‘যে সস্তার কারণে গ্রোথ ভালো ছিল, সেটা যেন অব্যাহত থাকে’
৮ আগস্ট ২০২৫মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আরোপিত নতুন শুল্কহারেবাংলাদেশের রপ্তানি খাতের কী অবস্থা হবে? প্রতিযোগিতায় টিকতে বাংলাদেশের করণীয় কি? রপ্তানির ক্ষেত্রে পোশাক শিল্পের পাশাপাশি অন্য কোনো খাতেও মনোযোগ বাড়ানো উচিত? শুল্ক কমায় যেসব সুবিধা যুক্তরাষ্ট্রকে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে, তাতে কি বাংলাদেশ লাভবান হবে? এসব বিষয়ে ডয়চে ভেলের সঙ্গে কথা বলেছেন এফবিসিসিআই'র সাবেক সভাপতি ও হামিম গ্রুপের স্বত্বাধিকারী এ কে আজাদ।
ডয়চে ভেলে : বর্তমান শুল্ক পরিস্থিতিতে যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানিতে বিশেষ করে পোশাক খাতের রপ্তানিতে বাংলাদেশ বিশেষ সুবিধা কি পাবে?
এ কে আজাদ : বিশেষ কোনো সুবিধা পাবে বলে মনে হচ্ছে না। আমরা খুবই চাপের মধ্যে থাকবো।তার কারণ, যে শুল্কটা বেড়েছে, সেটা কাস্টমার একা বহন করতে চাচ্ছে না। তার একটা অংশ আমাদের বহন করার জন্য বলছে। তাদের এই প্রস্তাব নিয়ে আলোচনা চলছে। অনেক ক্রেতাই গত বছরে যে পরিমাণ আমদানি করেছেন, এবার তার চেয়ে অনেক কমিয়ে দিচ্ছেন। এ কারণে পুরো রপ্তানির উপর একটা চাপ তৈরি হবে। কিছু কিছু দেশে শুল্ক বৃদ্ধির ফলে ব্যবসা যে আমাদের দেশে শিফট হয়ে আসবে, তেমনটাও মনে হচ্ছে না।
এই শিল্পকে টেকসই করতে কী ধরনের কাজ করা যেতে পারে?
আমি মনে করি, সরকারকে এগিয়ে আসতে হবে। আমাদের যে সোর্স ট্যাক্স সরকার কেটে নিচ্ছে ১০০ শতাংশ, এইটা আপাতত প্রত্যাহার করা উচিত। প্রতিযোগী দেশের তুলনায় যদি আমরা ‘কস্ট এফেকটিভ' না হই, অর্থাৎ, সস্তা না হয়, তাহলে কিন্তু আমাদের দেশে কাস্টমার থাকবে না। বরং অন্যান্য দেশে চলে যাবে। যে সস্তার কারণে আমাদের গ্রোথ এতদিন ভালো ছিল, সেটা যেন অব্যাহত থাকে, সেজন্য সরকারকে এগিয়ে আসতে হবে।
শুল্ক বাড়ার কারণে কি রপ্তানি কমে যেতে পারে? যদি রপ্তানি কমে, তাহলে শ্রমিকদের উপর কী ধরনের প্রভাব পড়বে?
দাম কমে গেলে লভ্যাংশও কমে যাবে। অন্যদিকে খরচ তো বেড়ে যাচ্ছে। ফলে এমন পরিস্থিতিতে আমি মনে করি, সরকার এবং মালিকপক্ষ বসে একটা মতবিনিময়ের মাধ্যমে পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত।
সরকার যুক্তরাষ্ট্রকে কিছু বিশেষ সুবিধা দেওয়ার কথা বলেছে। পরবর্তী নির্বাচিত সরকারের পক্ষে এই সুবিধাগুলো বহাল রাখা কতটা সম্ভব হবে?
অবশ্যই সম্ভব হবে। কারণ, সরকার যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছে, তার মধ্যে আছে, আমরা তুলা আমদানি করবো। আগে যুক্তরাষ্ট্র থেকে যে পরিমাণ তুলা আমদানি করতাম, এখন সেটা আরো বাড়িয়ে দেবো। দ্বিতীয়ত, আমরা গম আমদানি করবো, ভুট্টা আমদানি করবো, এনার্জি আমদানি করবো, এরোপ্লেন আমদানি করবো। সবকিছু মিলেই আমরা আগের তুলনায় অনেক বেশি সচেতন হয়েছি। ফলে, এখানে আমদানি এবং রপ্তানির মধ্যে একটা ব্যবধান আছে, সেটা কমিয়ে ফেলবো। যেমন ধরেন, আমি আমার কোম্পানিতে এখন থেকে অন্তত ৮০ ভাগ যুক্তরাষ্ট্রের তুলা ব্যবহার করবো। বাকি ২০ ভাগ অন্য জায়গা থেকে সংগ্রহ করবো। এখানে সরকার একটা ক্লজও দিয়েছে যে, যুক্তরাষ্ট্রের তুলা ব্যবহার করলে কিছু ছাড়ও পাওয়া যাবে। সেইটা আমরা পাওয়ার চেষ্টা করবো।
আমরা গম, ভুট্টা যে আমদানি করবো, সেগুলো আসতে তো এক-দেড় মাস লেগে যাবে। এই দীর্ঘ সময় জাহাজে থাকার পর সেগুলো কি মানুষের খাবারের উপযুক্ত থাকবে? নাকি পশু খাদ্যে পরিণত হবে? আবার আমরা যে ২৫টি বোয়িং কিনতে চাই, সেটার বাজার কি বাংলাদেশে আছে?
আমরা তো এগুলো রাতারাতি আনছি না। এগুলো পর্যায়ক্রমে আসবে। আমরা যে তুলা আমদানি করি, বিশ্বের মধ্যে চীনের পরই দ্বিতীয় তুলা আমদানিকারক দেশ আমরা। ভারত কম আমদানি করে, পাকিস্তানেরও নিজস্ব তুলা আছে। আমাদের কিন্তু তুলা নেই। আমরা শতভাগ তুলা আমদানি করি। এনার্জি নিয়ে আমাদের অ্যাগ্রিমেন্ট হয়েছে। এনার্জি আমরা মধ্যপ্রাচ্য থেকে আনি, সেটা এখন থেকে যুক্তরাষ্ট্র থেকে আনবো। এসবের মাধ্যমে অবশ্যই আমরা ব্যবধানটা কমিয়ে আনতে পারবো।
সরকার বোয়িং কেনাসহ আমদানি-রপ্তানির ব্যবধান কমাতে যে দিকে মনযোগ দিয়েছে, এদিকে না গিয়ে এর সমপরিমাণ অর্থ দিয়ে আমরা কি অন্য কিছু কিনতে পারতাম না যা দেশের প্রয়োজনে লাগে?
পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে আমরা আলোচনা করেছি।এর বাইরে যাওয়ার সুযোগ ছিল না। আমাদের পক্ষে যে জিনিসগুলো আমদানি করা সম্ভব, সেগুলো নিয়ে কথা হয়েছে। যেমন ধরেন, স্ক্র্যাপ আমাদের নেই, সেটা নিয়ে আলোচনা হয়েছে। এখানে দামটাও তো দেখতে হবে। একই জিনিস যদি আমি ভারতে বা চীনে কম মূল্যে পাই, তাহলে বেশি মূল্যে কোনো ব্যবসায়ি ওখান থেকে আনবে না। আমরা বিশ্লেষণ করে দেখেছি, যেগুলো অন্যান্য দেশের তুলনায় সস্তায় পাবো, সেগুলো ওখান থেকে আনবো।
শুল্ক কমাতে আমরা যেসব সুবিধা যুক্তরাষ্ট্রকে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছি, তাতে কি বাংলাদেশ লাভবান হবে, নাকি ক্ষতিগ্রস্থ হবে?
ক্ষতিগ্রস্থ হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই, আমরা লাভবান হবো।
রপ্তানির ক্ষেত্রে পোশাক শিল্পের পাশাপাশি অন্য কোনো খাতে মনযোগ বাড়ানো উচিত?
আমরা চামড়া এবং চামড়াজাত পণ্যের দিকে মনযোগ দিতে পারি। এক্ষেত্রে আমাদের প্রচুর সম্ভাবনা আছে। পাট, পাট শিল্প এবং পাটের তৈরি জিনিস আমরা রপ্তানির ক্ষেত্রে মনযোগ দিতে পারি। আমরা কৃষিপণ্যে মনযোগ দিতে পারি, যেটা আমরা এখন মোটেই করছি না। এখানে কিন্তু আমাদের অনেক সম্ভাবনা আছে। নতুন নতুন জায়গায় আমাদের যাওয়া উচিত। এই প্রশ্নটা খুবই প্রাসঙ্গিক। আমাদের অন্যদিকে যাওয়াটা জরুরি। পাশাপাশি অন্যান্য দেশের দিকেও আমাদের মনযোগ দেওয়া উচিত। ব্রাজিল, রাশিয়া, চীন, ভারত এসব দেশে আমাদের রপ্তানি বাড়াতে হবে।
ভারতে যে অতিরিক্ত শুল্ক আরোপ করেছে যুক্তরাষ্ট্র, এতে আমরা কিভাবে লাভবান হতে পারি?
আমার মনে হয়, এটা একটা ট্রাম্প প্রশাসনের সাময়িক থ্রেট।যেহেতু ২৫ দিনের সময় আছে, ফলে আমি মনে করি, আলোচনার মাধ্যমে এটা প্রত্যাহার হবে। এটা দীর্ঘস্থায়ী হবে না, কারণ, ভারতের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের ২১২ বিলিয়ন ডলারের ট্রেড। ৭৬ বিলিয়ন ডলার ভারতের সঙ্গে তাদের গ্যাপ আছে। ফলে এটা একটা বিশাল বাণিজ্য, যেটা আলোচনার মাধ্যমে সমাধান হবে। তবে যদি সমাধান না হয়, তাহলে আমরা লাভবান হতে পারি, অনেক ব্যবসা আমাদের দেশে চলে আসতে পারে।
২০১৯ সালের পর এ মাসেই মোদী চীন সফরে যাচ্ছেন। সেখানে পুটিনেরও আসার কথা। বিশ্ব রাজনীতির নতুন এই মেরুকরণে আমাদের বাণিজ্যে কোনো প্রভাব পড়তে পারে?
সেই ধরনের কোনো প্রভাব পড়ার সম্ভবনা নেই। চীনে আমরা কোনো পন্য রপ্তানি করতে পারি না। আমাদের রপ্তানি এক বিলিয়ন ডলারের নিচে। অথচ চীন থেকে আমরা ২৪ বিলিয়ন ডলার আমদানি করি। ভারতে দুই বিলিয়ন ডলার আমরা রপ্তানি করি। আর ভারত থেকে আনি ১২ বিলিয়ন ডলার। চীনে ওদের প্রোডাক্ট কস্ট এত কম যে আমরা সেখানে রপ্তানি করতে পারি না। ফলে যুক্তরাষ্ট্রের পর আমাদের বিকল্প দেশ হবে রাশিয়া, জাপান, ভারত। মোদী, পুতিন আর চীনের নেতৃবৃন্দ একসঙ্গে বসলেই রাতারাতি সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে, বিষয়টি তেমন না। দীর্ঘ সময় ধরে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ভারতের একটা ব্যবসায়িক সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। রাতারাতি সেটা শিফট হবে না।
এখন তো ১৫ শতাংশের সঙ্গে অতিরিক্ত ২০ শতাংশ শুল্ক দিয়ে রপ্তানি করতে হবে। ফলে শ্রমিক পর্যায়ে এর কোনো প্রভাব পড়বে কিনা?
শ্রমিক পর্যায়ে প্রভাব পড়বে না এই কারণে যে, আমাদের শ্রমিকদের সঙ্গে তো অ্যাগ্রিমেন্ট আছে। ফলে আমরা চাইলেই তার চেয়ে কম দিতে পারবো না। এখানে তো শুধু ৩৫ শতাংশ না, নন-কটন আইটেমে ২৪ আর ২০ শতাংশ মিলিয়ে শুল্ক দাঁড়াবে ৪৪ শতাংশে। নন-কটন আইটেমে আমাদের চ্যালেঞ্জটা বেশি পড়বে। যুক্তরাষ্ট্রে সাধারণ ক্রেতাদের উপর চাপটা বেশি পড়বে। তাদের দামটা বাড়িয়ে দিতে হবে। আমাদের তো আর কমানোর কোনো জায়গা নেই। সেটা আমরা ক্রেতাদের বোঝানোর চেষ্টা করছি।
শুল্কের এই চাপে কি ছোটখাটো পোশাক কারখানা বন্ধ হয়ে যেতে পারে ?
ছোট কারখানাগুলো বন্ধ হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। কারণ, নতুন নতুন মার্কেট তৈরি হচ্ছে। ছোট কারখানাগুলো সিঙ্গাপুরে মাল পাঠাচ্ছে, মধ্যপ্রাচ্যে, ভারতে মাল পাঠাচ্ছে। তাদের প্রোডাকশন কস্ট কম, ফলে তারা এসব দেশে ভালো রপ্তানি করছে।