মমতার দুই নিয়োগ নিয়ে বিতর্ক তুঙ্গে
৪ জানুয়ারি ২০২৪গত মাসে আইপিএস অফিসার রাজীব কুমার পশ্চিমবঙ্গ পুলিশের ভারপ্রাপ্ত ডিজি নিযুক্ত হয়েছেন। তার পরপরই স্বরাষ্ট্র সচিবের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে নন্দিনী চক্রবর্তীকে। এ নিয়ে রাজ্য সরকারকে তোপ দেখেছেন বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী।
অভিযোগ উড়িয়ে দিচ্ছে শাসক দল। তারা অতীতের একাধিক উদাহরণ দিচ্ছে। পুলিশ-প্রশাসনের সাবেক কর্তারাও এই নিয়োগকে বেআইনি বলে মনে করছেন না।
নিয়োগে সওয়াল
রাজীবের নিয়োগ ঘিরে রাজ্য রাজনীতিতে চর্চা চলছিলই। এরপর নন্দিনীর নিয়োগ বিতর্ককে আরো জোরদার করেছে। এ নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন বিরোধী দলনেতা।
এক্স হ্যান্ডেলে শুভেন্দু অধিকারী লিখেছেন, ''পশ্চিমবঙ্গে বেআইনিভাবে নিযুক্ত ভারপ্রাপ্ত ডিজিপি রাজীব কুমার যাতে ইচ্ছেমতো কাজ করতে পারেন, তা নিশ্চিত করতেই রাজ্য সরকার এ বার বেআইনিভাবে একজন জুনিয়র আইএএস অফিসার নন্দিনী চক্রবর্তীকে স্বরাষ্ট্র দফতরের প্রিন্সিপাল সেক্রেটারির পদে বসিয়েছে৷''
কেন ১৩ জন অতিরিক্ত মুখ্যসচিব এবং আরও পাঁচ জন প্রধান সচিবকে বাদ দিয়ে অপেক্ষাকৃত জুনিয়র নন্দিনী চক্রবর্তীকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে, প্রশ্ন তা নিয়েই।
আইএএস নিয়োগের ধারা তুলে ধরে শুভেন্দু অভিযোগ করেছেন, স্বরাষ্ট্রসচিব, অর্থাৎ স্বরাষ্ট্র ও পার্বত্য বিষয়ক বিভাগের প্রধানকে লেভেল ১৭-র একজন অফিসার হতে হবে, অর্থাৎ একজন অতিরিক্ত মুখ্যসচিব হতে হবে ৷ যার ফলে এটা স্পষ্ট, নন্দিনী চক্রবর্তীর নিয়োগ সম্পূর্ণ বেআইনি।
যদিও অবসরপ্রাপ্ত আইএএস, সাবেক কংগ্রেস বিধায়ক সুখবিলাস বর্মা এই দাবির সঙ্গে একমত নন। তিনি বলেন, ''রাজ্য সরকার তার পছন্দ মতো অফিসারকে নিয়োগ করতে পারে। সেটা বেআইনি নয়। তবে এতে নীতিগত প্রশ্ন আছে। কিন্তু রাজ্য বা কেন্দ্রীয় সরকার কি নীতি মেনে চলে?''
অবসরপ্রাপ্ত পুলিশকর্তা, রাজ্যের সাবেক আইপিএস অফিসার ড. নজরুল ইসলাম ডয়চে ভেলেকে বলেন, ''সিনিয়রদের টপকে জুনিয়র এর নিয়োগ এই প্রথম নয়। আইনেও কোনো বাধা নেই। এর আগে বাসুদেব বন্দ্যোপাধ্যায়কে স্বরাষ্ট্র সচিবের পদ দেয়া হয়েছিল।''
'আস্থাভাজনে' ভরসা?
মাস তিন-চারেকের মধ্যেই ভারতের সাধারণ নির্বাচন। জাতীয় নির্বাচন কমিশনের তত্ত্বাবধানে ও কেন্দ্রীয় বাহিনীর উপস্থিতিতে ভোটগ্রহণ করা হলেও রাজ্য পুলিশ ও স্বরাষ্ট্র দপ্তরের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা থাকে। বাহিনী পরিচালনা তাদের মাধ্যমে হয়।
অতীতে বারবার অভিযোগ উঠেছে, পুলিশ ও প্রশাসনকে ব্যবহার করে তৃণমূল কংগ্রেস নির্বাচনের ফলকে প্রভাবিত করেছে। একই অভিযোগ ছিল তার আগের বাম সরকারের বিরুদ্ধেও।
পশ্চিমবঙ্গের নির্বাচন পরিচালনায় তাই পুলিশ-প্রশাসনের ভূমিকা সব সময় বিতর্ক তৈরি করেছে। বিরোধীদের দাবি, আস্থাভাজন দুই আধিকারিককে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার পরপর নিয়োগ দিয়েছে নির্বাচনকে মাথায় রেখে।
বরাবরই মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের আস্থাভাজন নন্দিনী চক্রবর্তী। ১৯৯৪ ব্যাচের আইএএস মুখ্যমন্ত্রীর হাতে থাকা তথ্য সংস্কৃতি দপ্তরের সচিবের দায়িত্ব সামলেছেন। শিল্পোন্নয়ন দপ্তরের ডিরেক্টর করা হয়েছিল তাকে। পর্যটন দপ্তরের সচিব পদে যুক্ত হন। পরবর্তীতে রাজভবনের সচিব থাকাকালীন নন্দিনীকে ঘিরে বিতর্ক হয়। রাজ্যপাল সিভি আনন্দ বোস তাকে সরিয়ে দেন। ফের নবান্ন বহাল করে তাকে।
আইপিএস রাজীব কুমারও মুখ্যমন্ত্রীর ভরসাস্থল হিসেবেই পরিচিত। সারদা মামলায় রাজীবের বিরুদ্ধে তথ্য লোপাটের অভিযোগ উঠেছিল। কেন্দ্রীয় সংস্থা তার বাসভবনে অভিযান চালালে ধরনায় বসেছিলেন খোদ মুখ্যমন্ত্রী। সেই মামলা এখনো চলছে সুপ্রিম কোর্টে। এই অফিসারকে রাজ্য পুলিশের শীর্ষ পদে বসিয়েছেন নবান্ন।
দায়িত্ব ঘিরে প্রশ্ন
পুলিশ আধিকারিক হয়েও রাজীব রাজ্যের তথ্যপ্রযুক্তি দপ্তরের দায়িত্ব পেয়েছিলেন। বিরোধীদের বক্তব্য, একজন আইএএস অফিসারকে কি পুলিশের উচ্চপদে বসানো যায়? তা হলে কীভাবে আইপিএস রাজীব প্রশাসনের গুরুদায়িত্ব পেলেন?
অবসরপ্রাপ্ত পুলিশকর্তা, রাজ্যের সাবেক আইপিএস অফিসার ড. নজরুল ইসলাম ডয়চে ভেলেকে বলেন, ''রাজ্য সরকার কি সৎ মানুষদের নিয়োগ করে? যারা প্রমাণ লোপাট করে, তাদের নিয়োগ করে। এখনো অনেক মামলা আছে, অনেক তথ্য লোপাট করতে হবে। সেই অনুযায়ী নিয়োগ হয়েছে।''
জোড়া নিয়োগ প্রসঙ্গে তার মন্তব্য, ''পুলিশের ডিজি কাজ করবেন স্বরাষ্ট্র দপ্তরের অধীনে। তাই সেখানেও কাছের লোক না থাকলে সমস্যা হবে। এই নন্দিনী চক্রবর্তী রাজভবনে হাতেখড়ির আয়োজন করেছিলেন, মনে রাখতে হবে।''
আর এক সাবেক আইপিএস অফিসার, পুলিশের অবসরপ্রাপ্ত আইজি সন্ধি মুখোপাধ্যায় ডয়চে ভেলেকে বলেন, ''জুনিয়র হওয়া সত্ত্বেও নিয়োগ পাওয়ার পিছনে আস্থার বিষয়টি তো রয়েছে। আমরা যখন চাকরি করেছি তখনও ছিল। তবে এটা এখন ভয়াবহ আকার নিয়েছে।''
সাবেক আইএএস বাসুদেব বন্দ্যোপাধ্যায় বা আলাপন বন্দ্যোপাধ্যায়, সাবেক আইপিএস ভারতী ঘোষের কথা যেমন 'আস্থাভাজন' হিসেবে উঠে আসে, তেমনি রাজ্যের সাবেক নির্বাচন কমিশনার মীরা পাণ্ডের কথাও স্মরণে রাখার মতো। রাজ্য সরকারের সঙ্গে সরাসরি সংঘাতে নেমেছিলেন তিনি।
সুখবিলাস বর্মা বলেন, ''কজন অফিসারের মেরুদণ্ড শক্তপোক্ত হয় যে সরকারের সঙ্গে লড়াই করবে? সেটা রাজ্যে যা, কেন্দ্রেও তাই। দুই সরকারই প্রশাসনকে শেষ করে দিয়েছে, মনোবল ভেঙে দিয়েছে।''