কিংবা এ-ও বলা যায়, ‘সাদা সাদা কালা কালা’ গানের যে সিনেমা, তা দেখার জন্য দর্শক এভাবে ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করেছিল৷ সিনেমা দেখি বা না দেখি, সুমনের ‘প্রথম সিনেমার প্রথম গান’টি খুব মনে ধরে যায় এবং এই মনে ধরার জন্য গানটি কার লেখা, কার সুর, কার গাওয়া—এত কথা জানার কোনো দরকারই পড়ে না৷ সিনেমা শেষ হয়, সিনেমার সঙ্গে যুক্ত প্রায় সবার নাম ভেসে ওঠে পর্দায়৷ এই সিনেমার তিনটি গানের নাম দেখি: ‘সাদা সাদা কালা কালা’, ‘আটটা বাজে’ আর ,‘আয় খেয়ে নে’৷ আরো একটি সুরের কথা আছে, ‘গুলতি থিম মিউজিক’৷ আর, একটি গানের কথা এই তালিকায় নেই, ‘জ্বালা সহে না আমার অন্তরে'; সেই গানের কথায় পরে আসছি৷
হাওয়া রিলিজের প্রায় ন’ মাস পর সমস্যা দেখা দেয় সিনেমার দ্বিতীয় গান, ‘আটটা বাজে’ নিয়ে৷ প্রথমে ২৬শে এপ্রিল ২০২৩-এ সুমনের ফেসবুকের দেয়ালে পশ্চিমবঙ্গের বীরভূম জেলার সিউড়ি শহরের শ্যামল মণ্ডল একটি মন্তব্য লেখেন: ‘‘হাওয়া সিনেমার ‘আটটা বাজে দেরি করিস না’ গানটির গীতিকার ও সুরকার মনিরুদ্দিন আমেদ… দুঃখের বিষয় এই যে ... তিনি তাঁর যথাযথ সম্মান পেলেন না৷’’ শ্যামল মনিরুদ্দিন আমেদের ছবি আঁকার স্কুলের ছাত্র৷ তাঁর মন্তব্য থেকে ভারতীয় গণনাট্য সংঘ বীরভূম জেলার সদস্য বিশ্বজিত দাসের দেয়াল, সেখান থেকে আনন্দবাজার পত্রিকা--খবর ছড়িয়ে পড়ে: বাংলাদেশের জনপ্রিয় ছবি ‘হাওয়া’ নিয়ে বিতর্ক, গানে নাম নেই৷ বিশ্বজিত হাওয়ার সমস্ত কলাকুশলীর কাছে ‘লেখককে সঠিক মর্যাদা’র জন্য আবেদন করেন, এবং পোস্টের নীচে যোগাযোগের একটি নম্বর দিয়ে রাখেন৷ হাওয়ার পরিচালক ও প্রযোজক তৎক্ষণাত টেলিফোনে মনিরুদ্দিন আমেদের সঙ্গে কথা বলেন৷ স্থির হয় সুমনরা শীঘ্রই আসবেন সিউড়িতে৷ যতদূর ভুল সংশোধন করা সম্ভব তা করবেন, লেখককে সাম্মানিক তো অবশ্যই দেওয়া হবে৷ পরদিন ফেসবুকে মনিরুদ্দিন আমেদের ছবিসহ একটি পোস্টে হাওয়ার সদস্যরা এই অনিচ্ছাকৃত অনুল্লেখের কারণ ব্যাখ্যা করেন—অনেক খুঁজেও তাঁরা লেখকের নাম জানতে পারেননি বলে ‘সংগৃহীত’ লিখতে বাধ্য হন৷ ইউটিউবে যেখানে গানটি রয়েছে, সেখানে লেখকের নাম যোগ করা হয়৷ খবরের কাগজে এবং টেলিভিশনের নানান চ্যানেলে সুমন সাক্ষাৎকার দিয়ে বিষয়টি বুঝিয়ে বলেন৷ অতএব, সযত্নে বাঁধ দিতে নেমেছেন সকলে মিলে৷ এরপর যদি ওঁরা কথা দিয়ে কথা না রাখেন, সেটা খুবই দুঃখজনক হবে৷ কিন্তু তেমন আশঙ্কা করার কোনো কারণ তো নেই৷ সত্যি কথা বলতে কি, ২৮ তারিখ আমি যখন মনিরুদ্দিন আমেদের সঙ্গে কথা বলি, আমার মনে হয় উনি আসলে সুমনদের জন্য অপেক্ষা করছেন৷
আমার আরো একটা কথা মনে হয়েছে৷ যদি সব কিছু ঠিক মতন হতো, যদি কলাকুশলীদের তালিকায় মনিরুদ্দিন আমেদের নামটিও থাকতো, যদি তাঁকে এককালীন একটি সম্মানী দিয়ে ‘হাওয়া’র প্রযোজক ‘আটটা বাজে’র স্বত্ত্ব কিনে নিতেন, তাহলে এই যে হঠাৎ একটু আলো খেলে গেল মনিরুদ্দিনদের রোজকার মফস্বলি জীবনে, তেমন কিছু কিন্তু হতো না৷ এ এক রকমের ঘুরিয়ে দেখা, ঠিকই; কিন্তু এ কথাও সত্যি যে, হঠাৎ একদিন ভালো -মন্দ কিছু ঘটে বলেই তো আরো কিছু ঘটে, আর আমাদের জীবন কিছুটা হলেও পাল্টে যায়৷
কিছু প্রশ্ন থাকে, উত্তর খানিক জানা, খানিক অজানা৷ যেমন, এই গানটি কেমন করে বাসুদেব দাস বাউলের কাছে পৌঁছেছিল? শিল্পীর সেই ইতিহাস স্মরণে নেই, তিনি অন্যদের যে কথা বলেছেন, আমায়ও টেলিফোনে সেই কথাই বলেন৷ বলেন, বহুকাল ধরে তিনি এই গানটি গাইছেন৷ কার গান, সে কথা না জেনেই গাইছেন৷ বাসুদেব দাস বাউল থাকেন শান্তিনিকেতনে, সিউড়ি থেকে সামান্য দূরে, তবু কেন তিনি লেখকের নাম জানতে পারেননি এই এত বছর ধরে? হয়তো জানবার প্রয়োজন হয়নি বলে৷ আজ তাহলে প্রয়োজন হচ্ছে কেন? আমার মনে হয়, মনিরুদ্দিন আমেদের জগৎ থেকে বাসুদেব দাস বাউলের জগতে একটি গান যে নিয়মে পৌঁছতে পারে, যেভাবে বাসুদেবের জগতে গানটি মনিরুদ্দিনকে বাদ দিয়েও স্থান করে নিতে পারে, সেই একই গান যখন বাসুদেবের জগৎকে অতিক্রম করে ‘হাওয়া'র জগতে গিয়ে পৌঁছায়, তখন লেনদেনের নিয়ম খানিক পাল্টে যায়৷ সেই জগতে স্বীকার-অস্বীকারের সঙ্গে নাম, যশ আর অর্থ জড়িয়ে আছে৷ যাঁরা তাঁর গান গেয়েছেন, রেকর্ড করেছেন, স্বপ্না চক্রবর্তী, কিংবা আমিনূর রশিদ বা কার্তিক দাস বাউল--কতদূর স্বীকৃতি দিয়েছেন তাঁরা মনিরুদ্দিন আমেদকে? কখনো কোনো সাম্মানিক পেয়েছেন কি তিনি তাঁদের কাছ থেকে? না পেয়ে থাকলে কোনো ক্ষোভ আছে কি? অবশ্যই আমি এমন কোনো কথা মনিরুদ্দিন আমেদকে জিজ্ঞেস করিনি, কারণ, তা অশোভন হতো৷ কিন্তু আমার মনে হয়েছে যে নিজের এই জগতে মনিরুদ্দিন এতটাই নিশ্চিন্তিতে থাকেন, সেখানে কে স্বীকৃতি দিলো বা দিলো না, তাতে খুব কিছু যায় আসে না৷ তুলনায় সুমনের ‘হাওয়া’ এক দূরতর দ্বীপ৷ সেখানে স্বীকৃতি না পেলে মনে ক্ষোভ জাগে: সকলের যদি নাম থাকে, তাহলে মনিরুদ্দিনের নেই কেন? তাঁরই গান গেয়ে আর কারো নাম হবে, অর্থ হবে, এ কেমন? এই প্রশ্ন লেখক থেকে তাঁর পরিবারের, ছাত্র, বন্ধু, পড়শির—একটা গোটা সমাজের৷ স্বীকৃতি এলে তাই সকলেরই গর্ববোধ হয়৷
বিচ্ছেদী
হাওয়ার নির্মাতাদের আমি বলি, মনিরুদ্দিন আমেদের জন্য এন্ড টাইটেল সংশোধন করবেন যখন, তখন যেন আরো একটা ভুল সংশোধন করে দেন৷ ব্যাপারটা ঠিক ভুল নয়৷ এটা একটা ভুলে যাওয়ার ঘটনা৷ এই লেখার শুরুতেই বলেছিলাম, হাওয়ায় চতুর্থ একটি গান আছে, ‘জ্বালা সহে না আমার অন্তরে'৷ হয়ত স্রেফ এক মিনিটেরই গান৷ কিন্তু একবার শোনামাত্র সেই সুর আমায় কামড়ে ধরে৷
গল্পে তখন সবাই একটু বিশ্রাম নিচ্ছে, মাঝিরা নিজেদের মধ্যে কথা বলাবলি করছে৷ ‘‘ওই ছেমরিটা কই রে? আর ইবা?'' সবাই এখন বুঝতে পারে যে গুলতি আর ইবার মধ্যে কী যেন একটা টান তৈরি হয়েছে৷ এমন কথোপকথনের ভিতরেই এই গান শুনতে পাওয়া যায়৷ তারপর দেখা যায় গুলতি হেঁটে যাচ্ছে, আর ইবা তাকিয়ে আছে তার দিকে আর গুলতি ফিরে তাকায় একবার৷ ইবা একটা সিগারেট ধরায়৷ এইটুকুই শুধু, আর কিছু না৷ ‘বন্ধু প্রেমও বিচ্ছেদের জ্বালা সহে না আমার অন্তরে’৷ শাহজাহান মুন্সীর গলায় রজ্জব আলী দেওয়ানের গান৷ সিনেমা-শেষে ক্রেডিট স্ক্রোল-এ গিয়ে দেখি, এই গানটির কোনো উল্লেখ নেই কোথাও৷ আমার যত না মনিরুদ্দিনের গানকে সংগৃহীত বলা নিয়ে আপত্তি--কারণ যতক্ষণ পর্যন্ত ওঁরা জানতেন না, ততক্ষণ পর্যন্ত গানটি সংগৃহীতই ছিল—তার চেয়ে বেশি আপত্তি এই ভুলে যাওয়া নিয়ে৷ কেন এমন ভুল করবো আমরা?
গতবছর ১ নভেম্বরের ছবিঘরটি দেখুন...