হিন্দির আধিপত্য বাড়ছে? প্রতিবাদে বাংলাও
১৩ অক্টোবর ২০২২বহু ভাষাভাষীর দেশ ভারত। কিন্তু স্বাধীনতার পর থেকে বারবার হিন্দি ভাষার বিরুদ্ধে আধিপত্য প্রতিষ্ঠার অভিযোগ উঠেছে। বিভিন্ন আঞ্চলিক ভাষা কিছুতেই হিন্দির দাদাগিরি মানতে চায়নি। এ নিয়ে বারবার সংঘাত বেধেছে। আঞ্চলিক ভাষাগুলি থেকে গিয়েছে স্বমহিমায়। সেই সংঘাতের ছবি দেখা যাচ্ছে ফের। বিতর্কের কেন্দ্রে সরকারি ভাষা সংক্রান্ত সংসদীয় কমিটির সুপারিশ।
সাম্প্রতিক অতীতে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ হিন্দির পক্ষে সওয়াল করেছেন। তার বক্তব্যের সমালোচনা হয়েছে বিভিন্ন মহলে। এ বার একধাপ এগিয়ে গিয়েছে বিতর্ক। সংসদীয় কমিটি হিন্দির গরিমা বৃদ্ধিতে একগুচ্ছ সুপারিশ পাঠিয়েছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের কাছে। মন্ত্রকের পক্ষ থেকে তা পাঠানো হয়েছে রাষ্ট্রপতি দ্রৌপদী মুর্মুর কাছে। কী সুপারিশ পাঠানো হয়েছে? রাষ্ট্রপুঞ্জে ভারতের সরকারি ভাষা হোক হিন্দি। বিভিন্ন স্তরের সরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পঠনপাঠন হোক হিন্দিতে। হিন্দিভাষী রাজ্যগুলিতে হাইকোর্টের কাজকর্মে হিন্দির ব্যবহারের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। সরকারি চাকরির নিয়োগের ক্ষেত্রে ইংরেজির পরিবর্তে হিন্দি পরীক্ষাকে বাধ্যতামূলক করার কথা বলা হয়েছে। গত মাসে এ সব প্রস্তাব পৌঁছে গিয়েছে রাষ্ট্রপতি ভবনে।
সংসদীয় কমিটির প্রস্তাবে সিলমোহর পড়লে সাধারণ শিক্ষা থেকে প্রযুক্তি বা চিকিৎসাশাস্ত্র, সব ধরনের শিক্ষাতেই হিন্দির আধিপত্য নিশ্চিত হবে। কেন্দ্রীয় বিদ্যালয়, নবোদয় বিদ্যালয়, কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়, আইআইটি, আইআইএম, এইমস-সর্বত্র হিন্দির দাপট দেখা যাবে। উপায় না থাকলে ইংরেজি মাধ্যমে পড়াশোনা চলতে পারে। উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে ইংরেজির গুরুত্ব কমানোর উদ্যোগে আশংকিত শিক্ষা মহল। রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন উপাচার্য, ভাষাবিদ পবিত্র সরকার ডয়চে ভেলেকে বলেন, "উচ্চশিক্ষায় ইংরেজির গুরুত্ব বহাল থাকা উচিত। সেখানে হিন্দির অনুপ্রবেশ হবে অবাঞ্ছিত। এতে শিক্ষালাভের পরিসর কমবে, মান কমবে।”
পড়াশোনার পর চাকরির ক্ষেত্রেও হিন্দির আধিপত্য নিরবচ্ছিন্ন রাখতে কমিটি কী সুপারিশ করেছে? সরকারি প্রতিষ্ঠানের কাজকর্মও হিন্দিতে করার কথা বলা হয়েছে রিপোর্টে। নিয়োগের ক্ষেত্রে বিশেষ গুরুত্ব পাবে প্রার্থীর হিন্দি ভাষায় দক্ষতা। যদি সরকারি প্রতিষ্ঠানে কোনো আধিকারিক হিন্দির ব্যবহার এড়িয়ে অন্য ভাষা ব্যবহার করতে চান, তা হলে তাকে চিহ্নিত করার ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে। কর্মীর বার্ষিক পারফরম্যান্স রিপোর্টে বিষয়টি নথিভুক্ত করতে হবে। সংসদীয় কমিটির প্রস্তাব, হিন্দি ভাষায় বিশেষ দক্ষতার প্রয়োজন এমন সরকারি পদ যদি তিন বছরের বেশি সময় ধরে খালি থাকে, তা হলে এর জন্য সংশ্লিষ্ট সংস্থার প্রধানকে জবাবদিহি করতে হবে। এই শূন্যপদকে হিন্দির প্রতি অবহেলা হিসেবেই দেখছে কমিটি।
সরকারের বিভিন্ন প্রচারমূলক বিজ্ঞাপনের ক্ষেত্রেও হিন্দির প্রাধান্য নিশ্চিত করতে চায় তারা। সরকার বিভিন্ন ভাষায় বিজ্ঞাপন দেয়। এ নিয়ে সংসদীয় কমিটির সুপারিশ, বিজ্ঞাপনী প্রচারের জন্য নির্ধারিত বাজেটের অর্ধেকের বেশি টাকা খরচ হওয়া উচিত হিন্দি বিজ্ঞাপনে। হিন্দি ভাষার বিজ্ঞাপন নজর কাড়ার মতো বড় করে প্রথম পাতায় ছাপতে হবে। ইংরেজি ভাষার বিজ্ঞাপন ছোট করে অন্যান্য পাতায় প্রকাশের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। তবে এ ক্ষেত্রে আঞ্চলিক ভাষাকেও গুরুত্ব দিতে বলা হয়েছে।
কেন্দ্রের এই উদ্যোগকে অর্থনীতির সঙ্গে জুড়ে দেখছেন ‘বাংলা পক্ষ'-এর সাধারণ সম্পাদক গর্গ চট্টোপাধ্যায়। তিনি ডয়চে ভেলেকে বলেন, "অ-হিন্দি এলাকার পুঁজি, চাকরি, বাজার, জমি দখল করার চক্রান্ত হচ্ছে। ভারতকে হিন্দি সাম্রাজ্যে পরিণত করতে চায় কেন্দ্রের শাসকরা। আমরা হিন্দির দাসত্ব মেনে নেব না।” ‘বাংলা পক্ষ' চলতি সপ্তাহে একাধিক প্রতিবাদমূলক কর্মসূচি নিয়েছে। জেলায় জেলায় বিক্ষোভ দেখাবে তারা।
বাংলায় সর্বস্তরের মানুষের মধ্যে থেকে এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ শোনা যাচ্ছে। হিন্দিকে ভারতের রাষ্ট্রভাষা করার চক্রান্ত হিসেবে অনেকে দেখছেন এই উদ্যোগকে। পুরাণবিদ ও প্রাবন্ধিক নৃসিংহপ্রসাদ ভাদুড়ির মন্তব্য, "ভারতকে হিন্দুরাষ্ট্র করতে চায় আরএসএস-বিশ্ব হিন্দু পরিষদ। বিজেপি সেই লক্ষ্যেই এগোতে চাইছে। হিন্দিকে রাষ্ট্রভাষা করা সেই উদ্যোগের অংশ।” এই আগ্রাসনের বিরুদ্ধে নিজেদের সতর্ক থাকার উপর জোর দিয়েছেন চিত্রশিল্পী শুভাপ্রসন্ন। তার বক্তব্য, "ভাষা নিয়ে আমাদের সজাগ থাকা জরুরি। আমাদের রাজ্যে অনেক সাইনবোর্ড থেকে নিমন্ত্রণপত্রে বাংলা দেখা যায় না। এখানে বাংলার ব্যবহার বাড়াতে হবে।”