মিয়ানমারে ভূমিকম্পে মৃত্যু হাজার ছাড়িয়েছে
২৯ মার্চ ২০২৫দেশটির ক্ষমতাসীন সামরিক জান্তা সরকার জানিয়েছে, মিয়ানমারে শুক্রবারের ভয়াবহ ভূমিকম্পে মৃতের সংখ্যা শনিবার এক হাজার ছাড়িয়েছে৷ জান্তা জানিয়েছে, শনিবার সকাল পর্যন্ত এক হাজার দুই জনের মরদেহ তারা উদ্ধার করতে পেরেছে৷ অন্তত ২,৩৭৬ জন আহত হয়েছেন বলেও জানিয়েছে জান্তা সরকারের তথ্য বিভাগ৷
সাত দশমিক সাত মাত্রার ভূমিকম্পটির কেন্দ্রস্থল ছিল মিয়ানমারের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর মান্দালয়ের কাছে৷ শুক্রবার দুপুরে ভূমিকম্প অনুভূত হয় এবং এরপর ছয় দশমিক চার মাত্রার আরেকটি শক্তিশালী আফটারশক অনুভূত হয়৷
ভূমিকম্পে মিয়ানমারের বিভিন্ন স্থানে ভবন, সেতু এবং রাস্তাঘাট ধ্বংস হয়ে যায়৷ মার্কিন ভূতাত্ত্বিকদের মতে এক শতাব্দীরও বেশি সময়ের মধ্যে দক্ষিণ-পূর্ব এশীয় দেশটিতে আঘাত হানা সবচেয়ে বড় ভূমিকম্প ছিল এটি৷
ভূকম্পন এতটাই শক্তিশালী ছিল যে ভূমিকম্পের কেন্দ্রস্থল থেকে শত শত কিলোমিটার দূরে থাইল্যান্ডের ব্যাংককেও বহুতল ভবনের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে৷
থাইল্যান্ডে উদ্ধারকাজে সময়ের সঙ্গে যুদ্ধ
ব্যাংককে ৩০ তলা ভবন ধসে পড়ার পর জীবিতদের সন্ধান অব্যাহত রয়েছে৷ আটকে পড়াদের জীবিত উদ্ধারে ৭২ ঘন্টার মধ্যে তাদের কাছে পৌঁছাতে হবে৷ কিন্তু ধ্বংসস্তূপে চাপা পড়া বিপুল কংক্রিট সরিয়ে কতজনকে উদ্ধার করা যাবে, এ নিয়ে দেখা দিয়েছে শঙ্কা৷
জনাকীর্ণ চাতুচাক মার্কেটের কাছে ৩০ তলা ভবনটি ছিল নির্মাণাধীন এবং ধসের আগে মিয়ানমার থেকে আসা অনেক অভিবাসী শ্রমিকসহ শতাধিক শ্রমিক ভবনটিতে কাজ করছিলেন৷
থাই কর্তৃপক্ষ প্রাথমিকভাবে জানিয়েছিল, ৩০ তলা ভবন ধসের ঘটনায় ১১০ জন পর্যন্ত নিখোঁজ থাকতে পারেন৷ তবে উদ্ধার অভিযান শেষ না হওয়া পর্যন্ত সংখ্যা বাড়তে বা কমতে পারে৷ ব্যাংককে শনিবার সকাল পর্যন্ত অন্তত আটজনের মৃত্যুর তথ্য নিশ্চিত করা হয়েছে৷
ব্যাংককের অগ্নিনির্বাপণ ও উদ্ধার বিভাগের পরিচালক সুরিয়ান রাভিওয়ান স্থানীয় গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন যে ১৫ জনকে জীবিত অবস্থায় তারা খুঁজে পেয়েছেন৷ শনিবারের উদ্ধার প্রচেষ্টায় ড্রোন, স্নিফার কুকুর এবং ক্রেন ব্যবহার করা হচ্ছে৷
চ্যালেঞ্জের মুখে মিয়ানমারের উদ্ধার প্রচেষ্টা
ভূমিকম্পের কেন্দ্রস্থলের কাছে দেশটির দ্বিতীয় শহর মান্দালয়ে ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ দৃশ্যমান৷ কিন্তু বিমানবন্দরের ক্ষতির কারণে অতিপ্রয়োজনীয় সাহায্যও দ্রুত পৌছানো যাচ্ছে না৷ রক্ষীরা সাংবাদিকদেরও সেখান থেকে ফিরিয়ে দিচ্ছে৷
এক রক্ষীর বরাত দিয়ে ফরাসি বার্তা সংস্থা এএফপি জানিয়েছে, ‘‘গতকাল থেকে এটি (বিমানবন্দর) বন্ধ রয়েছে৷ সিলিং ধসে পড়েছে কিন্তু কেউ আহত হয়নি৷''
এতদিন বিদেশী সাহায্য গ্রহণে ধীরগতি দেখালেও ভূমিকম্পের পর ক্ষমতাসীন সামরিক জান্তা শুক্রবার সহায়তার আবেদন জানিয়েছে৷ দেশটির সামরিক নেতা মিন অং হ্লাইং বলেছেন, মিয়ানমার সহায়তা গ্রহণে প্রস্তুত৷
এই আহ্বানে এখনও পর্যন্ত বেশ কয়েকটি দেশ সাড়া দিয়েছে৷
শনিবার ভোরে চীনের একটি দল ভূমিকম্প সনাক্তকারী যন্ত্র, ড্রোন এবং অন্যান্য সরবরাহ নিয়ে ইয়াঙ্গুন শহরে পৌঁছেছে বলে জানিয়েছে চীনের সরকারি সংবাদ সংস্থা সিনহুয়া৷
রাশিয়ার রাষ্ট্রীয় সংবাদ সংস্থা টাস জানিয়েছে, দেশটির জরুরি অবস্থা বিষয়ক মন্ত্রণালয় দুটি বিমানে অন্তত ১২০ জন উদ্ধারকারী এবং সরবরাহ পাঠিয়েছে৷
ভারতও একটি অনুসন্ধান ও উদ্ধারকারী দল এবং একটি মেডিকেল দল মিয়ানমারে পাঠিয়েছে৷ পাঠানো হয়েছে স্বাস্থ্যবিধি সরঞ্জাম, কম্বল, খাদ্য প্যাকেজ এবং অন্যান্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রও৷
জাতিসংঘ ত্রাণ প্রচেষ্টা শুরুর জন্য পাঁচ মিলিয়ন ডলার (এক ডলার = প্রায় ১২০ টাকা) বরাদ্দ করেছে৷ মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্প মার্কিন সহায়তার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন৷
দক্ষিণ-পূর্ব এশীয় দেশগুলোর সংগঠন - আসিয়ান শনিবার মিয়ানমার এবং থাইল্যান্ডকে উদ্ধার প্রচেষ্টায় সহায়তার প্রস্তাব দিয়েছে৷ আসিয়নের বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ‘‘ভূমিকম্প এবং এর প্রভাবে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবার এবং সম্প্রদায়ের সঙ্গে আসিয়ান সংহতি পুনর্ব্যক্ত করছে৷'' মানবিক সহায়তা এবং ত্রাণ কার্যক্রমের সমন্বয়ে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে আসিয়ান৷
মানবিক সহায়তাকে অস্ত্র হিসাবে ব্যবহারের অভিযোগ
২০২১ সালে অং সান সু চির নির্বাচিত সরকারকে উৎখাত করে সামরিক অভ্যুত্থানের পর থেকে চলমান গৃহযুদ্ধের ফলে মিয়ানমার একটি বিশাল মানবিক সংকটে ভুগছে৷
সামরিক বাহিনী মিলিশিয়া এবং নবগঠিত গণতন্ত্রপন্থি বাহিনীগুলোর সঙ্গে দীর্ঘস্থায়ী লড়াইয়ে ব্যস্ত৷
কিন্তু শুক্রবারের ভয়াবহ ভূমিকম্পের পরেও সামরিক বাহিনী বিদ্রোহীদের ওপর তাদের আক্রমণ অব্যাহত রেখেছে বলে জানা গেছে৷ এর মধ্যে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত মান্দালয় রাজ্যের সীমান্তও রয়েছে৷ সংবাদ সংস্থা রয়টার্স রাজ্যের বাসিন্দাদের সাক্ষাৎকার নিয়েছে৷ বাসিন্দারা বলছেন, তারা এখনও সামরিক বাহিনীর কাছ থেকে কোনও সাহায্য পাননি৷
সংবাদ সংস্থা এপিকে মানবিক সহায়তা কর্মী ডেভ আউব্যাঙ্ক জানিয়েছেন, তিনি যে এলাকায় কাজ করছিলেন তার বেশিরভাগই সামরিক বাহিনীর হামলায় ধ্বংস হয়ে গেছে৷ ভূমিকম্পের ফলে সেখানে খুব কম প্রভাব পড়েছে৷ সহায়তা সংস্থার ফ্রি বার্মা রেঞ্জার্স এর প্রতিষ্ঠাতা আউব্যাঙ্ক৷ সংস্থাটি ১৯৯০ সাল থেকে দেশটির যোদ্ধা এবং বেসামরিক নাগরিক উভয়কেই সাহায্য প্রদান করে আসছে৷
দেশটির বেশিরভাগ অংশ এখন আর সরকারের নিয়ন্ত্রণে নেই৷ ফলে বিদ্রোহীদের নিয়ন্ত্রণে থাকা অনেক অঞ্চলে ত্রাণ কর্মীদের জন্য বিপজ্জনক, আবার কিছু অঞ্চল একেবারেই দুর্গম৷
জাতিসংঘের পরিসংখ্যান অনুসারে এই লড়াইয়ের ফলে ৩০ লাখেরও বেশি মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছেন এবং প্রায় দুই কোটি মানুষ তীব্র অভাবের মধ্যে বাস করছেন৷
বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচির ডেপুটি কান্ট্রি ডিরেক্টর শিলা ম্যাথিউকে উদ্ধৃত করে রয়টার্স জানিয়েছে, ‘‘শক্তিশালী ভূমিকম্পটি দেশটিতে সবচেয়ে খারাপ সময়ে আঘাত হেনেছে৷ আরেকটি দুর্যোগ সহ্য করার ক্ষমতা মিয়ানমারের নেই৷''
গণতন্ত্রপন্থি দলগুলোর সমান্তরাল বেসামরিক সরকার- জাতীয় ঐক্য সরকার রয়টার্সকে জানিয়েছে, ত্রাণ প্রচেষ্টায় সহায়তা করার জন্য তারা জান্তা-বিরোধী বাহিনী মোতায়েন করবে৷
অধিকার কর্মীরা উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন, অন্যান্য দেশ থেকে আসা সাহায্যও প্রান্তিক মানুষের কাছে পৌঁছাবে না৷ মিয়ানমারের জান্তা সরকার এর আগেই নানা দুর্যোগের সময় দেশের বিরোধী নিয়ন্ত্রণাধীন কিছু অংশে ত্রাণ আটকে দিয়েছে৷
মিয়ানমারে জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক বিশেষ দূত থমাস অ্যান্ড্রুজ বলেছেন, ‘‘ঘূর্ণিঝড় মোচা এবং টাইফুন ইয়াগির সময় জান্তা ত্রাণ আটকে দেয়া এটাই প্রমাণ করে যে প্রাকৃতিক দুর্যোগের মধ্যেও সহায়তাকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করার ইচ্ছা রয়েছে তাদের৷'' তিনি জাতীয় ঐক্য সরকার, জাতিভিত্তিক সংগঠন এবং নাগরিক সমাজের সঙ্গে যৌথভাবে কাজ করে দুর্দশাগ্রস্তদের কাছে ত্রাণ পৌঁছানোর আহ্বান জানিয়েছেন৷
এডিকে/এআই (এপি, এএফপি, রয়টার্স)