রাজনীতির ‘ঘোলাজলে' আ-আম জনতা, ভূমিহীন ও অন্যান্য
২৪ এপ্রিল ২০২৫সেই তালিকায় সবার আগে আসবে বাংলাদেশ অ-আম জনতা পার্টির নাম৷ দলটি বাড়তি মনযোগ কাড়ে ডেসটিনি গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ রফিকুল আমীনের কারণে৷ তিনিই দলটির প্রতিষ্ঠাতা৷ ১২ বছর তিন মাস কারাভোগ করার পর গত ১৫ জানুয়ারি ছাড়া পান তিনি৷ তার তিন মাস দুই দিন পর গত ১৭ এপ্রিল গড়েন রাজনৈতিক দল আ-আম জনতা পার্টি৷ দল গঠনের আনুষ্ঠানিক ঘোষণার দিন এক সংবাদ সম্মেলনে দলটির পক্ষ থেকে ৯ দফা কর্মসূচি ঘোষণা করেন তিনি। সংবাদ সম্মেলনে রফিকুল আমীন বলেন, ‘‘বৈষম্যহীন সমাজ প্রতিষ্ঠা করা, সামাজিক ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার মাধ্যমে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করা এবং বাংলাদেশের সাধারণ জনগণকে রাজনৈতিকভাবে সচেতন করে তোলার লক্ষ্যে বাংলাদেশের আপামর জনতা 'বাংলাদেশ আ-আম জনতা পার্টি (বিএজেপি)' নামে একটি নতুন গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দল প্রতিষ্ঠা করেছে।''
জানানো হয়, বাংলাদেশ আ-আম জনতা পার্টির স্লোগান হলো, ‘‘শিক্ষা-সমতা সু-বিচার যেখানে, আ-আম জনতা হাঁটবে সেখানে৷''
কারামুক্তির পর এত দ্রুত রাজনৈতিক দল গঠন করার কারণ জানতে চাইলে তিনি ডয়চে ভেলেকে বলেন, "আমি ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে ছিলাম। ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর সারারাত, সারাদিন কারাগারে আটকদের ছেড়ে দেয়া হয়েছে। ফজর পর্যন্ত ছেড়েছে। তাদের জামিন ছিল না, কাগজ ছিল না। কিন্তু তাদের ছেড়ে দিয়ে কারাগার ৮০ ভাগ খালি করে ফেলা হয়। এইভাবে সাত, আট ১০ দিন ছাড়া হয়। তখনকার আইজির নির্দেশে ছাড়া হয়। আমি জেলারকে না পেয়ে সুপারকে আমাকেও ছেড়ে দেয়ার জন্য বলি। কিন্তু তখন আমাকে বলে, আপনি তো রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত নন, আপনার তো রাজনৈতিক দল নাই। আপনার জন্য কোনো সুপারিশও নাই। আপনি আদালতে গিয়ে জামিন নিয়ে আসেন।”
"ওই রাতে আমি যে-কোনো দলের লোক হলেই ছাড়া পেতাম। আমি মজা করে বলি, হরকাতুল জিহাদ হলেও ছাড়া পেতাম। বড় বড় নেতাদের ছেড়ে দেয়া হলো এক-এক করে। যারা ছোটখাটো তাদের একসঙ্গে নিয়ে জেলখানার বাইরে ছাড়া হলো। তখন একটা রিউমার ছিল- জেলখানা ভেঙে ফেলা হবে। তাদের বলা হলো- জেলখানা ভাঙিস না, চলে যা। কিন্তু আমি তো হাসিনার সময় নির্যাতিত। আমাকে ছাড়া হলো না,” বলেন তিনি।
সেই কারণেই কি এত দ্রুত রাজনৈতিক দল গঠন করলেন? রফিকুল আমীনের জবাব, " বিষয়টা হলো, রাজনৈতিক প্ল্যাটফর্ম থেকে আওয়াজ তোলা যায়। সেই আওয়াজ সবখানে পৌঁছে যায়। দাবি জানানো যায়। নির্যাতিতরা কথা বলতে পারে। আমি আমার কথা, মানুষের কথা তুলে ধরতেই রাজনৈতিক দল গঠন করেছি। আমি আমার দলের মাধ্যমে আমার ওপর জুলুমের কথা বলবো।”
তিনি জানান, এরই মধ্যে আ-আম জনতার পার্টির নিবন্ধনের জন্য নির্বাচন কমিশনে আবেদন করেছেন। কমিশন নিবন্ধনের সময় আরো দুই মাস বাড়িয়েছে। এই সময়ের মধ্যে শর্ত পূরণ করে তার দল নিবন্ধন পাবে বলে আশা তার, " ডেসটিনির অল্প কিছু লোক ছাড়া আর সবাই আমার সঙ্গে আছে। সুতরাং কোনো সমস্যা হবে না।” আগামী নির্বাচনে ৩০০ আসনে প্রার্থী দেয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন বলেও জানিয়েছেন তিনি৷
বাংলাদেশে এখন নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলের সংখ্যা ৫০টি। ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর থেকে নির্বাচন কমিশনে এপর্যন্ত ৬৫টি রাজনৈতিক দল নিবন্ধনের জন্য আবেদন করেছে। এই সময়ে আদালতের নির্দেশে চারটি নতুন রাজনৈতিক দলকে নিবন্ধন দেয়া হয়।
৫ আগস্টের পর ৮ মাসে এনসিপিসহ দেশে নতুন ২২টি রাজনৈতিক দলের আত্মপ্রকাশ করেছে। আর চারটি নতুন রাজনৈতিক প্ল্যাটফর্ম তৈরি হয়েছে। দল আর প্ল্যাটফর্ম মিলিয়ে মোট ২৬টি।
নতুন রাজনৈতিক দল হিসেবে নিবন্ধনের জন্য যারা আবেদন করেছে, তাদের একটি ‘বাংলাদেশ রিপাবলিক পার্টি'। এই দলের প্রধান হলেন মো. জয়নাল আবেদীন জমিদার। তার কোনো জমিদারি নেই, নির্দিষ্ট কোনো পেশাও নেই। বাংলাদেশ রিপাবলিক পার্টির প্রধান কার্যালয় গাইবন্ধার সুন্দরগঞ্জে। দল গঠনের কারণ জানতে চাইলে মো. জয়নাল আবেদীন জমিদার বলেন," উত্তারাঞ্চলের মানুষের শিক্ষা, কর্মসংস্থান ও উন্নয়নের জন্যই দল গঠন করেছি। দেশের পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে নতুন সুযোগ তৈরি হয়েছে। আমরাও কিছু করতে চাই।”
দলের নিবন্ধন পেতে যেসব শর্ত পূরণ করতে হয় তা দুই মাসের মধ্যে পূরণ করতে পারবেন কিনা জানতে চাইলে বলেন," হাইকোর্টে একটি রিট আছে। ফলে নির্বাচন কমিশন যে শর্ত দিচ্ছে, শেষ পর্যন্ত তা লাগবে না। যে-কোনো নাগরিকই রাজনৈতিক দল গঠন করতে পারবে। আবার শর্ত কী?” শর্তের গুরুত্ব না দিলেও নিবন্ধনের গুরুত্ব অস্বীকার করেননি, দলের নিবন্ধন পেতে এই প্রতিবেদকের সহায়তাও চেয়েছেন তিনি।
নির্বাচন কমিশনের নীতিমালা অনুযায়ী নিবন্ধন পেতে হলে যে শর্তগুলো পূরণ করতে হবে, সেগুলো হলো :
১. স্বাধীনতার পর অনুষ্ঠিত কোনো সংসদ নির্বাচনে দলীয় প্রতীকে কমপক্ষে একটি আসনে বিজয়।
২. সেসব নির্বাচনে দলটির প্রার্থীরা যেসব আসনে অংশ নিয়েছেন, সেসব আসনে মোট ভোটের ৫ শতাংশ অর্জন।
৩. কেন্দ্রীয় কমিটিসহ একটি সক্রিয় কেন্দ্রীয় অফিস থাকতে হবে। দেশের অন্তত এক-তৃতীয়াংশ জেলায় জেলা অফিস থাকতে হবে। আর অন্তত ১০০টি উপজেলা বা মেট্রোপলিটন এলাকার থানায় অফিস থাকতে হবে, যার প্রতিটিতে সদস্য হিসেবে কমপক্ষে ২০০ জন ভোটার থাকবে।
এই তিনটি শর্তের যে-কোনো একটি পুরণ ছাড়াও নিবন্ধন পেতে আগ্রহী দলটির গঠনতন্ত্রে কেন্দ্রীয় কমিটিসহ সব কমিটির সদস্য নির্বাচিত করা; কমিটিতে কমপক্ষে ৩৩ শতাংশ নারী সদস্য রাখা (২০৩০ সালের মধ্যে পূরণ)সহ আরো কিছু বিধান রাখার শর্ত আছে।
যাদের কোনো ভূমি নেই তাদের জন্য চলে এসেছে ‘জাতীয় ভূমিহীন পার্টি'৷ দলের সভাপতি আবু তাহের খন্দকার ডয়চে ভেলেকে বলেন, " আমার ভাই, কয়েক বছর আগেই দলটি গঠন করেন। কিন্তু তিনি মারা যাওয়ার পর সক্রিয় ছিল না। এবার আমি চিন্তা করে দেখলাম, যেহেতু নিবন্ধনের সুযোগ দিয়েছে, তাই কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলে আবেদন করে দিলাম। নিবন্ধন পেলে নির্বাচনেও অংশ নেবো।” এই দলটির অফিসের ঠিকানা সাভারের আশুলিয়া এলাকায়।
নিবন্ধনের অপেক্ষায় থাকা আরেক দল ‘বাংলাদেশ একুশে পার্টি'৷ দলটির সভাপতি রবিউল আলম। দলের কার্যালয় ঢাকার ইব্রাহীমপুরে। দলের প্রধান ডয়চে ভেলেকে বলেন, " এদেশে সব কিছুই রাঘব বোয়ালরা খেয়ে ফেলে। গরিবরা কিছু পায় না। যেহেতু নতুন একটি পরিবেশ তৈরি হয়েছে, তাই আমরা গরিবদের জন্য কাজ করতে এই দল গঠন করেছি। ১১টি জেলায় কমিটি করেছি। আশা করি, ২২ জেলায় কমিটি করে নিবন্ধন পাবো।”
" ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমেই আমরা সব পেয়েছি। তাই দলের নাম বাংলাদেশ একুশে পার্টি। আর প্রতীক চেয়েছি শাপলা। পাবো কিনা জানি না,” বলেন তিনি । দলটির প্রধান পেশায় একজন শিক্ষক । তার নিজের একটা স্কুল আছে বলে জানিয়েছেন তিনি।
আ-আম জনতা পার্টি, বাংলাদেশ রিপাবলিক পার্টি, জাতীয় ভূমিহীন পার্টি, বাংলাদেশ একুশে পার্টি-র মতো দলগুলো সম্পর্কে রাজনৈতিক বিশ্লেষক ড. জাহেদ উর রহমান বলেন, "একটি গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় নতুন দল হতেই পারে। কিন্তু একটি রাজনৈতিক দলের কাজই হবে রাজনীতি করা। কিন্তু দেশে একটি পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে নানা হিসাব- নিকাশ হচ্ছে। নির্বাচন হবে কিনা, হলে কী রকম হবে। ফলে রাজনীতির পানি, নির্বাচনের পানি ঘোলা হচ্ছে। এই ঘোলা পানিতে মাছ শিকারের জন্য অনেকেই রাজনৈতিক দল গঠন করছে। এদের হয়তো সাধারণ মানুষ চেনে না। মানুষের সঙ্গে যোগাযোগও নাই। তারপরও কিছু একটা পাওয়ার আশায় কেউ কেউ রাজনৈতিক দল করছেন।”
একই প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. সাব্বির আহমেদ বলেন, " এটা নির্বাচনি রাজনীতির একটা প্রবণতা। ওয়ান ম্যান শো-র মতো রাতারাতি রাজনৈতিক দল হয়। তারা নানা সুবিধার আশায় এটা করে। কখনো আবার সরকারের ইচ্ছায় হয়। গত নির্বাচনের আগেও আমরা দেখেছি। আর এটার সুযোগ তৈরি হয় রাজনীতিতে গুণগত মানের অবনমনের কারণে।”
"৯০-এর দশকের পরে দেশে কোনো আদর্শিক দল তৈরি হয়নি। এটা নির্বাচনকে সামনে রেখে হয়েছে। বড় রাজনৈতিক দলগুলোও এরকম রাজনৈতিক দল তৈরিতে কাজ করে। তারা এদের নিয়ে জোট করে। জোটে দলের সংখ্যা বাড়ায়। শক্তি দেখায়.” বলেন তিনি।
তার কথা, " তবে নির্বাচনের পর এসব রাজনৈতিক দল আর সক্রিয় থাকে না। কয়েকটি বড় দলই থাকে। এরা নির্বাচনকে সামনে রেখে আসে আবার নির্বাচনের পর হারিয়ে যায়।”
প্রসঙ্গত, নতুন রাজনৈতিক দলের নিবন্ধনের সময় ২২ জুন পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে।