যেসব স্থানে ইফতার মেলে বিনামূল্যে
রমজান মাসে রাজধানী ঢাকাসহ দেশের অনেক স্থানে বিনা পয়সায় ইফতার খাওয়ান অনেকে। কেউ কেউ সেহরিও খাওয়ান বিনামূল্যে। ছবিঘরে এমন কিছু মহতি উদ্যোগের কথা...
জয়পুরহাটে রফিক হোটেল
জয়পুরহাটের আক্কেলপুর কলেজ বাজারে রফিক হোটেলে প্রতিদিন বিনা পয়সায় ইফতার ও সেহরি খাওয়ানো হয়। ইফতারে থাকে তেহারি ও সালাদ। সেহরিতে সপ্তাহে তিন দিন গরুর মাংস ও চার দিন মাছ-ডিম, ভর্তা-ভাজি ও দুধ দেওয়া হয়। হোটেলের ভেতরে জায়গা কম থাকায় বাইরে বসে অনেকে ইফতার করেন। এখানে ২০১৬ সাল থেকে রমজান মাসে প্রতিদিন গড়ে ১৫০ জন ইফতার পাচ্ছেন। ২০২০ সাল থেকে রোজ গড়ে ১০০ জনকে সেহরিও খাওয়ানো হয় এই হোটেলে।
কষ্টের অতীত ভোলেননি রফিক
রফিক হোটেলের মালিক রফিকুল ইসলাম সোনার বিনা মূল্যে ইফতার ও সেহরি খাওয়ানোর কারণ জানাতে গিয়ে বলেন, ‘‘ছোটবেলায় অনেক কষ্টে দিন পার করতাম। তখন আমার বাবা রুটি বিক্রি করতেন। ১৯৯৫ সাল থেকে আমি খাবার হোটেলের ব্যবসা করছি। প্রতিবছর রমজান ব্যতীত ১১ মাস আমি ও আমার ভাই রবিউল ইসলাম ১০০০-১৫০০ টাকা করে জমিয়ে রাখি। সেই অর্থ দিয়ে রোজাদার, অসহায়, দুস্থ ও অভুক্ত মানুষকে ইফতার ও সেহরি দেই। এর ফলে আমার খুব আনন্দ হয়।’’
ঢাকায় মেহমানখানা
ঢাকার লালমাটিয়ায় ডি-ব্লকে ২০২০ সাল থেকে রমজান মাসে প্রতিদিন ৭০০ জনকে ফ্রি ইফতার দেওয়া হয়। এই আয়োজনের নাম ‘মেহমানখানা’। খাবারে থাকে ছোলা, খেজুর, লেবুর শরবত, খিচুড়ি ও ফল। সাধারণ মানুষের সহায়তায় এটি পরিচালিত হয়। কৃষি মার্কেটের সিটি স্টোর বাকিতে প্রয়োজনীয় পণ্য দেয়। সারাবছর ধরে একটু একটু করে বাকি পরিশোধ করা হয়।
‘মানুষ একটু খেয়ে বাঁচুক’
মেহমানখানার উদ্যোক্তা ও নাট্যকর্মী আসমা আক্তার লিজা বলেন, ‘‘করোনাকালে মেহমানখানার যাত্রা শুরু হয়। এর বিশেষত্ব হলো, এখানে সবাইকেই প্লেটে সাধ্যমতো খাবার দেওয়া হয়। আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি হলো– জীবনের অপচয় না হোক, মানুষ একটু খেয়ে বাঁচুক। আমাদের ৫০-৬০ জন স্বেচ্ছাসেবী মিলে ইফতার তৈরি করেন। তাদের মধ্যে ২০ জন অনাথ ও অসহায় কিশোরী একসময় মেহমানখানায় ইফতার নিতে আসতো, এখন তারা আমাদের নিয়মিত স্বেচ্ছাসেবী।’’
বিদ্যানন্দের ইফতার
নিম্ন আয়ের মানুষের জন্য ইফতার কিনে খাওয়া কষ্টসাধ্য। সেজন্য ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী ও কুড়িগ্রামে বিনা পয়সায় ইফতার বিতরণ করে স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশন। রমজান মাসে প্রতিদিন ৫০০ জনকে ইফতার করাতে ঢাকায় একটি কমিউনিটি সেন্টার ভাড়া নিয়েছে এই সংগঠন। চট্টগ্রামে বিপ্লব উদ্যানে রোজ থাকছে বিনা পয়সায় ইফতারের আয়োজন। এছাড়া অনেক দুস্থ পরিবারকে ইফতারের ডালা উপহার দিচ্ছে বিদ্যানন্দ।
১ টাকায় রোজার বাজার
বিদ্যানন্দের পরিচালক (গভর্নিং বডি) মোহাম্মদ জামাল উদ্দিন ডিডাব্লিউকে জানান, গণঅর্থায়নে ইফতার বিতরণ করছেন তারা। এছাড়া নিম্ন আয়ের শ্রমজীবী, ভ্যান ও রিকশাচালক, ভিক্ষুক, এতিম, অসহায় ও দরিদ্র শ্রেণির মানুষের জন্য ১ টাকায় রোজার বাজার রয়েছে তাদের। এতে ১ টাকার বিনিময়ে ২১টি পণ্যের সমাহার কেনা যায়। পাশাপাশি ঢাকার বিভিন্ন ওয়ার্ড ও বস্তিতে স্বল্পমূল্যে ফুড প্যাকেজ বিক্রি করে বিদ্যানন্দ।
সাবেক ক্রিকেটার বীথির উদ্যোগ
রংপুর নগরীর পাটবাড়িতে রমজান মাস জুড়ে প্রতিদিন দুই শতাধিক দুঃস্থ মানুষকে বিনামূল্যে ইফতার দিচ্ছেন সাবেক নারী ক্রিকেটার আরিফা জাহান বীথি। মেয়েদের বিনামূল্যে প্রশিক্ষণ দিতে ২০১৯ সালে রংপুর জেলা স্টেডিয়ামে তিনি গড়ে তোলেন ‘উইমেন্স ড্রিমার ক্রিকেট অ্যাকাডেমি’। বীথি বলেন, ‘‘আমি দরিদ্র পরিবারে বেড়ে উঠেছি। একসময় আমরা না খেয়েও থাকতাম। তাই অসহায়দের ইফতার দিতে পেরে কত ভালো লাগে বলে বোঝানো যাবে না।’’
মাহফুজের ‘গরিবের মেহমানখানা’
নরসিংদীর শিবপুর উপজেলার যোশর ইউনিয়নের প্রতিবন্ধী তরুণ মাহফুজুর রহমান রানা গতবারের মতো এবারও রমজানে সপ্তাহে একদিন প্রায় ৩০০ জন দুঃস্থকে ইফতার খাওয়াচ্ছেন। দুই হাতের ওপর ভর দিয়ে রাধাগঞ্জ বাজারে গিয়ে নিজেই মাংস, সবজিসহ রান্নার বিভিন্ন উপকরণ কেনেন ৩০ বছর বয়সি মাহফুজ। তার কাছে কম দামে পণ্য বিক্রি করেন দোকানিরা। ইফতারে থাকে ভাত, ডাল, মাংস, সবজি, ফল। রান্নায় মাহফুজকে সহযোগিতা করেন প্রতিবেশীরা।
সাতক্ষীরায় ৬ হাজার মানুষের ইফতার
সাতক্ষীরার নলতা কেন্দ্রীয় আহছানিয়া মিশনে রমজান মাসে প্রতিদিন ছয় হাজার মানুষ একসঙ্গে ইফতার করেন। সুশৃঙ্খলভাবে ইফতার বন্টন করেন ৩০০ জন স্বেচ্ছাসেবী। নলতা কেন্দ্রীয় আহছানিয়া মিশনের সদস্য সচিব ডা. নজরুল ইসলাম ডিডাব্লিউকে জানান, সুলতানুল আউলিয়া খান বাহাদুর আহছানউল্লাহ (র.) ১৯৩৫ সালে বৃহৎ পরিসরে এই আয়োজন চালু করেন। ১৯৬৫ সালে তাঁর প্রয়াণের পর থেকে দানশীল মানুষেরা ইফতারের জন্য অর্থের জোগান দেন।
শহীদ মিনারে বিনামূল্যে ইফতার
টাঙ্গাইল শহরের শহীদ মিনারে রিকশাচালক, মাটি কাটা শ্রমিক, গৃহকর্মী, ভিক্ষুকসহ স্বল্প আয়ের, কর্মহীন ৩০০ মানুষকে বিনামূল্যে ইফতার দিচ্ছে ত্রিবেণী টাঙ্গাইল ও বিন্দুবাসিনী বালক উচ্চ বিদ্যালয় এসএসসি ব্যাচ-১৯৯২’র সাবেক শিক্ষার্থীরা। ট্রাফিক সদস্য, টহল পুলিশকেও ইফতার উপহার দেন তারা। সপ্তাহে চার দিন থাকে ছোলা, মুড়ি, আলুর চপ, বেগুনি, পিঁয়াজু, জিলাপি, শসা, ফল ও শরবত। বাকি তিন দিনের ইফতারে থাকে খিচুড়ি ও মাংস।
গাইবান্ধায় সম্প্রীতির ইফতার
গাইবান্ধা জেলা শহরের হকার্স মার্কেট গলিতে বাঙলা হোটেল অ্যান্ড রেস্টুরেন্ট এর স্বত্বাধিকারী সুজন প্রসাদ সম্প্রীতির উদাহরণ সৃষ্টি করেছেন। সনাতন ধর্মের মানুষটি রমজানে প্রতিদিন ১৫-২০ জন নিম্ন আয়ের মানুষকে বিনামূল্যে ইফতার দিচ্ছেন। সুজন ডিডাব্লিউকে বলেন, ‘‘মানুষ হিসেবে সমাজের প্রতি দায়বদ্ধতা থেকে দ্বিতীয়বারের মতো আমার এই আয়োজন। রোজাদারদের ইফতার পরিবেশন করে মনে শান্তি পাই।’’
ইফতার বুথ
ফেনীতে ‘বন্ধু মহল’-এর উদ্যোগে ইফতার বুথে প্রতিদিন বিনামূল্যে ইফতার মিলছে। রমজান মাসে রোগীর স্বজন ও পথচারীদের কথা ভেবে ফেনী সদর হাসপাতাল গেট সংলগ্ন স্থানে এই বুথ স্থাপন করা হয়েছে। উদ্যোক্তাদের আশা, তাদের এই উদ্যোগ দরিদ্রদের ইফতার খাওয়ার সাধ অন্তত মেটাবে।
মাগুরায় ফ্রেন্ডস অ্যান্ড ফ্যামিলির ইফতার
মাগুরা শহরের কয়েকজন বন্ধুর স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন ‘ফ্রেন্ডস অ্যান্ড ফ্যামিলি’ প্রতিদিন ১০০ থেকে ১৫০ জন দরিদ্র মানুষের হাতে বিনামূল্যে ইফতারের প্যাকেট তুলে দেয়। পাঁচ বছর ধরে রমজান মাস জুড়ে মাগুরা কলেজ রোডে চলছে এ উদ্যোগ। ইফতারের সব খাবার বন্ধুরা ও তাদের পরিবার ব্যবস্থা করে। ইফতারের খরচ মেটাতে বন্ধু ও শুভাকাঙ্ক্ষীরা সংগঠনটির তহবিলে অর্থের জোগান দেন।
বিনামূল্যে ইফতার সামগ্রী বিতরণ
মুন্সীগঞ্জে স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন বিক্রমপুর মানবসেবা ফাউন্ডেশন বিনামূল্যে ইফতার সামগ্রী বিতরণ করেছে। গত ১১ মার্চ সকালে কামারখাড়া স্কুল মাঠে জেলার ৪০০ হতদরিদ্র পেয়েছে বুট, মুড়ি, চিড়া, সয়াবিন তেল, খেজুর, চিনি ও ডাল। গত ছয় বছর রমজান মাসে ১০ টাকায় ইফতার সামগ্রী বিতরণ করলেও এবার পুরোপুরি বিনামূল্যে ইফতার সামগ্রী দিয়েছেন সংগঠনটির সদস্যরা।