''
অন্যদিকে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশও ইসলামি দলগুলোকো নিয়ে নির্বাচনের আগে বৃহত্তর ইসলামি জোট গঠন করতে চায়৷ তারা নির্বাচনের জন্য কমপক্ষে আরো এক বছর সময় দিতে চায় অন্তর্বর্তী সরকারকে৷ দলটির যুগ্ম মহাসচিব মাওলানা গাজী আতাউর রহমান বলেন, ‘‘আমরাই প্রথম থেকে ইসলামি শক্তিগুলোর সমন্বয়ে জোট গঠনের কাজ শুরু করি৷ আমাদের সেই প্রক্রিয়া অব্যাহত আছে৷ জামায়াত একটি বড় ইসলামি রাজনৈতিক শক্তি৷ তাদের বাইরে রেখে আমাদের জোট গঠনের চিন্তা নাই৷ দেশের বড় দুইটি রাজনৈতিক দল ক্ষমতায় ছিল৷ তাদের আমরা দেখেছি৷ তাই ইসলামি জোট গঠন করতে চাচ্ছি৷’’