সুড়ঙ্গে আটক ৪১ শ্রমিক উদ্ধারের শুরু থেকে শেষ
ভারতে উত্তরকাশীর এক সুড়ঙ্গে আটকে পড়েছিলেন ৪১ শ্রমিক। তাদের উদ্ধারে ১৭ দিনের এক কর্মযজ্ঞের আদ্যান্ত জেনে নিন ছবিঘরে...
আলোর উৎসবের দিনে...
খবরটা এলো ১২ নভেম্বর, দেওয়লির দিন সকালবেলা। উত্তরকাশীর সিল্কিয়ারা টানেলে ধসের কারণে আটকে পড়েছেন ৪১ জন শ্রমিক। তারা সুড়ঙ্গের ভিতরে ঢুকে রাতে কাজ করছিলেন। সেই সময় ফেরার রাস্তা ধস নেমে বন্ধ হয়ে যায়। সুড়ঙ্গের শুরু থেকে দুইশ মিটার দূরে এই ধস নামে। সুড়ঙ্গের ছাদ থেকে নীচে পর্যন্ত বোঝাই হয়ে যায় লোহা, মাটি, পাথরে।
অগ্রাধিকারে শ্রমিকদের বাঁচিয়ে রাখা
প্রথমে ভাবা যায়নি উদ্ধারের কাজটা এতটা কঠিন হবে। প্রথম যে কাজটা করা হয়, একটা ছোট নলের সাহায্যে অক্সিজেন সরবরাহ চালু করা হয়। শুকনো খাবার, ফল তাদের কাছে পাঠাবার ব্যবস্থা করা হয়। সেইসঙ্গে মাটি কেটে, পাথর সরিয়ে উদ্ধারের কাজও শুরু হয়। ১৩ নভেম্বর মুখ্যমন্ত্রী পুস্কর সিং ধামি ওই পাইপের মাধ্যমে আটকে পড়া মানুষদের সঙ্গে কথা বলেন।
শুরুতেই বাধা
১৪ নভেম্বর থেকে শুরু হলো টানেলের ধসে যাওয়া অংশে মেশিন দিয়ে গর্ত করে পাইপ বসানোর কাজ। কন্তু সেই কাজ করতে গিয়ে আবার উপর থেকে মাটি, পাথর পড়ে। কাজ বন্ধ করে দিতে হয়।
আধুনিক প্রযুক্তির সহায়তা
এরপর দিল্লি থেকে বড় মেশিন উড়িয়ে আনা হয়। সুড়ঙ্গের কাছে সব যন্ত্রাংশ লাগিয়ে সেই মেশিন চালু করা হয়। ১৬ তারিখ মধ্যরাত থেকে সেই মেশিনের সাহায্যে গর্ত করার কাজ শুরু হয়।
আবার বাধা, আবার নবসূচনা
এই মেশিনটি ১৭ নভেম্বর ২৪ মিটার পর্যন্ত গর্ত করে এবং সেখানে পাইপ ঢোকানো হয়। কিন্তু এরপর সেটা কাজ বন্ধ করে দেয়। তখন ইন্দোর থেকে আরো শক্তিশালী মেশিন আনার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। উৎকণ্ঠা বাড়তে থাকে।
পাঁচ পরিকল্পনা
ভারতের প্রধানমন্ত্রীর অফিস, বিশেষজ্ঞদের দল, জাতীয় ও রাজ্যের উদ্ধারকারী দল, সেনা মিলে ঠিক করে পাঁচটি পরিকল্পনা নিয়ে এগোনো হবে। সুড়ঙ্গের উপর থেকেও গর্ত করে পাইপ বসানোর কাজ হবে। তিনদিন কাজ কার্যত এগোয়নি। তখন পরিকল্পনা ও তার বস্তবায়নের প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়া হয়।
এন্ডোস্কোপির ক্যামেরায় শ্রমিকদের দেখা
২১ নভেম্বর আটক শ্রমিকদের প্রথম ছবি ও ভিডিও সামনে আসে। খাবার দেয়ার পাইপ দিয়ে এন্ডোস্কোপির ক্যামেরা ব্যবহার করে সেই ছবি ও ভিডিও তোলা হয়। সুড়ঙ্গের অন্যদিক থেকেও গর্ত করার কাজ শুরু হয়। ২২ নভেম্বর সামনের দিক থেকে ৪৫ মিটার পর্যন্ত গর্ত তৈরি ও পাইপ বসানোর কাজ শেষ হয়। কিন্তু মেশিনে লোহার রড এসে পড়ায় কাজ বন্ধ হয়ে যায়।
মেশিন গেল ভেঙে!
২৩ নভেম্বর ড্রিলিং মেশিনের প্ল্যাটফর্মে ফাটল ধরে। পরের দিন কোনো ধাতব বস্তুর সঙ্গে ধাক্কা লেগে বিদেশি মেশিনই ভেঙে যায়। তখনো প্রায় ১৯ মিটার গর্ত করা ও পাইপ বসানোর কাজ বাকি।
মানুষ বাঁচাতে আইনের বাইরে...
উপায় না দেখে এবার র্যাট হোল মাইনার্সদের কাজে লাগানো হয়। ভারতে র্যাট হোল মাইনিং বেআইনি। কিন্তু অনেক জায়গাতেই তারা কাজ করেন। এদের কাজে বিপদের সম্ভাবনা থাকলেও তারা অত্যন্ত দক্ষ কর্মী। ইঁদুরের মতো গর্ত করার কাজে তাদের জুড়ি নেই। তারা এবার কাজ হাতে নেন। ২৭ তারিখ তাদের কাজে লাগানো হয়। ২৪ ঘণ্টারও কম সময়ে তারা কাজ শেষ করে দেন।
অবশেষে মুক্তি
২৮ নভেম্বর সন্ধ্য়ায় পাইপ পৌঁছে যায় আটক শ্রমিকদের কাছে। তারপর জাতীয় ও রাজ্য বিপর্যয় মোকাবিলা দলের কর্মীরা সেখানে গিয়ে স্ট্রেচারে করে আটকদের একে একে উদ্ধার করেন। রাত আটটা নাগাদ প্রথম আটক শ্রমিক বাইরে আসেন। সবাইকে বের করতে কয়েক ঘণ্টা সময় লাগে।
সকলেই সুস্থ
৪১ জন শ্রমিককে উদ্ধার করে প্রথমে সুড়ঙ্গের মধ্যে অস্থায়ী হাসপাতালে তাদের পরীক্ষা করা হয়। বাইরে ৪১টি অ্যাম্বুলেন্স দাঁড়িয়ে ছিল। রাখা হয়েছিল হেলিকপ্টারও। তবে তার প্রয়োজন হয়নি।
ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা
উত্তরাখণ্ডের চারধাম যাত্রার(গঙ্গোত্রী, যমুনেত্রী, কেদারনাথ, বদ্রীনাথ) জন্য চার লেনের রাস্তা তৈরি করা হচ্ছিল। তার জন্যই এই সুড়ঙ্গ তৈরি করা হচ্ছিল। সুপ্রিম কোর্ট নিযুক্ত কমিটিই বলেছিল, এই কাজে প্রবল ঝুঁকি আছে। এই অ়ঞ্চল ধস ও চকিত বন্যাপ্রবণ। তাছাড়া মাটি ও পাথরের চরিত্রও বলে দিচ্ছে, এই কাজে ঝুঁকি থাকবে।
সতর্কবার্তা
শ্রমিকরা উদ্ধার পেলেও চিন্তা থেকেই গেল। পরিবেশবিদ দীপায়ন দে-ও ডিডাব্লিউকে বলেছেন, এখানে মাটি নরম। ধসপ্রবণ এলাকা। এই জায়গা সুড়ঙ্গ তৈরির পক্ষে উপযুক্ত নয়। সিভিল ইঞ্জিনিয়ার বিভাংশু কাপারওয়ানি ডিডাব্লিউকে বলেছেন, হিমালয়কে বাঁচাতে গেলে যত্রতত্র এভাবে সুড়ঙ্গ তৈরি বন্ধ করতে হবে। বিশেষজ্ঞদের কথা মানা হবে কি?